ইসলাম ডেস্ক : তাবলীগ কী? সহজ ভাষায় অর্থ হল কারও পক্ষ থেকে কোনো কর্ম বাণী বা নিদর্শন দূরবর্তী লোকদের কাছে পৌঁছে দেয়া। ইসলামী আদর্শে দাওয়াত ও তাবলীগ এ দুটি শব্দ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। দাওয়াত হল দ্বীনের পথে ডাকা আর তাবলীগ হল দ্বীনের কর্মপদ্ধতি যা নবী (সা.)-এর প্রকাশ পেয়েছে তা অজানা-অচেনা মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে মানুষকে আল্লাহমুখী করে তোলা।
তাবলীগের ভিত্তি কী? বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণ শেষে আল্লাহ যখন অহি নাজিল করলেন ‘আল ইয়াওমা আকমালতু লাকুম দ্বীনাকুম ওয়া আতমামতু আলাইকুম নি’মাতি ওয়া রাদ্বিতু লাকুমুল ইসলামা দ্বীনা (আজকের এই দিনে তোমাদের জন্য জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ইসলামকে পরিপূর্ণ করে তোমাদেরকে আমার নিয়ামতে ভরপুর করে দিলাম আর আমি রাজি খুশি হয়ে গেলাম।) আল্লাহর এমন স্বীকৃতি পেয়ে নবী (সা.) খুশিতে আবেগপ্রবণ হয়ে নিজ মাথার কেশাগ্র ছিঁড়ে সাহাবিদের দিয়ে বললেন, ‘আগামীতে আমি তোমাদের সঙ্গে নাও থাকতে পারি। বাল্লিগু আন্নি ওয়ালাও আয়াহ আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী বা নিদর্শন হলেও দূরবর্তীদের কাছে পৌঁছে দিও।’ ওই সময় সেখানে প্রায় সোয়া লাখ সাহাবি উপস্থিত ছিলেন। ইতিহাস সাক্ষী ওই ময়দান থেকেই অনেক সাহাবি নিজ নিজ আÍীয়-পরিজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েন। সেই দাওয়াতের ধারাবাহিকতাই দাওয়াত ও তাবলিগের মেহনত, যা গেল শতাব্দীর গোড়ার দিকে হিন্দুস্তানের মেওয়াত অঞ্চলে শুরু করেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভির রূহানি আওলাদ মাওলানা ইলিয়াস (র.)। যা পত্র-পল্লবে ছেয়ে মহীরুহে পরিণত হয়ে ইসলামের শীতল ছায়ায় পাপের খরতাপে পোড়া মানুষকে ডেকে ডেকে আশ্রয় দিচ্ছে।
তাবলীগের নাম শোনলেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার নয়নজুড়ানো দৃশ্যাবলী। স্মৃতির ইথারে শোনতে পাই ‘খামুশ হয়ে যাই ভাই খামুশ হয়ে যাই, খুব চৌকান্না থাকি বহুত বড় মজমা, জিকিরে ফিকেরে থাকি, যার যার ডানে চলি’ ইত্যাদি শব্দমালা।
টঙ্গীর ময়দানে এবার বসছে ৪৯তম বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের আয়োজন। ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর পাগাড় নামক স্থানে দেশ-বিদেশের শত শত জামাত নিয়ে এর আয়োজন শুরু হয়।
তুরাগ নদীর প্রাচীন নাম ‘কহর দরিয়া’। এর তীরে পুঁথি সাহিত্যের কিংবদন্তি নায়িকা সোনাভানের প্রাসাদ ছিল বলে জনশ্রুতি আছে। ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি ইসলাম গ্রহণ করে হজরত আলী (রা.) তনয় মোহাম্মদ হানফিয়াকে বিয়ে করেন। এ বিয়ের কারণে স্থানীয় প্রভাবশালীদের বিরোধ হয়ে যুদ্ধে রূপ নেয়। মোহাম্মদ হানফিয়া কুফা থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে সোনাভানকে উদ্ধার করেন। মোহাম্মদ হানফিয়া ইমাম হোসেনের সৎ ভাই। মা ফাতিমার ইন্তেকালের পর হজরত আলী পুনরায় বিয়ে করলে তার জন্ম হয়। নবী বংশের রক্তধারার সঙ্গে যেন না মিশে যায় এ জন্য তাকে হজরত আলী তার মায়ের বংশীয় ধারায় পরিচিত করান। টঙ্গীতে যখন শৈশবে আসতাম তখন লোকমুখে এসব কথা শোনতাম।
এর সত্যাসত্য বিচারের ভার ইতিহাস গবেষকদের।
আমার মনে আছে আব্বার হাত ধরে সোনারগাঁ জামাতের সঙ্গে শৈশবে এ ময়দানে হাজির হই। চটের শামিয়ানা, বাঁশের খুঁটি বৈদ্যুতিক বাতির আলোতে রাতের দৃশ্য আমার কাছে অপূর্ব মনে হতো। মাঠের মধ্যখানে একটি বটগাছ এবং তাল গাছ জোড়া অবস্থায় ছিল তার পাশেই ওই সময় মিম্বর তৈরি হতো। সেখান থেকে মাইকের সাহায্যে বয়ান চলত। মুকাব্বিরের সাহায্যে নামাজের কাজ চলত। ইমাম সাহেবের তাকবির শুনে হাজার কণ্ঠে একসঙ্গে ‘আল্লাহু আকবর’ আওয়াজ এক মোহনীয় শব্দ তরঙ্গ তৈরি করত। একসঙ্গে লক্ষাধিক লোকের রুকু-সেজদা দেখার লোভে ইজতেমায় যাওয়ার জন্য আব্বার কাছে বায়না ধরতাম। আর আব্বাও তার জামাতের সাথীদের সঙ্গে আমাকে নিয়ে যেতেন। এক সময় তো এমন হল, আমাদের গোটা পরিবার ছোট বজরা নৌকা করে ইজতেমায় শরিক হওয়া আমাদের পারিবারিক রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল। আব্বা ছিলেন সোনারগাঁ পরগনার মুবাল্লিগ। পীর মাওলানা লালপুরী নামে সোনারগাঁ অঞ্চলে তার খ্যাতি ও প্রভাব ছিল। দারুল উলুম দেওবন্দে অধ্যয়নকালে মাওলানা ইলিয়াস (র.)-এর কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে তার দোয়া এজাজত নিয়ে সোনারগাঁ অঞ্চলে প্রেরিত হয়েছিলেন। তার প্রচেষ্টা ও মেহনতের ফলে সোনারগাঁ অঞ্চল থেকে বেশ কয়েকজন মুরব্বিকে পরবর্তীতে তাবলীগ জামাতের শূরা সদস্য হিসেবে দেখতে পাই, যাদের মধ্যে কাকরাইল মসজিদের প্রথম ইমাম মাওলানা কারি আম্বর আলী, মাওলানা কারি ওমর আলী, লাধুর চরের বড় হুজুর মাওলানা আবদুর রহমান, সোনারগাঁ পাঁচ পীর দরগার জাহের সাহেব অন্যতম।
যাদের প্রচেষ্টা ও মেহনতের ফলে টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার স্থায়ী আসন পেয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন- খুলনার মাওলানা আবদুল আজিজ, চট্টগ্রামের ব্যারিস্টার সানাউল্লাহ, ঢাকার হাজী আবদুল মুকিত, সোনারগাঁর মাওলানা নুরুল ইসলাম লালপুরী। তাদের দরদভরা দাওয়াতের কৌশল মানুষকে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে মৌচাকের মতো টেনে আনত।
আমার ভাবনায় তাবলীগ গতানুগতিক কোনো ইসলামী দল বা ফেরকা নয়। মাওলানা লালপুরীর ভাষায়- ‘এখানে শিয়া-সুন্নি-হানাফী-মালেকি ইত্যাদি আফরাদী তর্ক নাই। তাদের কাজ হল নিজের কর্মব্যস্ত জীবন থেকে কিছু সময় বের করে নিজ আমলের এসলাহের জন্য আল্লাহর রাস্তায় বের হয়ে পড়া।’ এ জন্য দেখা যায়, এদেশের সব শ্রেণীর লোকজন টঙ্গীর ময়দানে গিয়ে হাজির হয়। কিন্তু বড়ই আফসোসের বিষয়, বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় প্রেরণাকে আমরা মানুষ গড়ার কাজে ইনসাফভিত্তিক সমাজ গড়ার কাজে সুদবিহীন ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে লাগাতে পারছি না।
এর কারণ কী? আমি গভীরভাবে ভেবে দেখেছি এদেশে তাবলীগের প্রসার ঘটেছে সুফি দরবেশদের প্রভাবে। সুফিরা হিকমত, কৌশল ও ধৈর্যের মাধ্যমে মানব চরিত্র সংশোধনের চেষ্টায় আল্লাহর রহমত কামনা করেছেন। কাউকে কোনো কাজের জন্য জোর করেননি। যেমন নবীজীর জীবনে এমন একটি ঘটনা পাওয়া যায়। একদা সাহাবিদের ভরা মজলিসে এক যুবক এসে নবীজীর কাছে জেনা করার অনুমতি চায়। সাহাবিরা তার কথা শুনে ক্ষেপে গিয়ে তাকে মারতে উদ্যত হলে নবী (সা.) তাদের শান্ত করে ওই যুবককে আদর করে তার পিছে বসিয়ে রাখেন। মজলিশ শেষ হলে একান্তে কাছে ডেকে বলেন, ‘তুমি যে কাজের অনুমতি চাইছ সে কাজ যদি তোমার মায়ের সঙ্গে করার জন্য কেউ অনুমতি চায় তোমার কষ্ট লাগবে কি না?’
উত্তরে সে বলে, অবশ্যই কষ্ট পাব । নবীজী বলেন, তোমার ফুফু-খালার সঙ্গে করতে চাইলে? যুবক বলে তাও কষ্ট পাব। তোমার বোনের সঙ্গে? যুবক বলে তাও তো কষ্ট পাব। এবার নবী (সা.) বলেন, ‘তুমি যার সঙ্গে সে গর্হিত কাজ করতে চাও সে তো কারও মা, কারও ফুফু, কারও খালা, কারও বোন। তাদের কি কষ্ট লাগবে না? আমি রহমতের নবী হয়ে মানুষ কষ্ট পাবে সে কাজের অনুমতি দেই কী করে?’ নবীজীর কথা শুনে লজ্জিত হয়ে ক্ষমা চাইলে তিনি যুবকের বুকে আদরের হাত রেখে দরবারে ইলাহিতে তার জন্য দোয়া চেয়ে বলেন। ‘আল্লাহুম্মাগফির জাম্বালাহু’- আয় আল্লাহ তার গোনাহ মাফ করে দাও। ‘ওয়া হাচ্ছিন ফারজাহুও ওয়াগফির জাম্বাহু’- আর তার লজ্জাকে শানিত করে দাও। গোনাহকে মাফ করে দাও। ‘আল্লাহুম্মা তাহহির কালবাহু’- আয় আল্লাহ তার অন্তরকে বিশুদ্ধ করে দাও। ইতিহাস সাক্ষী পরবর্তীতে ওই যুবক সবচেয়ে শরিফ লজ্জাশীল যুবকে পরিণত হয়েছিল। এই ছিল দাওয়াতের কর্মপদ্ধতি। আজকের যুগেও যদি এমন দরদ নিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাবলীগের কাজ চলে আমার বিশ্বাস দেশের যুবসমাজ দাওয়াত ও তাবলীগের দিকে আকৃষ্ট হয়ে ইসলামের দিকে ফিরে আসবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।
১৩ জানুয়ারি ২০১৬ এমটিনিউজ২৪ডটকম/এসএম/ডিআরএ