বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৬, ০৪:১৮:১২

সুরের রাজধানীতে এখন পোড়া গন্ধ

সুরের রাজধানীতে এখন পোড়া গন্ধ

বিশ্বজিৎ বাবু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে : সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খার স্মৃতি ধরে রাখতে এবং সংস্কৃতির বিকাশে তার নিজ ভিটায় স্থাপন করা হয়েছিল সংগীতাঙ্গন। প্রায় পাঁচ যুগ আগে প্রতিষ্ঠিত সংগীতচর্চা কেন্দ্রটিতে এখন পোড়া গন্ধ।

হামলাকারীদের দেওয়া আগুনে পুড়েছে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ব্যবহূত বাদ্যযন্ত্রসহ বেশ কিছু মূল্যবান সম্পদ। সুরসম্রাট ওস্তাদ দি আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গনের ভবনটি এই ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন নিয়ে এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে।

এমন একটা মাস খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে সময়টায় শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ ভাষা চত্বরে সাংস্কৃতিক কোনো কর্মকাণ্ড কিংবা মেলা হয় না। গত মঙ্গলবার এখানে শেষ হয়েছে ‘বঙ্গ সংস্কৃতি উৎসব’। সেই বঙ্গ সংস্কৃতি উৎসবের মঞ্চ, প্যান্ডেল, চেয়ার ভেঙেচুরে একাকার করে দেওয়া হয়েছে। ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় ভাষা চত্বরের এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে।

তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে আঘাত হানা হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সংস্কৃতিতে। সুরের কিংবা সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে পরিচিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পড়েছে অসুরের থাবা। এই আঘাতকে পরিকল্পিত বলেই মনে করছেন সংস্কৃতিকর্মীরা, এমনকি প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইতেই কেঁদে উঠলেন সুরসম্রাট ওস্তাদ দি আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গনের সাধারণ সম্পাদক কবি আব্দুল মান্নান সরকার। কাঁদতে কাঁদতে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে বলার মতো ভাষা আমার নেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আরো অনেক বড় ঝড়ঝাপ্টা গেলেও ওস্তাদ আলাউদ্দিনের স্মৃতিবিজড়িত এই সংগীতাঙ্গনে কেউ আঘাত করতে আসেনি। তিলে তিলে গড়া এ প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।’

আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন পরিদর্শন শেষে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক ড. মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘হামলা থেকেই স্পষ্ট করে বোঝা যায় এটা পরিকল্পিত। মুক্তিযুদ্ধ ও সংস্কৃতির প্রতি আঘাত হানতেই এ ধরনের হামলা চালানো হয়েছে। আমরা দোষীদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।’  

উল্লেখ্য, অটোরিকশার ভাড়া মিটানো নিয়ে তুচ্ছ ঘটনায় বাদানুবাদের জের ধরে গত সোমবার সন্ধ্যার পর থেকে রাত পর্যন্ত প্রায় চার ঘণ্টা ধরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মাদ্রাসা ছাত্রদের সংঘর্ষে তাদের এক সহপাঠীর মৃত্যু হয়। আর এর জের ধরে গত মঙ্গলবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকায় আট ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চালায় মাদ্রাসা ছাত্ররা। এ সময় বেছে বেছে সাংস্কৃতিক সংগঠন, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে হামলা চালানো হয়।

তাণ্ডবের ঘটনায় গতকাল বুধবার ছয়টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি হয়েছে আখাউড়া রেলওয়ে থানায়। বাকিগুলো সদর থানায়। সব মামলায় আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতপরিচয় প্রায় পাঁচ হাজার লোককে। তবে মাদ্রাসা ছাত্র মাসুদুর রহমান নিহতের ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি।

তাণ্ডবের ক্ষতচিহ্ন : সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৌর এলাকার কুমারশীলের মোড়ের বাড়িটিতে থেকেও তিনি সংগীত চর্চা করতেন। ১৯৫৬ সালে আলাউদ্দিন খাঁর ভাই ওস্তাদ আয়াত আলী খাঁ এখানে সংগীতাঙ্গন গড়ে তুলেছিলেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সাহিত্য একাডেমি, শিশু নাট্যম, তিতাস সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিষদ, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পাঠাগার ও তিতাস ললিত কলা একাডেমি। ওই পাঁচটি প্রতিষ্ঠান থাকা চত্বরটিকে বছর পাঁচেক আগে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বর হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মূলত ওই চত্বরেই অনুষ্ঠিত হয় বৈশাখী মেলা, অদ্বৈত মেলা, বিজয় মেলাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। গত মঙ্গলবার সংগীত ও সংস্কৃতি চর্চার সব প্রতিষ্ঠানে হানা দিয়ে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করা হয়।

সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন ও সুর সম্রাট দি আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গন। এখানে আগুন লাগিয়ে দিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ে হামলাকারীরা। আগুনে সংগীতাঙ্গনে সংরক্ষিত আলাউদ্দিন খাঁ ব্যবহূত সরোদ, বেহালা, বেনজু, সন্তোর পুড়ে যায় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ ছাড়া ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষিত সৌদির বাদশাহর কাছ থেকে পাওয়া নামাজের বিছানা, ভারতের মাইহার রাজার কাছ থেকে পাওয়া গালিচাও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ভাষা চত্বরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার, হারমোনিয়ামসহ অন্যান্য আসবাবপত্রের ব্যাপক ক্ষতি করা হয়।

গতকাল আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গনে ঢুকতেই নাকে এসে লাগল পোড়া গন্ধের ঝাপ্টা। তখন সেখানে উত্সুক সাধারণ মানুষ ও সংস্কৃতিকর্মীরা ঘুরে দেখছিলেন পড়ে থাকা আগের দিনের ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন। দুপুরের দিকে সংগীতাঙ্গনের বিদ্যুত্ব্যবস্থা মেরামতের কাজ চলতে দেখা যায়। ভাষা চত্বরের প্রতিষ্ঠানগুলোতেও দেখা যায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ভাঙচুর করা আসবাবপত্র।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক আবদুন নূর বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করতেই পরিকল্পিত এ হামলা হয়েছে। সংস্কৃতিকর্মীরা ভাষা চত্বরে বসেই এ ঘটনার প্রতিবাদে সভা করেছে। আমরা হামলাকারীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।’

নাট্যব্যক্তিত্ব মনজুরুল আলম বলেন, ‘গতকাল (মঙ্গলবার) যে হামলা হয়েছে তা মুক্ত বুদ্ধি চর্চা ও মুক্তচিন্তার পরিপন্থী। এটা সভ্যতার প্রতি চরম আঘাত। আমরা এতে মর্মাহত। সব সংস্কৃতিকর্মীকে নিয়ে আমরা একটি প্রতিবাদ কর্মসূচি দেব।’

প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি পুড়ে যাওয়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সঙ্গে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী স্টেশনগুলোর টেলিযোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে কম্পিউটার পদ্ধতিতে টিকিট দেওয়া। প্রথম দফা হামলার ঘটনার প্রায় তিন-চার মিনিটের একটি ফুটেজ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে রয়েছে। ফুটেজ থাকার বিষয়ে জানাজানির পর দ্বিতীয় দফা হামলা চালিয়ে আলামত নষ্ট করতে বেশ কিছু কম্পিউটার ভেঙে ফেলা হয়। তবে বিদ্যুৎ না থাকায় দ্বিতীয় দফার ফুটেজ ক্যামেরায় ধরা পড়েনি। ফুটেজের মাধ্যমে জড়িতদের খুঁজে বের করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে।

গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন পরিদর্শন শেষে নিরাপত্তা বাহিনীর চিফ কমান্ড্যান্ট মো. আমিনুর রশিদ বলেন, ‘এমনিতেই রেলওয়েতে নিরাপত্তা বাহিনীর সংখ্যা কম। স্টেশনের হামলাকারীরা সংখ্যায় বেশি হওয়ায় ওই সময় পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়নি।’

রেলওয়ের বিভাগীয় ম্যানেজার (ঢাকা) মো. আরিফুজ্জামান বলেন, ‘হামলার ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনের প্রায় ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। স্টেশনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও টিকিটিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় যাত্রীসেবায় সমস্যা হচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে কিছু সময় লাগবে।’  

এ ছাড়া জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমপ্লেক্সে থাকা ব্যাংক এশিয়ার কার্যালয়, প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন সংস্থা, সাহিত্য একাডেমিসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন রয়ে গেছে।

জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মুফতি মো. মোবারক উল্লাহ বলেন, ‘ভাঙচুরের ঘটনা কিভাবে ঘটেছে তা আমরা বলতে পারছি না। কথা ছিল শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের। কিন্তু যখন আমরা ভাঙচুরের কথা শুনি তখন আমি নিজেই মাইক দিয়ে নিষেধ করি। ভাঙচুরের সঙ্গে আমাদের ছাত্রদের কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা নেই।’

শান্ত শহরে একটিই প্রশ্ন : দুই দিনের সংঘর্ষ ও তাণ্ডবের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর শান্ত হয়ে এসেছে। শহরের বিভিন্ন স্থানে গতকালও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে টহল দিতে দেখা যায়। তবে মাদ্রাসা ছাত্র কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের কাউকে মাঠে দেখা যায়নি। দোকানপাট কিছু কিছু খুলেছে। মানুষও রাস্তাঘাটে বের হয়েছে।

তবে মঙ্গলবার বিক্ষুব্ধ মাদ্রাসা ছাত্রদের পাশাপাশি হামলায় অংশ নেওয়া সাধারণ পোশাকের কিছু যুবককে দেখা গেছে। তাদের তাণ্ডবে নেতৃত্ব দিতেও দেখা গেছে এবং যাদের অনেকের মুখ ঢাকা ছিল। এই যুবক কারা এই প্রশ্নই ঘুরেফিরে আসছে সবার কথায়।

বাংলাদেশ ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উপদেষ্টা মো. মোসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ‘সাধারণ একটা ব্যাপার কেন এ পর্যন্ত পৌঁছাল, তা আমাদের বোধগম্য নয়। ধর্মীয় কোনো বিষয় না থাকা সত্ত্বেও বিক্ষোভটা কেন চরম আকার ধারণ করলো তা-ও বুঝতে পারছি না।’

সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠা জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সহসভাপতি ডা. মো. বজলুর রহমানও এমন ঘটনায় হতবাক। তিনি বলেন, ‘ঘটনার শুরুটা জামিয়া ইউনুসিয়াকেন্দ্রিক হলেও শেষ পর্যন্ত তা অন্যান্য মাদ্রাসায়ও ছড়িয়ে পড়ে, যে কারণে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যায়।’

পুলিশের ভূমিকা নিয়ে আ. লীগের অভিযোগ : গতকাল দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে জেলা আওয়ামী লীগ। এ সময় দলের সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকার বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানতেই পরিকল্পিতভাবে এ হামলা হয়েছে। এতে বিএনপি-জামায়াতের মদদ রয়েছে। পুলিশ হামলার শিকার প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষায় এগিয়ে আসেনি। বিক্ষোভকারীদের দমনেও তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না।’

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির সভাপতি মো. হাফিজুর রহমান মোল্লা বলেছেন, ‘মঙ্গলবার কী হয়েছে তা সবাই জানে। বিএনপির নেতাকর্মীরা এর সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নয়। আমাদের মামলায় ফাঁসাতেই এখন এ ধরনের কথা বলা হচ্ছে।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার এম এ মাসুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করেছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত তা খুঁজে বের করা হবে বলে জানান ওই পুলিশ কর্মকর্তা। সূত্র : কালের কণ্ঠ
১৪ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে