মিল্টন বিশ্বাস : গত ৩০ ডিসেম্বর দেশের ২৩৪টি পৌরসভায় একযোগে অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন। বাংলাদেশের মোট ভোটারের মাত্র ৭ শতাংশের (৭০ লাখ ৯৯ হাজার ১৪৪ জন ভোটার) অংশগ্রহণ এই নির্বাচনে থাকলেও সব জেলায় ভোট হওয়ায় তা মর্যাদার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছিল প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের তত্পরতায়। সব পৌরসভায় একজন করে মেয়র, সংরক্ষিত ৭৩১টি ও সাধারণ কাউন্সিলরের দুই হাজার ১৯৩টি পদের এই নির্বাচনে অংশ নেন ১২ হাজার প্রার্থী।
এর মধ্যে দলীয় মনোনয়নে ও প্রতীকে অনুষ্ঠিত মেয়র পদের নির্বাচনে ২২২টিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীরা মুখোমুখি লড়াইয়ে ছিলেন। সাতটি পৌরসভায় ক্ষমতাসীন দলের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপিসহ ২০টি রাজনৈতিক দল। এই নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে অংশ নেওয়া বিএনপির মেয়র প্রার্থীরা মাত্র ২২টি পৌরসভায় জয়লাভ করেছেন।
পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা ১৭৭টি পৌরসভার মেয়র পদে জয়ী হন। ২০১১ সালে চার ধাপে আড়াই শতাধিক পৌরসভায় দলীয় প্রতীকে না হলেও উভয় দলের সমর্থনপুষ্টরা প্রায় সমান সমান সংখ্যায় বিজয়ী হয়েছিলেন। এবারের ভোটের ফলাফল প্রমাণ করেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারই বাংলাদেশের মানুষের শেষ ভরসা।
অন্যদিকে ২০১৫ সালের শুরুতে বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতা ও পেট্রলবোমার জবাবও জনগণ দিয়েছে। জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত অবরোধের নামে সন্ত্রাসীদের অপতত্পরতায় দেশের মানুষ তখন জিম্মি ছিল। সেই জিম্মিদশা থেকে উদ্ধার পেয়ে এগিয়ে চলা বাংলাদেশের যোগ্য নেতৃত্বের প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছে সাধারণ জনগণ। সন্ত্রাস ও যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থক হওয়াটাই পৌরসভার নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের ভরাডুবির অন্যতম কারণ।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে না হওয়ায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর গত বছরের এপ্রিলে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এলেও ভোটগ্রহণের মাঝপথে সরে দাঁড়িয়েছিল বিএনপি। তার আগে বছরের শুরুতে তিন মাস সরকার পতনের আন্দোলনে নেমেছিল তারা, যাতে ব্যাপক নাশকতা করা হয় এবং সেসব মামলায় বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বসহ জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাজার হাজার নেতাকে আসামি হতে হয়।
তার আট মাস পর পৌর নির্বাচনে অংশ নিলেও শুরু থেকে নানা অভিযোগ জানিয়ে আসে দলটি, যার মধ্য দিয়ে সাত বছর পর কোনো নির্বাচনে ব্যালটে স্থান করে নেয় নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের পর দুইবার জাতীয় নির্বাচনে জয়ী ধানের শীষ প্রতীক। বিএনপি পৌর নির্বাচনকে প্রহসনের নির্বাচন ও সুষ্ঠু না হওয়ার অভিযোগ এনেছে। কিন্তু গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে বিএনপির অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় না।
২৮ ডিসেম্বরের সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়ার ভাষ্য মতে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশ হিসেবেই বিএনপি পৌর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়। নির্বাচনে তাদের দল শেষ পর্যন্ত ছিল এবং ফলাফল মেনে নিতে বাধ্যও হয়েছে বিএনপি। তা ছাড়া নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হলে প্রতিবাদ করত তৃণমূল জনতাই। কিন্তু দেশের কোথাও গণ-অসন্তোষের খবর জানা যায়নি। মানুষ এটা মনে করেনি যে নির্বাচনে তারা যে রায় দিয়েছে, সরকার তা পাল্টে দিয়েছে।
পৌরসভা নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়া এক অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারীদের সংখ্যা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। বিএনপির আরেক নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে নোংরা ও আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। এতে মানুষ আহত হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের জনগণ এর মধ্যেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের ওপর দৃঢ় আস্থা প্রদর্শন করেছে।
বর্তমান প্রজন্মের কাছে শেখ হাসিনা এক আশ্চর্য সাহসী রাজনীতিকের নাম; যার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় ভবিষ্যতের বাংলাদেশ উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া শেখ হাসিনাবিহীন যুদ্ধাপরাধের বিচার ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য তরুণ প্রজন্ম প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি-জামায়াতকে। আবার নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতার বীভৎস চিত্র গণমানুষকে আতঙ্কিত করে তোলায় তারা আওয়ামী লীগের ধারাবাহিকতায় সন্তোষ প্রকাশ করছে।
অনেক আগেই দেশের বিশিষ্টজনরা যুদ্ধাপরাধী বা একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে জামায়াতে ইসলামীর হরতাল ও নাশকতাকে বিচার ঠেকানোর কৌশল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। গাড়ি-বাড়িতে আগুন, পেট্রলবোমা, পুলিশকে মারধর ও হত্যা করা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে হত্যা ও পঙ্গু করা হয়েছে কয়েক বছর ধরে। আর এই জামায়াত-শিবিরের কর্মসূচিকে সমর্থন দিয়েছে বিএনপি। সহিংসতায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে জামায়াত-শিবির। টানা হরতাল-অবরোধে শিক্ষা, ব্যবসা আর বিদেশে দেশের ভাবমূর্তির অপূরণীয় ক্ষতিসাধিত হয়েছে।
এমনকি ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে আমেরিকা, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশের নাগরিককে তাদের দেশের কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ভ্রমণে নিরুৎসাহ করেছিল। সুস্থধারার রাজনীতি থেকে এই বিচ্যুতি দেশের তরুণ প্রজন্মকে দিশাহারা করেছিল সাময়িকভাবে। কিন্তু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা পুনরায় গণজাগরণ মঞ্চকে সামনে নিয়ে আসে এবং তরুণদের অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে-পরে ১৭ জন পুলিশ, দুজন বিজিবি ও দুজন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যকে হত্যা করে জামায়াত-বিএনপির সন্ত্রাসীরা। এ ছাড়া অসংখ্য সাধারণ মানুষকে হত্যা ও আহত করে আগুন দিয়ে, সেসব ঘটনা আমরা সবাই জানি। আবার এখন বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে।
রাজনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশ ও জনগণের উন্নয়ন। আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ব্যাপক। পৌরসভা নির্বাচনী প্রচারণায় আমরা দেখতে পেয়েছি অসাধারণ উপস্থাপনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ তাদের সাফল্যগুলো নিরন্তর প্রচার করে চলেছে। সেখানে তথ্যাদির নিরিখে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড প্রচার করা হয়েছিল।
আর তা যে সম্পন্ন হয়েছে এটা জনগণের কাছে স্পষ্ট। না হয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া কিংবা কোনো ভুল বা অতিরঞ্জিত তথ্য পরিবেশিত হলে তার সমালোচনা করা কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। এর আগে মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে যদিও কেউ কেউ মিথ্যাচার করেছে।
তবে উপস্থাপিত তথ্যাদি বা সরকারের উন্নয়ন না হওয়ার ব্যাপারে কোনো কথা বলেনি কেউ। সরকারের উন্নয়নের ব্যাপারে কোনো চ্যালেঞ্জ না করে নির্বাচনকে ভণ্ডুল করার জন্য উদ্ভট আর মিথ্যাচারের মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল বিএনপি-জামায়াত। শেষ পর্যন্ত তারা সরকারের উন্নয়নকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। আর সব দিক দিয়ে তাদের পরাজয় ঘটেছে বলেই দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে।
অস্তিত্ব সংকটে পড়া বিএনপি চেয়েছিল পৌরসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে দলীয় নেতাকর্মীদের ভেঙে যাওয়া মনোবল চাঙ্গা করে ফের রাজনৈতিক ময়দানে ঘুরে দাঁড়াতে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের টার্গেট ছিল নৌকার পালে জোয়ার তুলে পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির ফের ভরাডুবি ঘটিয়ে রাজনৈতিকভাবে তাদের খাদের কিনারে নিয়ে যাওয়া। এমন পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়ে দুই দলই নানা কৌশল নিয়ে তৃণমূলে মাঠ দাপিয়ে বেড়ায়।
শেষ পর্যন্ত পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একচেটিয়া বিজয় পেয়েছে। এই ফলাফল খুব বেশি অপ্রত্যাশিত ছিল না। আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা কোথাও কোথাও ৯০ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পেয়েছেন। তবে গড়ে ৭০ শতাংশ ভোট পেয়েছেন এই দলের প্রার্থীরা। পৌর নির্বাচনে ব্যাপক বিজয় নিঃসন্দেহে সরকারের প্রতি জনগণের আস্থার প্রতিফলন। সরকারকে এখন রক্ষা করতে হবে প্রতিশ্রুতি, ভোটারদের আস্থার মূল্যায়ন করতে হবে।
এই সমর্থন বজায় রাখতে গেলে তার জন্য সচেষ্ট হতে হবে সরকারকে। রাজনৈতিক মনোনয়নে এবার পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগে অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকট হয়েছে। তবু শাসক দল আওয়ামী লীগ তার বিদ্রোহীদের মিলিয়ে বেশি মেয়র পদে জিতেছে। তরুণরা ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতি যে আস্থা রেখেছে তার মূল্যায়ন করতে হবে। তারা হিংসা-হানাহানি চায় না। তারা চায় রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন। -কালের কণ্ঠ
লেখক : অধ্যাপক ও পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
১৪ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি