মহিউদ্দীন জুয়েল: ‘আপনাদের এখানে নাকি একটি শিশু আছে। যার পিতা-মাতা ফেলে রেখে চলে গেছে হাসপাতালের বারান্দায়?’ একজন আয়াকে এমন প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন আরাবি। সে এখন আমাদের হাসপাতালেরই একজন সদস্য। বড় বড় ডাক্তার, ইন্টার্নি আপুরা আর আমরা মিলে সারাক্ষণ ওর দেখভাল করছি। ও খুব সুন্দর হাসি দেয়।
আয়ার কথার সূত্র ধরে গতকাল বুধবার সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগে গিয়ে দেখা মেললো সেই শিশুটির। যাকে চিকিৎসার জন্য কিছুদিন আগে হাসপাতালে এনে রোগের কথা শুনে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল তার নিষ্ঠুর বাবা মা।
তবে তাকে বেড়ে তুলতে এগিয়ে এসেছেন পুরো মেডিকেল কর্তৃপক্ষ। যখন সংবাদটি ছড়িয়ে পড়ে এই কান থেকে ওই কান। তখন হাসপাতালের সব শিক্ষার্থী ডাক্তার আর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হাত বাড়িয়ে দিলো তার দিকে। কেউ গা মুছে দিচ্ছেন। কেউবা মুখে তুলে খাওয়াচ্ছেন। অনেকে আবার কোলে নেয়া নিয়ে করছেন মান অভিমান।
হাসপাতালের ডাক্তাররা জানান, আরাবির বয়স এখন ৬ মাস। কোথা থেকে এসেছে, কারা তার বাবা মা কেউ কিছু জানেন না। তবে আরাবি নামটি দিয়েছে হাসপাতালের চিকিৎসকরা। ইন্টার্নি ডাক্তার আর নার্স, আয়ারা তাকে পরিবারের মতোই সকালের খাবার খাইয়ে তাকে সঙ্গ দিচ্ছেন। তরল খাদ্য যেমন দুধ, পানি, সাগু কিংবা পুষ্টিকর খাবার যাতে শিশুটির শরীরে ঘাটতি না থাকে সেজন্য পালা করে সবাই মিলে সে বিষয়ে রাখছেন খেয়াল।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি ওয়ার্ড এখন আরাবির নতুন ঠিকানা। সেখানে তার যত্ন আত্মি হচ্ছে। সব মিলিয়ে ১০/১৫ জন রয়েছে এই শিশুটির সেবায়।
শিশু সার্জারি ওয়ার্ডের সেবিকা আসমা আকতার বলেন, বাচ্চাটিকে যেদিন কোলে নেই সেদিন বুকটা ভরে যায়। আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন আছে। তবে আমাকেই বেশি পছন্দ করে মনে হয়। কান্না করার কিছুক্ষণ পরই আবার হাসি দেয়।
আরেক সেবিকা হোছনে আরা বলেন, ডাক্তার তাহমিনা ম্যাডাম বাচ্চাটির খোঁজ খবর করেন। পরিচালক স্যারও বেশ আন্তরিক। ভোর সকালে ইন্টার্নি ডাক্তাররা রোগী দেখতে এলে সবাই মিলে তার কাছে আসতে ভুল করেন না।
কিভাবে পাওয়া গেলো এই আরাবিকে? জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক জানালেন, গত বছরের ২৫শে জুলাই বিকালে চমেক হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটার কক্ষের পাশের বারান্দায় কাঁদছিল সে। সন্ধ্যা পর্যন্ত যখন কেউ বাচ্চাটির খবর নিতে আসেনি তখন আয়া শিশু সার্জারি বিভাগের এক ডাক্তারের কাছে তাকে নিয়ে যায়।
পরে পুরো হাসপাতালে খোঁজ করেও পাওয়া যায়নি শিশুটির পিতা মাতাকে। একপর্যায়ে সবাই মিলে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার উদ্যোগ নিলে বেরিয়ে আসে অন্য তথ্য। টেস্টে পাওয়া যায় শিশু আরাবি মেনিনগোমাইলোসিল সমস্যায় ভুগছে। এই রোগের লক্ষণ হলো জন্মের পর মেরুদণ্ড গড়ে না ওঠা।
পাশাপাশি শিশুটি দাঁড়ালে তার দুই পা সমান থাকে না। একটি পা বাঁকা হয়ে যায় কিছুটা। ধারণা করা যায়, এসব সমস্যা দেখা দেওয়ায় আরাবির বাবা মা তাকে ফেলে রেখে চলে গেছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের প্রধান তাহমিনা বানু বলেন, শিশুটি এখন সেরে উঠছে। তার একটি অপারেশন হয়েছে। আরেকটি অপারেশন হলে সে পুরোপুরি সুস্থ হবে। তার পিঠে অস্ত্রোপচার হয়েছে। তাকে ফিজিওথেরাপি দেয়া হচ্ছে নিয়মিত।
তিনি আরও বলেন, বাচ্চাটিকে যারা নিতে চায় আমরা অবশ্যই দেবো। এই ক্ষেত্রে উদারতা ও মানবিকতা দুটোরই পরিচয় দিতে হবে। তবে তার পায়ে এখন একটু সমস্যা আছে। অন্যসব সমস্যা দূর হয়েছে। দিন গেলে হয়তো সুস্থ হয়ে উঠবে। আমরা চাই না এতিম খানায় বাচ্চাটিকে দিয়ে তার সুন্দর ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে।-এমজমিন
১৪ জানুয়ারি ২০১৬/এমটি নিউজ২৪ডটকম/জুবায়ের/রাসেল