ঢাকা : বাংলাদেশ ব্যাংকে চুক্তিভিত্তিকভাবে এক কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক কারসাজির চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা গেছে। এ কারসাজির সাথে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে এ নিয়ে ব্যাংকের সর্বমহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক চুক্তিভিত্তিকভাবে এক বছরের জন্য গভর্নর সচিবালয়ের মহাব্যবস্থাপক (এক্স ক্যাডার-প্রটোকল) পদে নিয়োগের জন্য ২০১৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। ওই পদের জন্য আবেদনের শেষ সময় ছিল ১০ জাুয়ারি। দুই লাখ টাকা বেতনের আকর্ষণীয় এ চাকরিতে দরখাস্ত আহ্বান করা হলেও সেখানে মাত্র আবেদন একটি পড়েছে। তাও আবার যে আবেদনটি জমা পড়েছে তা একই পদে বর্তমানে চাকরিরত মহাব্যবস্থাপক এএফএম আসাদুজ্জামানের।
একটি আবেদন পড়ার কারণ হিসেবে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে পাওয়া গেছে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। সূত্রটি জানায়, এএফএম আসাদুজ্জামানের চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পুনরায় নিয়োগ প্রদান করার জন্য বোর্ড মিটিংয়ে বিষয়টি পাস করানো হয়। অভিযোগ রয়েছে, কয়েকজনের যোগসাজশে সার্কুলারটি এমনভাবে তৈরি এবং প্রকাশ করা হয়েছে যেন উল্লেখিত কর্মকর্তা ছাড়া আর কেউই এতে আবেদন করতে না পারেন। আর বাস্তবেও তাই ঘটেছে।
প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বয়সসীমা বেধে দেয়া হয়েছিল ৫৫-৬০ বছর। অভিজ্ঞতায় গিয়ে বলা হয়েছিল- সরকারি বা বেসরকারি বা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান বা কোনো সংস্থায় ২৫ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা। সঙ্গে প্রটোকল অফিসার হিসেবে ১০ বছরের প্রায়োগিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ বিরাজ করছে। কারণ স্বাভাবিকভাবে একজন কর্মকর্তা দীর্ঘদিন চাকরি করে মহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। আর এই পদটিতে যারা পদোন্নতি পান তারা তাদের মেধা ও দক্ষতার কারণেই পান। একজন চলে গেলে সেই জায়গায় তার নিচের পদের যোগ্য কর্মকর্তাকেই পদোন্নতি প্রদান করা হয়। কিন্তু সেখানে যদি কাউকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হয় তাহলে সেই পদের পরবর্তী যোগ্য কর্মকর্তাটি বঞ্চিত হন।
বিষয়টি যখন বোর্ড সভায় উত্থাপন করা হয় তখন বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসার্স কাউন্সিল ক্ষোভ প্রকাশ করে গভর্নর ড. আতিউর রহমানকে একটি চিঠিও দেয়। কিন্তু তা আমলে নেয়া হয়নি। অজ্ঞাত কারণেই সেটি বোর্ড সভায় পাস করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা বছরের পর বছর চাকরি করে যখন মহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি পাব ঠিক তখনই যদি কাউকে সেখানে চুক্তিতে আনা হয়, তাহলে একজন সেন্ট্রাল ব্যাংকার হিসেবে নিজেকে মেধাহীন মনে হয়। তার মানে কি এখানে মেধাবীরা কাজ করছে না?’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অপর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে তা কখনো আশা করিনি। কেননা বর্তমানে যেখানে দেশে চাকরি নেই সেখানে একজনকে কৌশলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে মেধাবীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। এতে ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তার মাঝেই এ নিয়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে। আমরা আশা করবো, গভর্নর বিষয়টি সুবিবেচনায় নেবেন এবং যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে কর্মকর্তাদের ক্ষোভ প্রশমিত করবেন।
জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক পদের বিপরীতে বেশকিছু কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে কাজ করে যাচ্ছেন, যাদের বেতন সর্বনিম্ন ২ লাখ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত। এর মধ্যে প্রটোকলের মহাব্যবস্থাপক পদে যাকে নিয়োগ দেয়া হবে তার বেতন উল্লেখ করা হয়েছে ২ লাখ টাকা।
অন্য যারা কাজ করছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন- এসএসই বিভাগে উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত সুকোমল সিংহ চৌধুরী; যার বেতন ২ লাখ টাকা, চিকিৎসা কেন্দ্রের মহাব্যবস্থাক হিসেবে চুক্তিভিত্তিকভাবে একাধিকবার নিয়োগ পাওয়া ড. মিহির কান্তি চক্রবর্তী; যার বেতন ২ লাখ টাকা, বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের চুক্তিভিত্তিক মহাব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত দেবপ্রসাদ দেবনাথ। দেবপ্রসাদের বেতনও দুই লাখ টাকা।
অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক পদে চাকরিরত অবস্থায় ৮ম জাতীয় পে-স্কেলে যারা কাজ করছেন তাদের বেতন গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৮৭ হাজার টাকার আশপাশে; যা আগের স্কেলে ছিল ৪৫ হাজার টাকার মতো। সুতরাং একই জায়গায় দ্বিগুণেরও বেশি টাকা দিয়ে যাদের আবারো চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে বা হচ্ছে তারা সবাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই সাবেক কর্মকর্তা। এতে করে কর্মকর্তারা মনে করছেন, একই কাজের জন্য বেশি অর্থ দিয়ে লোক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, অন্যদের পদবঞ্চনা ও কর্মকর্তাদের মেধার অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে।
তবে গভর্নর সবসময়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে মেধাবীদের মিলনমেলা হিসেবে দাবি করেন। তিনি নিজে এ দাবি করেন আবার নিজেই সেটার অবমূল্যায়ন করছেন বলেও অভিযোগ কর্মকর্তাদের। তাই গভর্নর ড. আতিউর রহমান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান পরিস্থিতি আমলে নিয়ে আর কোনো পদে কাউকে চুক্তিভিত্তিক দেবেন না বলেই সবার প্রত্যাশা।
কেননা যাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চুক্তিভিত্তিকভাবে এক বছরের জন্য গভর্নর সচিবালয়ের মহাব্যবস্থাপক (এক্স. ক্যাডার-প্রটোকল) পদে নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ওই অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকটির ওই কর্মকর্তার দাপটে তটস্থ অনেকে।
প্রুফ রিডার থেকে জিএম হওয়া এ এফ এম আসাদুজ্জামানের (জিএম প্রটৌকল) দাপটে এতদিন কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননি। চাকরিবিধি অনুযায়ী ৩০ ডিসেম্বর তিনি অবসরে চলে যান। কিন্তু অবসরে যাওয়ার আগেই পুনরায় নিয়োগ পেতে সব প্রক্রিয়াই সম্পন্ন করে গেছেন। এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতার প্রক্রিয়া চলছে বলে সংশ্লিষ্টদের দাবি।
আর ওই ব্যক্তি আবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেলে ব্যাংকে আরো অরাজকতা চলে আসবে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। নিয়োগ পেতে মরিয়া ওই ব্যক্তি ব্যাংকের গভর্নরের দোহাই দিয়ে বরাবরই উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। অথচ তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ব্যাংকের অনেকেই চান না। কিন্তু হাল ছাড়েননি এ এফ এম আসাদুজ্জামান।
অবসরে যাওয়ার আগেই তিনি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে উঠেপড়ে লাগেন। সব প্রক্রিয়াও নিজ হাতে করে যান। অর্থাৎ যে করেই হোক নিয়োগ যে তার পেতেই হবে। এমন অভিযোগ বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে এ এফ এম আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে বিস্তর অনৈতিক লেনদেনের।
চাকরিকালীন সরকারি জ্বালানি অপচয় করে তিনি ব্যাংকের তিন তিনটি গাড়ি ব্যবহারও করেন। তিনি বিদেশে সফরে থাকাকালীন তার পরিবার নিয়মিত সেই তিনটি গাড়ি ব্যবহার করেছেন। সুবিধাবাদী ওই ব্যাংক কর্মকর্তার দাপটে ব্যাংকের কেউ টু শব্দ করতে পারতেন না। এতে সরকারের জ্বালানি বাবদ লাখ লাখ টাকা গচ্চা গেছে। গাড়ি সংকটে অন্যান্য কর্মকর্তারা ঠিকমত অফিস ও বাসায় যেতে না পারলেও ঠিকই ওই কর্মকর্তা ও তার পরিবার ব্যাংকের তিনটি গাড়ি ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, শুনেছি তিনি নাকি আবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন। গভর্নর স্যারের কাছের লোক হলে তো অসম্ভব কিছু না। তিনটি গাড়ি হাঁকালে তো জ্বালানি অপচয় হবেই। জিএম প্রটৌকল আসাদুজ্জামানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ও অনিয়মের বিষয়ে জানতে অর্থসচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সদস্য মাহবুব আহমেদকে মুঠোফোনে ফোন করা হলে তিনি তা রিসিভ করেননি।
১৬ জানুয়ারি, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪ডটকম/এসএম/এমআর