শনিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৬, ০১:৫৪:৪৪

রাজনীতিতে উপেক্ষিত নারী

রাজনীতিতে উপেক্ষিত নারী

মাহমুদ আজহার, গোলাম রাব্বানী ও রফিকুল ইসলাম রনি : গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ২০০৮ অনুযায়ী নিবন্ধন নেওয়ার সময় প্রতিটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, ২০২০ সালের মধ্যে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের সর্বস্তরের কমিটিতে ৩৩ ভাগ নারীকে রাখা হবে। কমিশনকে দেওয়া এ শর্ত মেনেই নিবন্ধন নেয় রাজনৈতিক দলগুলো। এরই মধ্যে চলে গেছে সাতটি বছর।

কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলে তেমন গুরুত্ব পায়নি নারী নেতৃত্ব। তৃণমূলের নেতৃত্বে পুরোপুরিভাবেই উপেক্ষিত নারী। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি দল একাধিকবার কাউন্সিল করলেও সব কমিটিতে নারীকে রাখা হয়েছে গুরুত্বহীন করে। আগামী মার্চে আবারও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো কাউন্সিলের কথা ভাবছে। কিন্তু নারীদের নেতৃত্বে নিয়ে আসার ব্যাপারে কারোরই কার্যকর কোনো উদ্যোগই দেখা যাচ্ছে না। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনেও কোনো তত্পরতা নেই।

গতকাল সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নিবন্ধনের শর্ত রাজনৈতিক দলগুলো মানছে কিনা, তা পর্যবেক্ষণ করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কমিটিতে নারীর ৩৩ ভাগ উপস্থিতি থাকার বিষয়েও রাজনৈতিক দলগুলোকে সতর্ক করতে পারে ইসি। কারণ, অদ্যাবধিও এ নিয়ে কোনো উদ্যোগই নিচ্ছে না দলগুলো। তবে এখনই শর্ত ভঙ্গ হয়েছে, বলা যাবে না। ২০২০ সাল পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। সব পক্ষ থেকেই এ ব্যাপারে চাপ আসা উচিত।’

জানা গেছে, প্রধান তিন দলে শীর্ষ পর্যায়ে নারীর উপস্থিতি থাকলেও কেন্দ্রীয় কমিটিতে এর সংখ্যা বরাবরের মতোই উপেক্ষিত থাকছে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে গতানুগতিক ‘মহিলাবিষয়ক সম্পাদক’ পদেই নারীকে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে।

মহানগর, জেলা বা উপজেলার নেতৃত্বে নারীর উপস্থিতি প্রায় শূন্যের কোঠায়। সংসদের সংরক্ষিত আসনে ৫০ ভাগ নারী সদস্যকে রাখা হলেও তাদের কার্যক্ষমতা খুবই সীমিত। দু-একটি বাদে বাম দলগুলোর নেতৃত্বেও নেই নারী প্রতিনিধি। ইসলামী দলগুলোর নেতৃত্বে নারীর কোনো ভূমিকা নেই। আওয়ামী লীগের ৭৩ সদস্যের কার্যনির্বাহী সংসদ রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র সভাপতিসহ মাত্র নয়জন নারী কমিটিতে রয়েছেন; যা কেন্দ্রীয় কমিটির মোট নেতৃত্বের প্রায় ১২ ভাগ।

অন্যদিকে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ৩৮৬ সদস্যের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির মধ্যে ৪৪ জন নারী প্রতিনিধিত্ব করছেন; যা মোট নেতৃত্বের প্রায় ১১ ভাগ। বিভিন্ন দলের নারী নেত্রীরা বলছেন, সামনে কাউন্সিল আসছে। ‘নারীবান্ধব’ কমিটি প্রত্যাশা করছি। শুধু নির্বাচন কমিশনের কোটা পূরণই নয়, সব ক্ষেত্রে সব দলে নারীর ক্ষমতায়ন বাড়াতে হবে। তৃণমূলের সব কমিটিতেও নারীকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। কাগজে কলমে নয়, আমরা বাস্তবে নারীর সমান অধিকার চাই।

আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ফজিলাতুন্নেসা ইন্দিরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নারী নেতৃত্ব নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। প্রেসিডিয়ামেও কয়েকজন নারী সদস্য রয়েছেন। আশা করছি, আগামী কাউন্সিলে নারীরা প্রাধান্য পাবেন। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোতেও নারীর ক্ষমতায়ন বাড়ানোর ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’

বিএনপির সহ-মহিলাবিষয়ক সম্পাদক শিরিন সুলতানা বলেন, ‘রাষ্ট্রে নারীরা বৈষম্যের শিকার। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধু নারী হওয়ার কারণে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাচ্ছেন না নারীরা। রাজনৈতিক দলগুলোও নারীবান্ধব নয়। নিবন্ধন নেওয়ার সাত বছরেও রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ১১ ভাগের বেশি নারী না থাকা দুর্ভাগ্যজনক। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’

আওয়ামী লীগ : কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ নেতৃত্বে নারী প্রতিনিধির একটি অংশ থাকলেও পিছিয়ে তৃণমূলে। ৭৩ সদস্যবিশিষ্ট আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে দলীয় সভানেত্রী ছাড়াও তিনজন প্রেসিডিয়াম, তিনজন সম্পাদকমণ্ডলী ও দুজন সদস্য— এই মোট নয়জন নারী থাকলেও জেলা-মহানগর নেতৃত্বে নারীর প্রতিনিধিত্ব নেই। অবশ্য গুটিকয় উপজেলায় নারীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে আওয়ামী লীগে।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র ও নিয়মাবলির সদস্যপদ-এর (৪) ধারায় বলা হয়েছে— ‘আগামী ২০২০ সালের মধ্যে ক্রমান্বয়ে পূরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী সংসদসহ দলের সকল স্তরের কমিটিতে ন্যূনতম ৩৩ শতাংশ পদ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকিবে।’ এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী, সংসদের স্পিকারসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা কাজ করে তাদের যোগ্যতার প্রমাণ করেছেন। তাই আগামীতে কেন্দ্রীয় কমিটি কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনায় আরও নারী সদস্যদের প্রাধান্য দেওয়া হবে।

বিএনপি : দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে রয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি ৩৮৬ সদস্যের নির্বাহী কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটিতে বেগম সারোয়ারী রহমানই একমাত্র নারী। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদে একজনও নারী প্রতিনিধি নেই। ১৮ সদস্যের ভাইস চেয়ারম্যান পদে রাবেয়া চৌধুরী ও সেলিমা রহমান রয়েছেন। যুগ্ম-মহাসচিব, সাংগঠনিক কিংবা আন্তর্জাতিক সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদেও কোনো নারী প্রতিনিধি নেই।

১২১ সদস্যের কর্মকর্তার মধ্যে মহিলাবিষয়ক সম্পাদক খালেদা রব্বানী, শিশুবিষয়ক সম্পাদক বেগম রোজী কবীর, উপজাতিবিষয়ক সম্পাদক মিসেস ম্যা ম্যা চিং, সহ-মহিলাবিষয়ক সম্পাদক নূরে আরা সাফা ও শিরিন সুলতানা প্রতিনিধিত্ব করছেন। ২৬৫ সদস্যের নির্বাহী কমিটির সদস্যপদে গুটিকয় নারী প্রতিনিধি রয়েছেন। বিএনপির ৭৫টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে শুধু জেলা পর্যায়ে সভাপতি হিসেবে কুমিল্লা দক্ষিণে রাবেয়া চৌধুরী ও মানিকগঞ্জে আফরোজা খানম রীতা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। উপজেলা কিংবা ইউনিয়ন পর্যায়েও কোনো নারী প্রতিনিধিত্ব নেই।

বিএনপির গঠনতন্ত্রে উল্লেখ করা হয়েছে— ‘২০২০ সালের মধ্যে সকল কমিটিতে মহিলা সদস্য সংখ্যা শতকরা ৩৩ ভাগে উন্নীত করতে হবে।’ এ প্রসঙ্গে বিএনপি সমর্থিত একজন বুদ্ধিজীবী বলেন, ‘বিএনপি নারীবান্ধব রাজনৈতিক দল নয়। তবে দলটি নারী উন্নয়নবান্ধব। দলের নেতৃত্ব পর্যায়ে নারীদের অবস্থা ভালো নয়।’

জাতীয় পার্টি : জাতীয় পার্টির ৪২ সদস্যের প্রেসিডিয়ামে নারী সদস্য রয়েছে চার। পার্টির চেয়ারম্যানের ১৭ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদে কোনো নারী নেই। ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম-মহাসচিব ও সম্পাদকমণ্ডলীতে উল্লেখযোগ্য নারী নেতৃত্ব নেই। এ ছাড়াও জাতীয় পার্টির সারা দেশে ৮৪টি সাংগঠনিক জেলা কমিটিতে রওশন এরশাদ, মাহজাবিন মোরশেদ, সালমা ইসলাম ছাড়া আর কোনো নারী নেতৃত্ব নেই বলে জানা গেছে।

পার্টির প্রেসিডিয়ামের একজন নারী সদস্য জানান, জাতীয় পার্টিতে নারীদের অনেক অবদান রয়েছে। কিন্তু কেন জানি বর্তমানে নারীরা নেতৃত্বে আর আসছে না। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কমিটি ও নেতৃত্বেও নারীদের তেমন উপস্থিতি নেই। এসব দলে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে একক প্রাধান্য পুরুষদেরই। নারীরা সেখানে অবহেলিত, উপেক্ষিত।  -বিডি প্রতিদিন
 
২২ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে