সোমবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০১৬, ০২:২৪:২৭

মেয়ের আবদার পূরণ করতে গিয়ে লাশ হলেন বাবা-চাচা

মেয়ের আবদার পূরণ করতে গিয়ে লাশ হলেন বাবা-চাচা

জাবেদ ইকবাল, শাবি থেকে : শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিনন্দন আইআইসিটি ভবন দেখতে কলেজশিক্ষক বাবার কাছে বায়না ধরেছিলেন মেয়ে রাহিবা। মেয়ের আবদার পূরণ করতে চাচা আর মেয়েকে নিয়ে শনিবার শাবিতে ঘুরতে আসেন কলেজশিক্ষক আতাউর রহমান। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যস্ততম সড়কে দিনদুপুরে প্রাইভেটকার চালানো শিখছিলেন অধ্যাপক আরিফুল ইসলাম।

তার গাড়ির নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারান কলেজ শিক্ষক আতাউর রহমান ও তার চাচা গিয়াস উদ্দিন। গুরুতর আহত হন আতাউরের মেয়ে রাহিবা। ড্রাইভিং প্রশিক্ষণকালে প্রাইভেট কার দুর্ঘটনায় এক কলেজশিক্ষকসহ ২ পথচারী নিহতের ঘটনায় পলাতক রয়েছেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আরিফুল ইসলাম। তবে রোববার সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোনো মামলা দায়ের হয়নি।

পলাতক শিক্ষক আরিফুল: ঘটনার পর থেকেই সপরিবারে উধাও হয়ে গেছেন ড. আরিফুল ইসলাম। তিনি প্রথমে একটা বেসরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিলেও তারপর থেকে পলাতক। ‘তিনি কোথায় আছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও কিছু জানে না, তবে ক্যাম্পাসে নেই’ বলে মন্তব্য করেন শাবি ভিসি অধ্যাপক আমিনুল হক ভূঁইয়া।

শনিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক কোয়ার্টারে তার বাসার লাইট নিভানো দেখা যায়। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন শিক্ষক জানান, পাজরের হাড় ভাঙায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনি সম্ভবত ঢাকায় আছেন। সহকারী প্রক্টর সামিউল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনার পর থেকে প্রক্টরিয়াল বডির কারো সঙ্গে এখন পর্যন্ত তার যোগাযোগ হয়নি। আমরা অনেক চেষ্টা করেও তার কোনো খোঁজ পাইনি। জালালাবাদ থানার ওসি আক্তার হোসেন বলেন, তিনি (আরিফ) আত্মগোপনে রয়েছেন। সকাল থেকে তিনি ক্যাম্পাসে আসেননি। ‘তিনি তার বাসায়ও নেই এবং আমরা চেষ্টা করেও তার সন্ধান করতে পারিনি’।

দাফন সম্পন্ন: নিহত কলেজ শিক্ষক আতাউর রহমান ও তার চাচা গিয়াস উদ্দিনের লাশ সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের চাইলগাঁও ইউনিয়নের কাতিয়া গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয় শনিবার রাতেই। রোববার সকাল ১১টায় নিহতদের দাফন সম্পন্ন হয়। ওদিকে এ  ঘটনায় হত্যা মামলা দায়েরের প্রস্তুতি  নেয়া হচ্ছে। গিয়াস উদ্দিনের ছেলে বাদী হয়ে সিলেটের জালালাবাদ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করবেন বলে জানিয়েছেন নিহতের পরিবার।

গিয়াস উদ্দিনের ছেলে জানান, একাই দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাদী হবেন তিনি। বলেন আমার ভাই ও বাবাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের করা হবে। জালালাবাদ থানার ওসি আখতার হোসেন বলেন, নিহতদের পরিবার আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তারা মামলা করার জন্য থানায় আসবেন বলে জানিয়েছেন। তারা মামলা না করলে পুলিশ বাদী হয়ে এই ঘটনায় মামলা করবে বলে জানান ওসি।

মোবাইল ফোন বন্ধক রেখে চিকিৎসা করান যুবক: ঘটনাস্থলেই দুইজন নিহত হলেও আহত রাহিবাকে হাসপাতালে  নেয়ার মতো কেউ ছিল না। এমন সময় নিজের মোটরসাইকেল ফেলেই অটোরিকশায় করে ওই ছাত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যান আবদুল আলীম নামে এক যুবক। নিজের মোবাইল বন্ধক রেখে ওই ছাত্রীর চিকিৎসা করান তিনি।

হাসপাতালে তিনি নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র পরিচয় দেয়ায় ডাক্তাররা রাহিবার দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। একসময় কর্তব্যরত ডাক্তার রাহিবার জন্য ওষুধের একটি লিস্ট ধরিয়ে দিলে আলিমের কাছে  কোনো টাকা না থাকায় নিজের  মোবাইল ওষুধের দোকানে বন্ধক রেখে ওষুধ নিয়ে আসেন। পরে আবারো ওই ছাত্রীর এক্স-রেসহ অন্যান্য ব্যবস্থা করেন। এসময় তিনি জানতেন না ওই ছাত্রীর পরিচয় কি।

তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দুর্ঘটনাস্থলে অবস্থান করলেও হাসপাতালে গিয়ে আহতদের কোনো খোঁজ নেননি বলে অভিযোগ করেন তিনি। এমন একটি ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবেকবানদের এমন আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। শহরতলীর বড়গুল এলাকার বাসিন্দা আব্দুল আলিম জানান, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা পাননি। এমনকি হাসপাতালেও তিনি কাউকে পাননি।

যা ঘটেছিল: কিছুদিন আগেই কেনা গাড়িতে (ঢাকা মেট্রো গ-২০-৪০০৯) চালককে তার আসনে বসিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে ক্যাম্পাসের ব্যস্ততম রাস্তা কিলোরোডে ড্রাইভিং প্র্যাকটিস করতেন ড. আরিফুল ইসলাম। শনিবার ড্রাইভিং লাইসেন্সহীন সেই অধ্যাপকের কাণ্ডজ্ঞানহীনতার বলি হতে হয় কলেজ শিক্ষক ভাগ্নে ও তার চাচাকে।

কিলোরোডে ড্রাইভিং প্র্যাকটিস করতে এসে ব্রেকের বদলে এক্সিলেটরে চাপ দিয়ে গাড়ি তুলে দেন তিন পথচারীর উপরে, যার একজন ঘটনাস্থলেই এবং আরেকজন হাসপাতালে নেয়ার পরপরই মারা যান। নিহত সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক শেখ আতাউর রহমান (৫৫) ও তার চাচা  মো. গিয়াস উদ্দিনের (৭০) সঙ্গে ঘুরতে আসা কলেজ শিক্ষকের অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে নগরীর দ্বীপ শিখা স্কুলের ছাত্রী রাহিবা রহমান (১৪) গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন।

নিহত দুজনের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার কাতিয়া গ্রামে। এ ঘটনায় ড্রাইভিং সিটে বসা শাবি শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. আরিফুল ইসলাম ও তার সহযোগী গাড়ির ড্রাইভার আবুল কালাম আজাদও আহত হন। আজাদ হাসপাতালে ভর্তি হলেও আরিফুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়  মেডিকেল সেন্টার থেকে সাময়িক চিকিৎসা নিয়ে এখন পলাতক রয়েছেন।  

আহত গাড়িচালক আবুল কালাম আজাদকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক পর্যন্ত চালকের আসনে আমি নিজেই ছিলাম। কিন্তু সদ্য গাড়িটি কেনা স্যার (অধ্যাপক ড. মো. আরিফুল ইসলাম) আমাকে চালকের আসন ছেড়ে দিতে বলেন। তিনি ক্যাম্পাসের রাস্তাটুকু চালিয়ে যাবেন বলে জানান। তাই আমি পাশে বসাছিলাম আর উনি চালাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি গাড়িটির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন এবং এরপর আর কিছুই আমার মনে নেই।’

ওই শিক্ষক সবেমাত্র গাড়ি চালানো শিখছিলেন বলে নিশ্চিত করেছেন গাড়িচালক আবুল কালাম আজাদ। শনিবার দুপুর ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কিলোরোডে এ ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শী ও জালালাবাদ থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, শিক্ষক আরিফুল ইসলাম ড্রাইভিং  শেখার জন্য চালক আবুল কালামকে নিয়ে সকালে বের হন। ক্যাম্পাসের কিলোরোডে আরিফুল ইসলাম গাড়ি চালানো শেখার সময় ব্রেকের বদলে এক্সিলেটরে চাপ দিলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তিন পথচারীকে ধাক্কা দিয়ে একটি গাছের সঙ্গে গিয়ে গাড়িটি ধাক্কা খায়।

শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখি করতেন আতাউর: কলেজ শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখি করতেন আতাউর রহমান। এ পর্যন্ত প্রায় ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে তার। পত্রিকায়ও লিখতেন নিয়মিত। ড. হুমায়ুন আজাদের লেখার একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন বলে জানান তার পরিচিত নাট্যকর্মী আনোয়ার হোসেন রনি। এই লেখক একজন প্রগতিশীল ঘরানার ব্যক্তি ছিলেন বলে উল্লেখ করেন তিনি। নগরীর মজুমদারি এলাকায় আতাউর রহমানের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বসার ঘরের সেলফে বইয়ের স্তূপ। এরমধ্যে আতাউর রহমানের নিজের লেখা অনেকগুলো বই রয়েছে সেলফে।

তার  লেখা ‘আলোকিত মানুষ’ নামের একটি গ্রন্থের ফ্ল্যাপে লেখক পরিচিতিতে লেখা রয়েছে-‘প্রথাবিরোধী, মননশীলতা এবং প্রগতিশীলতা তার লেখার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। ২০ বছর ধরে কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি লেখালেখি করছেন বলেও লেখা রয়েছে ফ্ল্যাপে।

প্রশাসনের উদাসীনতায় একের পর এক দুর্ঘটনা: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অন্যতম পছন্দের জায়গা কিলোরোড। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই এই রোডে দল বেঁধে হেঁটে যাতায়াত করে। এরকম ব্যস্ত একটা জায়গায় একজন শিক্ষকের ড্রাইভিং শেখার ঘটনায় শিক্ষার্থীরা হতবাক। এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক নিন্দা জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা।

এর আগে কিলোরোডে বেশ কয়েকবার দুর্ঘটনা ঘটলেও খুব বেশি একটা সোচ্চার নয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরেই শুধুমাত্র গতবছরের দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান দেখলে প্রশাসনের দুর্বলতার বিষয়টি ফুটে উঠে। গত বছরের ১৪ই ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে বহিরাগত দুই মোটরসাইকেল আরোহীর ধাক্কায় গুরুতর আহত হন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক মো. রাকিব উদ্দিন। এ ঘটনায় শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ পর্যন্ত করে।

তবে বন্ধ হয়নি বহিরাগত মোটরসাইকেলের ‘কিলোরোডে গতি প্রতিযোগিতা’। ১১ই নভেম্বর মোটরবাইকের ধাক্কায় কিলোরোডে আহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মচারী। প্রায়শই দেখা যায়, ক্যাম্পাসে দলবেঁধে প্রবেশের পর গতি বেড়ে যায় এসব মোটরসাইকেলের। যার ফলে ঘটছে অহরহ দুর্ঘটনা। রাতেরবেলা এক কিলো সড়কের অনেক লাইটই নষ্ট থাকলেও প্রশাসনের উদ্যোগ বলার মতো নয়।

বহিরাগত মোটরবাইক দ্বারা ইচ্ছা করেই ইভটিজিংয়ের মতো বিষয়গুলোও অহরহ ঘটছে এই এক কিলোতে। একই বছর তিন শিক্ষিকা ধারাবাহিক ভাবে তিনদিন মোটরচালিত রিকশা দ্বারা আহত হলে ক্যাম্পাসে মোটরচালিত রিকশা প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ২০১৫ তেই কিলোরোডেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসের ধাক্কায় আহত হন আরেক শাবি ছাত্রী। তবে প্রক্টর কামরুজ্জামান জানালেন অসহায়ত্বের কথা।

তিনি বলেন, মোটরচালিত রিকশা নিষিদ্ধ করা হলেও নিয়ম মানছে না স্বয়ং বিশ্ববিদ্যালয়েরই লোকজন। প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা হলেও মোটরচালিত রিকশা নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে শিক্ষক-শিক্ষিকারাই। নিরাপত্তারক্ষীরা আটকালে ‘আমার তাড়া আছে’ বলে হাতে নিজের একটা কার্ড ধরিয়ে দেন অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকাই। বহিরাগত মোটরবাইক প্রবেশের বিষয়ে প্রক্টর ‘আমরা চেষ্টা করছি এসব থামানোর’ বলে মন্তব্য করেন। -মানবজমিন
২৫ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে