বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০১৬, ০১:০৪:২৮

মতপার্থক্য বাড়ছে, সমাজ ভেঙেছিল পরিবারও ভাঙছে

মতপার্থক্য বাড়ছে, সমাজ ভেঙেছিল পরিবারও ভাঙছে

সমরেশ মজুমদার : এককালে কলকাতায় অনেক ছাত্র বা চাকরিজীবী হোস্টেল বা মেসে থাকতেন। এই মেসজীবন নিয়ে অনেক উপন্যাস-নাটক-ছবি হয়ে গেছে। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিটি বাঙালি কয়েক দশক ধরে দেখেছে এবং হেসেছে।

ইদানীং কি চাকরিজীবীরা মেসবাড়িতে থাকছেন না অথবা থাকলেও তার সংখ্যা কমে গিয়েছে? জানি না কতটা কমেছে কিন্তু এই মুহূর্তে কারও মুখ মনে করতে পারছি না, যিনি মেসে থাকেন। কলকাতায় পড়তে এসে প্রথম পাঁচ বছর আমি হোস্টেলে থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম।

স্কটিশ চার্চ টমোরি মেমোরিয়াল হোস্টেল দারুণ ঝকঝকে ছিল। প্রথম দিন থেকেই একলা ঘরে থেকেছি। ওখান থেকে যেতে হয়েছিল রেসিডেন্স হোস্টেলে। নাক উঁচু মানুষ বলত, ওটা হরি ঘোষের গোয়াল। গ্রে স্ট্রিট আর হরি ঘোষ স্ট্রিটের মোড়ে নিয়মশৃঙ্খলার কড়াকড়ি কম থাকলেও ছাত্ররাই থাকত। তবে তারা বিভিন্ন কলেজের ছাত্র। মিল খুঁজে পাওয়া মুশকিল হতো। সেখান থেকে গেলাম শ্রীগোপাল মল্লিক লেনে বিশ্ববিদ্যালয় হোস্টেলে। ছাত্ররা অবশ্য বলতো, মহেশ্বর দাসের হোস্টেল।

তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ভাষাতত্ত্ব পড়াতেন। থাকতেন হোস্টেলের একদিকে সপরিবার। তাঁর কথা বলার ধরনে একটু মেদিনীপুর-ওড়িশা সীমান্তের উচ্চারণ মিশে থাকত। তাই বোধহয় হোস্টেলের রান্না থেকে বোর্ডারদের সংখ্যায় ওই অঞ্চলের প্রভাব পড়তো। কিন্তু এসব সত্ত্বেও হোস্টেলগুলোতে পড়াশোনার আবহাওয়া ছিল। এমএ পরীক্ষার পর হোস্টেলে থাকতে হলে তখন ল’ কলেজে নাম লেখাতে হতো। আমি সেটা করিনি বলে মেসের সন্ধান নিতে হয়েছিল। আমহারস্ট স্ট্রিটের সিটি কলেজের পাশে ইলিসিয়াম বোর্ডিং নামে একটি মেস ছিল।

মেসের মালিক তথা ম্যানেজার ছিলেন শান্তিবাবু। খুব ফর্সা এবং চর্বিবহুল শরীর ছিল তার। আমাকে কিছু প্রশ্ন করে বললেন, ‘খাওয়ার সময় খেতে আসতে হবে। আগে-পরে এলে ঠাকুর খাবার দেবে না। রাত সাড়ে দশটায় গেট বন্ধ হয়ে যাবে। আর মেসে বসে মদ্যপান করা চলবে না।’ শেষের বাক্যটি শুনে মনে হল একটু মজা করি। বললাম, ‘যদি পেটের ভিতর মদ নিয়ে সাড়ে দশটার আগে ফিরে আসি, তা হলে কি আপত্তি আছে?’

শান্তিবাবু আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি মদ্যপান করো?’

মাথা নেড়ে ‘না’ বললাম। উনি হাসলেন, ‘বাঃ, বেশ রসিক দেখছি। তিন নম্বর ঘর।’

তিন নম্বর ঘরের দরজায় গিয়ে দেখলাম দু’পাশে দুটো তক্তপোশ। একটায় বিছানা পাতা। দ্বিতীয়টা খালি। আমি হোল্ডার খুলে বিছানা পেতে গুছিয়ে বসছি, এ সময় একজন প্রৌঢ় ঘরে ঢুকলেন। তারপর পোশাক বদলে পাজামা গেঞ্জি পরে বিছানার মাঝখানে হেটমুন্ড ঊর্ধ্বপদ হয়ে গেলেন। বুঝলাম এই ঘরে ওর সঙ্গে আমাকে থাকতে হবে। কিন্তু আমাকে দেখেই, কোনো কথা না বলে ওরকম আসন কেন করছেন তা বুঝতে পারলাম না।

মিনিট চারেক ওরকম আসনের পর বাবু হয়ে বসে চোখ বন্ধ করে গান ধরলেন। তারপর যে গান ধরলেন, তা আমি ছেলেবেলায় শুনতে বাধ্য হতাম। বাবা ছিলেন সায়গলের ভক্ত। সময় পেলেই গ্রামফোনে সায়গলের রেকর্ড বাজাতেন। ‘গাঁয়ের বধূ’, ‘রানার’ শোনার পর আমার সায়গলের গান পছন্দ হত না। ভদ্রলোক গান শেষ করলেন। একেবারে সায়গলের গায়কি। তারপর চোখ খুলে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কী কর্ম করেন?’

আমি তখন চাকরি খুঁজছি। সেটাই জানালাম।

‘পিতৃদেবের ভরসায় পৃথিবীতে আছেন?’

কথাটা সত্যি হলেও শুনতে ভালো লাগল না।

ভদ্রলোক আবার পোশাক পাল্টালেন। তারপর বললেন, ‘গুডবাই’।

একটু পরেই শান্তিবাবু ঘরে এলেন, ‘রুমমেটের সঙ্গে আলাপ হল?’

‘হ্যাঁ। তবে কেউ কারও নাম জানি না।’

‘ওর নাম বিমলেশ সরকার। বিয়ে থা করেননি। হোস্টেলের কারও সঙ্গে কথা বলেন না। ইনকাম ট্যাক্সের কেরানি। মাথায় গোলমাল আছে বলে অফিসে না গিয়েও মাইনে পান। ঠিক সময়ে মেসের টাকা দিয়ে যান। আপনাকে বিরক্ত করবে না।’ শান্তিবাবু বললেন।

‘ওর কেউ নেই?’

‘না। তাই সকাল-বিকাল সামনের হূষীকেশ পার্কে বসে গান করেন।’

এসব বিমলেশ বাবুরা তখন ছড়িয়ে ছিলেন পাড়ায় পাড়ায়। কলকাতা থেকে যাদের বাড়ি ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে, তারা শুক্রবারে বিকাল চারটের সময় (অফিস ম্যানেজ করে) ট্রেন ধরে বাড়ি চলে যেতেন। শনি-রবিবার পরিবারের সঙ্গে থেকে ভোরের ট্রেন ধরে মেসে এসে ভাত খেয়ে অফিসে ছুটতেন। দুদিন চারবেলা খেতেন না বলে তাদের কিছু পয়সা ফেরত দেওয়া হত।

এ ধরনের মেসের বোর্ডারদের বলা হতো হপ্তারবাবু। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে তুলসী চক্রবর্তীকে সপ্তাহান্তে এভাবেই গ্রামের বাড়িতে যেতে দেখা গেছে। হোস্টেলে থাকার সময়ে সম্পর্ক তৈরি হতো। অল্পবয়স বলেই বোধহয় সেটা সম্ভব হতো। মেসের বোর্ডারদের মধ্যে সেটা কদাচিত্ থাকে।

মেসে থাকাটা নেহাতই প্রয়োজনের ব্যাপার ছিল। কলকাতা থেকে অনেক কিছুর মতো সেসব উঠে যাচ্ছে। এখন তো ডায়মন্ডহারবার অথবা বর্ধমান থেকে মানুষ ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে কলকাতায় চাকরি বজায় রাখেন। তখন আমি কল্পনাও করিনি কলকাতায় বাড়িভাড়া করে থাকব। বাড়ি ফেরার কথা দূরের গল্প। আগে লিখেছিলাম, ঠাকুরঘর উঠে গিয়েছে। রান্নাঘর উঠব-উঠব করছে। আগে প্রেম করে বিয়ে করতে চাইলে অভিভাবকরা আপত্তি করতেন। ছেলেমেয়েদের সন্তান হওয়ার পর মেনে নিতেন।

তারপর এটা জলভাত হয়ে গেল। এখন সম্বন্ধ করে বিয়ে দেওয়ার চেয়ে ছেলেমেয়েরা নিজেরা বিয়ে করলে অভিভাবকরা খুশি হন। যত দিন এগোচ্ছে তত মতপার্থক্য বাড়ছে, বিয়ে ভাঙছে। সমাজ ভেঙেছিল। পরিবার ভাঙছে। জীবনযাপনের পুরনো রীতিগুলোও পাল্টে যাচ্ছে একের পর এক। যা করলে মানুষ একটু স্বস্তিতে থাকতে পারে, তাই করতে চাইছে। বিডি প্রতিদিন
২৮ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে