বৃহস্পতিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪, ০৭:৩০:১৮

‘সন্তানের দিকে একবার তাকিয়ে ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দেন মা’

‘সন্তানের দিকে একবার তাকিয়ে ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দেন মা’

শাহিনুল আশিক : ‘শীতের সকাল। ঈশ্বরদী-মুলাডুলি সেকশনে রেললাইনের পাশে বাবা-মা রোদে বসে তিন থেকে চার বছরের শিশুর সঙ্গে খেলছেন। বাবা-মা বল ছুড়ছে, আর শিশুটি কুড়িয়ে আনছে। দূর থেকে এটি লক্ষ্য করছি, দিচ্ছি হুইসেলও। 

ট্রেন পার হয়ে চলে যাবে এমন সময় মা-বাবার মধ্যে কেউ একজন বলটি ছুড়ে মারে। বল নিতে ছুটতেই ট্রেনের ধাক্কায় ছিটকে গিয়ে শিশুটির রক্তাক্ত দেহ মায়ের কাছে পড়ে। এমন দুঃখজনক ঘটনায় মনের অজান্তেই কেঁদেছি।’

একান্ত সাক্ষাৎকারে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে গিয়ে এভাবেই বলছিলেন লোকোমাস্টার (ট্রেনচালক) আবুল কালাম আজাদ। এই পেশায় দীর্ঘ ৪২ বছরের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন তিনি।

আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রথম ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনাটি ছিল আত্মহত্যা। তারিখ ও মাস মনে নেই। ২০১০ সালের দিকে ৭২৮ ডাউন রূপসা এক্সপ্রেস ট্রেন নিয়ে খুলনায় যাচ্ছিলাম। আমার সহকারী ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা রিয়াজ উদ্দিন। তিনি অনেক অভিজ্ঞ সহকারী লোকোমাস্টার, অত্যন্ত ভালো মানুষ। 

দর্শনা অতিক্রমের পর লক্ষ্য করি সাইড থেকে এক নারী দৌড়ে আসছে। আর পেছনে পেছনে ছয় বছরের শিশু মা মা বলে ডাকতে ডাকতে ছুটছে। রেললাইনের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে সন্তানের দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে হঠাৎ ট্রেনের ঠিক সামনে ঝাঁপ দেন। মায়ের এমন মৃত্যু দেখে ওই শিশুটা মাটিতে লুটিয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। এ ঘটনার পর দুই দিন কিছু খেতে পারিনি। ট্রেনচালকদের এমন অনেক দুঃখজনক ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে হয়।

আবুল কালাম আজাদ বলেন, ১৯৮২ সালে সৈয়দপুরে প্রথমে চাকরিতে যোগদান করেছিলাম ট্রেড অ্যাপ্রেনটিস হিসেবে। সেখান থেকে ছয় মাস বেসিক ট্রেনিং শেষে পার্বতীপুরে ডিজেল ট্রেডে চলে আসি। এই সময়ে সহকারী লোকোমাস্টার পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে রেলওয়ে। এটাই প্রথম ও শেষ অ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে সহকারী লোকোমাস্টার নিয়োগ। 

সহকারী লোকোমাস্টার পদে এখনও নিয়োগ হয়, তবে অ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে হয় না। সেই সময় বয়স চেয়েছিল ১৬ থেকে ১৯ বছর। শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সেকেন্ড ডিভিশন। রেলস্টেশনের টিকিট কাউন্টার থেকে নির্ধারিত নীল রঙের ফরম কিনে দরখাস্ত করেছিলাম, চাকরি হলো।

আমার চাকরি জীবনে প্রথম পূর্ণ মাসের স্টাইপেন্ড (বেতন) পেয়েছিলাম ৪০২ টাকা ৫০ পয়সা। এএলএম পদে ঢোকার পর প্রথমে রেলওয়ে প্রশিক্ষণ একাডেমিতে তিন মাস জিএস রুলসহ অন্যান্য আইনকানুন সংক্রান্ত ট্রেনিং করি। এরপর পার্বতীপুর ডিজেল লোকো ট্রেনিং সেন্টারে ছয় মাস ইঞ্জিন লোকোমোটিভের যন্ত্রাংশ পরিচিতি, ইঞ্জিন লোকোমোটিভের কার্যক্রম, ট্রাবলশুটিং ইত্যাদি সংক্রান্ত ছয় মাস প্রশিক্ষণ হয়। 

অতঃপর পর্যায়ক্রমে গ্রুপ কটে লালমনিরহাট, বোনারপাড়া, রাজবাড়ী, খুলনা ও সান্তাহার লোকোসেডে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। সমস্ত প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর ১৯৮৬ সালে সান্তাহার লোকোসেডে সহকারী লোকোমাস্টার হিসেবে মূল কর্মজীবন শুরু।

তিনি আরও বলেন, শিক্ষানবিশ কাল শেষে রানিং স্টাফ হিসেবে চাকরি ভালো লাগত না। ট্রেন চালানো পছন্দ হলেও তা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, কষ্টকর আর নানারকম মানসিক যন্ত্রণাদায়ক। তবে দক্ষ ট্রেনচালকদের যোগ্যতা এমন যে তারা রেলওয়ের অনেক পদেই আইনানুসারে চাকরি করতে পারেন। আমিও তাই করেছি। 

আমি একাধারে ফুয়েল চেকার, ফুয়েল ক্লার্ক, সেডম্যান, বুকিং ক্লার্ক, জুনিয়র লোকো ইন্সিফেক্টর, পাওয়ার কন্ট্রোলার ইত্যাদি পদে দীর্ঘদিন অর্থাৎ ২০০০ সাল পর্যন্ত কাজ করেছি। সহকারী লোকোমাস্টার থেকে ২০০৭ সালে লোকোমাস্টার পদে প্রথম প্রমোশন হয়। নানা আইনি জটিলতা নিরসন শেষে ডাবল প্রমোশন হয়। অর্থাৎ সাব লোকোমাস্টার (এসএলএম) পদ ডিঙ্গিয়ে এএলএম থেকে সরাসরি এলএম (লোকোমাস্টার) হই। তারপর চট্টগ্রামের হালিশহরে রেলওয়ে প্রশিক্ষণ একাডেমিতে উন্নতমানের ট্রেনিং হয়েছে।

আবুল কালাম আজাদ বলেন, ওয়েম্যান, গেটম্যান, সিগনালার, স্টেশনমাস্টার, গার্ড ইত্যাদি সকলের কাজ সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা আবশ্যিক ট্রেনচালকদের। এখনো নিয়োগ প্রাপ্তির পর সহকারী লোকোমাস্টার থেকে লোকোমাস্টার হতে সর্বনিম্ন ১০ বছর সময় প্রয়োজন। বিভিন্ন কারণে সহকারী চালক ছাড়া শুধু একা চালক দ্বারা ট্রেন চালানো সম্ভব না। আইনানুযায়ী চালকের যোগ্যতা ক্ষিপ্রতা, নম্রতা, বিনয় আর প্রজ্ঞা। কেননা চালকের সামান্যতম অসতর্কতায় বড় অঘটন  ঘটতে পারে।

তিনি আরও বলেন, একটা দুর্ঘটনার কথা বেশি মনে পড়ে, ঈদের সময়। সুন্দরবন এক্সপ্রেস নিয়ে ঢাকা থেকে ঈশ্বরদীতে যাচ্ছি। বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়েছি। একটা গাড়ি দেখে মনে হলো এটা রেল ক্রসিং করবে। তাকে দেখে হুইসেল দিচ্ছি, আর ব্রেক করছি। তবুও চালক লক্ষ্য করছে না। তখন ট্রেনের গতি ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার। চালক ডান-বামে না তাকিয়ে তার মতো চালাচ্ছে। কারটি রেললাইন পার হওয়ার সময় ইঞ্জিনের বাফারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে খাদে গিয়ে পড়ে। পরে শুনেছি গাড়ির চালকসহ যাত্রীরা মারা গেছে। এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা ছিল।

ট্রেনচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, অনেক সময় দুর্ঘটনার আঁচ পেলে আমরা ট্রেনের গতি কমিয়ে দিই। সিল্কসিটি ট্রেন নিয়ে যাচ্ছি ঢাকায়। হঠাৎ মনে হলো আমার ধীরে ধীরে যাওয়া দরকার। টাঙ্গাইলের আগে একটা কার্ব রেললাইন আছে। তখন ব্রেক করতে করতে যাচ্ছি। গাড়ি একদম স্লো হয়ে গেছে। সামনে দেখছি রেললাইনের ওপরে বাস দাঁড়িয়ে আছে। আর গেটকিপার সবুজ ফ্ল্যাগ নাড়িয়ে আমাকে ক্লিয়ার দিচ্ছে। 

আমি পুরোদমে ব্রেক করে দুই হাত দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। কাছে গিয়ে দেখি যাত্রীবাহী বাস আটকে আছে। তখন গেটকিপারকে জিজ্ঞাসা করলাম কী ঘটনা। তখন সে উল্টাপাল্টা বলতে লাগলো। তখন আমি সহকারীকে নিয়ে ট্রেনে উঠে আবার রওনা দিলাম। 

বাসচালক জানিয়েছিল- লাইনে ট্রেন দেখার পর দ্রুত যেতে গিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে। মর্মান্তিক ঘটনা ছিল। দুর্ঘটনা ঘটলে তখন অনেক মানুষ মারা যেত। আমি ট্রেন ঢাকা নিয়ে যাওয়ার আগেই এই খবর ফেসবুক ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তখন পত্রিকাগুলোর শিরোনাম ছিল, ট্রেনচালকের দক্ষতায় রক্ষা পেল বাসের যাত্রীরা।

তিনি আরও বলেন, টঙ্গীতে এক যুবক আত্মহত্যা করবে বলে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পেরে তাকে দেখে গাড়ি থামিয়ে দিই। পরে লোকজন তাকে ধরে নিয়ে যায়। এমনও অনেক ঘটনা আছে। কোনো লোকোমাস্টার ট্রেনের লাইনে একটা কুকুর দেখলেও বার বার হুইসেল দেন। কাউকে মারতে চায় না।

আবার এমনও হয়েছে, ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন পার হওয়ার পর এয়ারপোর্টে একটা বাঁক আছে। সেদিন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। বাঁক ঘুরেই দেখি দুই ছেলে-মেয়ে ছাতা মাথায় দিয়ে লাইনের ওপরে হাঁটছে। এ সময় তারা বার বার একে অপরকে ছাতা দেওয়া-নেওয়া করছে। আমি হুইসেল দিচ্ছি, তবুও ওদের কানে যাচ্ছে না। 

আমার সহকারী চিৎকার দেয়। ওই চিৎকারটা ছেলের কানে পৌঁছায়। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম ছেলেটা নিচে নেমে গেছে। কিন্তু মেয়েটা ট্রেনে কাটা পড়ে। এই ঘটনায় ছেলেটাই বা কী জবাব দেবে! অনেক সময় চাইলেও কিছু করা যায় না। তবে যতটুকু করা সম্ভব আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি।

আবুল কালাম আজাদ বলেন, কিছু দিন কানে এয়ারফোন দিয়ে রেললাইনে হাঁটা অবস্থায় কাটা পড়ার ঘটনা বেশি ছিল। হুইসেল দিলেও তারা শোনে না। ফলে ট্রেনে কাটা পড়ে। এমন ঘটনা অনেক দিন থেকে বন্ধ রয়েছে। মানুষ সচেতন হয়েছে। 

যাই হোক ট্রেনচালকের চাকরিটা অনেক ঝুঁকির। সিদ্ধান্ত নিতে এক সেকেন্ড বিলম্ব বা তার কম সময়ের মধ্য অঘটন ঘটে। আমাদের রুলে একটা ধারা আছে- চালকের যোগ্যতা। চালককে হতে হবে ক্ষিপ্র, নম্র, বিনয়ী ও প্রজ্ঞাবান। এটা একটা বিশাল যোগ্যতা, যা সব মানুষের থাকে না। এটা দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও দীর্ঘ সাধনার ফল।

আরও একটি ঘটনা, আমি তখন হিলিতে। একজন নারী লবণ নিয়ে যাচ্ছেন। তখন ৫ থেকে ৬ টাকা কেজি লবণের দাম। মালগাড়ি সান্ডিং করছি। গতি খুবই কম ছিল। এ সময় ওই নারী কোলে শিশু (৭ মাস বয়স) ও লবণের বস্তা নিয়ে পার হতে গিয়ে ট্রেনের নিচে পড়ে যায়। ট্রেনের চাকা ওই নারীর কোমরের ওপর দিয়ে চলে যায়। আর লবণগুলো ছিটকে চারপাশে পড়ে যায়। তবে শিশুর কিছু হয়নি। এটা দেখে আমি হাউমাউ করে কান্না করেছি।

ট্রেনে কাটা পড়লে আপনাদের জবাবদিহি করতে হয় কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, রেলপথ সংরক্ষিত এরিয়া। এখানে জবাবদিহিতার কোনো কারণ নেই। নির্ধারিত এরিয়া ছাড়া কেউ রেললাইনের ওপর দিয়ে পার হতে পারবে না। নির্ধারিত জায়গা বলতে অনুমোদিত লেভেল ক্রসিং গেট। তারপরও যদি বড় ধরনের অঘটন ঘটে তখন তদন্ত হয়।

সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয় রাজশাহী রেলওয়ের স্টেশন ম্যানেজার আব্দুল করিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, এসব ঘটনায় ট্রেনচালকের কিছুই করার থাকে না। কিছু দেখলে চালকরা রেললাইন থেকে সরাতে বার বার হুইসেল দেন। অনেক সময় দুর্ঘটনা থেকে অনেকেই বেঁচে যায়। সূত্র: ঢাকা পোস্ট

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে