মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর, ২০২৪, ০৪:১৩:৫৪

মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই স্ত্রী এবং মেয়ের জামাইর কোটি কোটি টাকা অর্জন

মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই স্ত্রী এবং মেয়ের জামাইর কোটি কোটি টাকা অর্জন

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : ছাত্রনেতা থেকে শতকোটিপতি হয়ে উঠেছেন সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রহমান। ফরিদপুর-১ (বোয়ালমারী-মধুখালী-আলফাডাঙ্গা) আসন থেকে ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এই প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা। 

প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই তার সম্পদের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে থাকে। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

তবে, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হওয়ায় ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন পাননি এবং এলাকার রাজনৈতিক প্রভাব থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের শাসনামলের শেষের দিকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। তার শেয়ার ব্যবসার সম্পর্কেও তথ্য পাওয়া গেছে।

মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই তার স্ত্রী এবং মেয়ের জামাইরা কোটি কোটি টাকা অর্জন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে তারা প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং এর সাথে স্বজনপ্রীতির অভিযোগও উঠেছে।

প্রবীণ রাজনৈতিক ও স্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আব্দুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ১৯৬৯ সালে, যখন তিনি নবম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। ১৯৭০ সালে এসএসসি পাস করেন এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয় নেন। স্বাধীনতার পর, ১৯৭২-৭৩ সালে ফরিদপুরের ইয়াসিন কলেজে পড়ালেখার সময় তিনি কলেজ ছাত্র সংসদের এজিএস ও জিএস নির্বাচিত হন।

আশির দশকের শুরুতে তিনি ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক হন এবং ১৯৮৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগে যুক্ত হন। ১৯৮৬ সালে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও পরে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। 

২০০২ সালে ছাত্রলীগ থেকে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে পদোন্নতি পান এবং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচনে ফরিদপুর-১ আসনে এমপি নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৪ সালে দ্বিতীয়বার এমপি নির্বাচিত হন এবং দলীয় পদ হিসেবে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে নিযুক্ত হন। ২০২০ ও ২০২২ সালে শেখ হাসিনা তাকে প্রেসিডিয়াম সদস্য পদে উন্নীত করেন। বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।

অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পরিবার থেকে উঠে আসলেও তার কর্মদক্ষতা ও বক্তৃতার দক্ষতার কারণে তিনি দলের বিভিন্ন পদে উন্নীত হন। তার রাজনৈতিক পদবীর পাশাপাশি তার সম্পদও ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। 'কথার জাদুকর' হিসেবে পরিচিত এ নেতাকে নিয়ে ফরিদপুরে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। তিনি ১৯৫৪ সালের জানুয়ারিতে ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার কামালদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

সম্পদ ও ব্যবসা: আব্দুর রহমান পৈতৃক সূত্রে কিছু জমির মালিক হলেও দলীয় পদে উন্নীত হওয়ার পর এবং এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর তার সম্পদ দ্রুত বাড়তে থাকে। তার স্ত্রী ডা. মির্জা নাহিদা হোসেন বন্যা, যিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডেপুটি রেজিস্ট্রার, তারও প্রচুর সম্পদ রয়েছে। 

ঢাকার পূর্বাচল, ধানমন্ডি, উত্তরা ও পরীবাগে তাদের নামে-বেনামে জমি এবং একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে। তাদের বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে এবং গ্রামের বাড়ির পুরনো একতলা বাসভবনের সামনে নতুন তিনতলা ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। নির্বাচনী এলাকার মধুখালী উপজেলায় গাড়াখোলা জমি, নিজ ইউনিয়ন কামালদিয়ায় বিভিন্ন জমি, এবং বোয়ালমারীর বিভিন্ন স্থানে শতাধিক বিঘা জমি রয়েছে। 'রাজ অটো ব্রিকস' নামের একটি ইটভাটায় লোন নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করা হয়, যার পরিচালক তার মেজ জামাতা জুবায়ের হোসেন নিলয়।

দুদকের অনুসন্ধান ও মামলা: আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাত করে নিজ নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এনেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তিনি দেশ-বিদেশে জমি, গাড়ি ও বাড়ি করেছেন। অভিযোগগুলোর বিষয় তদন্তাধীন রয়েছে। 

সরকার থেকে তাঁর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলেও শোনা যায়, তিনি ৫ আগস্টের পরপরই দেশ ছেড়ে পাশের দেশ বা দেশের বাইরের কোনো রাষ্ট্রে আত্মগোপনে রয়েছেন। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় আব্দুর রহমান তার বার্ষিক আয় ২৮ লাখ ১১ হাজার ৬২৪ টাকা দেখিয়েছিলেন। তিনি ফরিদপুরের মধুখালীর কামালদিয়ায় একটি বাড়ির কথা উল্লেখ করেছেন এবং স্ত্রীর নামে ঢাকায় ৪টি ফ্ল্যাট রয়েছে বলেও উল্লেখ করেছেন। গত ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় ফরিদপুর ও ঢাকায় হত্যার চেষ্টা এবং হত্যার কয়েকটি মামলা সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রহমানের নামে দায়ের করা হয়েছে।

নির্বাচনী এলাকায় নিজের বলয় তৈরি করা: নিজ সংসদীয় এলাকার তিনটি উপজেলায় নিজস্ব বলয় ভারী করার জন্য কর্মীবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন আব্দুর রহমান। এসব বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা, এবং পিছনের সারিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ছিল। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের পর ফরিদপুর-১ আসনে (মধুখালী-বোয়ালমারী-আলফাডাঙ্গা) কোনো সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বাইরে কোনো দলের প্রার্থী নির্বাচিত হতে দেখা যায়নি। 

তাই আওয়ামী লীগের প্রার্থী এমপি হলেও ভিন্নদলের নেতাকর্মীদের তেমন দমন-পীড়ন করতে হয়নি। তবে বিএনপি সহ সমমনা দলের স্থানীয় নেতাকর্মী এবং ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করা হয়েছে। তাদের রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংয়ে পুলিশি বাধা দেওয়া হয়েছে। আবার বিএনপির মধ্যে বিভক্ত থাকায় একটি অংশকে আব্দুর রহমানের সাথে মিলেমিশে থাকতে দেখা গেছে। সারাদেশের ন্যায় এখানেও মামলার ভয়ে বিরোধীপক্ষের প্রথম সারির নেতাকর্মীদের এলাকা ছেড়ে পালিয়ে থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।

অভিযোগ রয়েছে, বোয়ালমারীতে মিয়া ও মৃধা গ্রুপ আওয়ামী লীগে বিভক্তি সৃষ্টি করেছে। মৃধা গ্রুপকে শক্তিশালী করতে গিয়ে আব্দুর রহমান নিজেও সমালোচিত হয়েছেন। আব্দুর রহমানের নাম ভাঙিয়ে তিন উপজেলার স্থানীয় কয়েকজন নেতাকর্মী সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলেন। 

তিনটি উপজেলায় আব্দুর রহমানের ৮-১০ জন ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মী ছিলেন, তাদের মধ্যে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সাবেক মেয়র, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তারা আব্দুর রহমানের ঢাল হিসেবে কাজ করতেন। এসব নেতারা উপজেলা ও ইউনিয়ন নির্বাচন আসলেই মনোনয়ন বানিজ্য, তদবীর এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বানিজ্য করে টাকা কামিয়েছেন। এ অঞ্চলে সব সময় আওয়ামী লীগের মধ্যে সাবেক এমপি আব্দুর রহমানের একটি বিরোধী শিবির সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে।

শুধু নিজ নির্বাচনী এলাকায় নয়, ফরিদপুর সদর আসনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিয়াই সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের পতনের পর আব্দুর রহমানের (কেন্দ্রে থেকে দলীয় দায়িত্বে ছিলেন আব্দুর রহমান) একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। 

জেলা আওয়ামী লীগসহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে বড় একটি অংশ তাঁর কথায় নিয়ন্ত্রিত হতো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতা বলেন, ‘আব্দুর রহমানকে টাকা দিয়ে পদ নেওয়া যেত। তাঁর মধ্যে নগরকান্দা উপজেলার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী কাজী আবদুস সোবহানকে জেলা মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি বানিয়ে কোটি টাকা কামিয়েছেন বলে জেলায় সমালোচনা রয়েছে।’

নিজ ও পরিবারের নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: আওয়ামী লীগ সরকার টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে ফরিদপুর-১ আসনের তিনটি উপজেলায় একচ্ছত্র 'রাজত্ব' কায়েম করেন আবদুর রহমান। তার বিরুদ্ধে দখলদারির অভিযোগ রয়েছে।

তিনি নিজ এবং সন্তানদের নামে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাশে ব্রাহ্মণকান্দায় 'আব্দুর রহমান টেকনিক্যাল কলেজ' ও 'আয়েশা-সামি' জেনারেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। সরকারি জায়গা প্রভাব খাটিয়ে কলেজের নামের অধিকার তিনি লাভ করেন। 

কাদিরদি এলাকায় সরকারি অর্থায়নে গড়ে তোলা একটি কারিগরি কলেজের নাম তার মা ও বাবার নামে করার চেষ্টা চালান। মধুখালী নরকোনা কলাগাছিতে 'আব্দুর রহমান নিম্ন-মাধ্যমিক বিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানে এলাকার অনেক মেধাবী ও মধ্যবর্তী ছেলে-মেয়েদের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। সাতৈর ইউনিয়নের কানখরদীতে প্রায় দুইশো টাকার ব্যয়ে মেয়ের জামাতা জুবায়ের হোসেন নিলয়ের নামে একটি ইটভাটা (রাজ সিরামিক ব্রিকস) নির্মাণের কাজ চলছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সে কাজ বন্ধ রয়েছে।

ছাত্রলীগকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার: বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হওয়ার কারণে আবদুর রহমান ছাত্রলীগের দায়িত্ব পেয়ে ছিলেন। 

২০২০ সালের শেষের দিকে শেখ হাসিনার বিয়াই সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের পতনের পর ফরিদপুর জেলায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতৃত্ব নিয়ে অন্য প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে ভাগাভাগি থাকলেও জেলা, উপজেলা ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে আবদুর রহমানের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। 

তিনি জেলা সদরে কোন কর্মসূচিতে আসলেই শত শত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাকে স্বাগত জানিয়ে বহর নিয়ে সমাবেশস্থলে যেতে দেখা যেত। নিজের নির্বাচনী আসন মধুখালী, বোয়ালমারী ও আলফাডাঙ্গাতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তার হাতিয়ার হয়ে মাঠে কাজ করতেন। বিশেষ করে জেলা ছাত্রলীগ এবং তার নির্বাচনী এলাকার তিন উপজেলার ছাত্রলীগ রোজায় পথচারীদের ইফতার, সেহরি ও কম দামে সবজি বিক্রি করে সুনাম অর্জন করেছিলেন। 

তবে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মীদের কার্যক্রম নিয়ে বিতর্কেও পড়েছিলেন আবদুর রহমান। এই কারণে ছাত্রলীগের ছেলে-মেয়েরা তাকে 'দাদুভাই' বলে ডাকতেন। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মাশতুরা ঐশিকার আবদুর রহমানের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক থাকায় ঐশিকা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। 

ঐশিকার বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে খোদ জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও অতিষ্ঠ ছিলেন। ক্ষমতায় থাকার কারণে ভুক্তভোগী অনেকেই তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পেতেন না। তবে আবদুর রহমানের আমলে নেতাকর্মীদের দিয়ে কোন ক্যাডার বাহিনী, ট্রেন্ডারবাজি ও মাদককারবারীকে আশ্রয়-প্রশয় দিতে দেখা যায়নি।

মন্ত্রী-এমপি থাকাকালে বরাদ্দ বিতরণে স্বজনপ্রীতি: আলোচিত এই আওয়ামী লীগ নেতার নির্বাচনী এলাকায় ভাই-ভাতিজাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই, তবে শ্বশুরবাড়ির শ্যালকদের বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। 

তিনি ভাই-ভাতিজাদের প্রশ্রয় দিতেন না। তার স্ত্রী ডা. মির্জা নাহিদা হোসেনকে ম্যানেজ করে শ্যালকরা তিনটি উপজেলায় থানার দালালি, বিভিন্ন বাণিজ্য করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন এলাকার অনেকেই। 

এছাড়া ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আবদুর রহমান এমপি থাকাকালে আত্মীয়স্বজন ও তার অনুসারীরা সরকারি বরাদ্দের টিআর-জিআরসহ বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা নয়ছয় করে কামিয়েছেন অর্থকড়ি। ২০২৪ সালের দ্বাদশ নির্বাচনের পর এমপিরা একবার বরাদ্দ পেয়েছিলেন। সেই বরাদ্দের ঐতিহাসিক ফান্ডের টাকা নিজ ইউনিয়ন কামালদিয়া, সাতৈর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে বরাদ্দের অধিকাংশ টাকা কিছু ব্যক্তিদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়।

অভিযোগ রয়েছে, নির্বাচন আসলেই আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এবং দলের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য হওয়ার সুবাদে নির্বাচনী এলাকা বাদেও বিভিন্ন জেলা থেকে ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা ও সংসদ সদস্য প্রার্থীরা আবদুর রহমানকে খুশি করার জন্য লাখ লাখ টাকা দিয়ে যেতেন। 

এছাড়া মন্ত্রী হওয়ার পর তার স্ত্রী, জামাই-মেয়েরাসহ শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজনরা মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন এলাকায় সিন্ডিকেট তৈরি করেছিলেন। মন্ত্রী হওয়ার পরে নিজগ্রামের ৫-৬ জনকে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিলেন। আপন ভাই-ভাতিজাদের পাত্তা দেননি এসব কাজে। তবে আবদুর রহমানের আমলে নেতাকর্মীদের দিয়ে কোন ক্যাডার বাহিনী, ট্রেন্ডারবাজি ও মাদককারবারী বা সন্ত্রাসীকে আশ্রয়-প্রশয় দিতে দেখা যায়নি।

মুক্তিযোদ্ধা হওয়া নিয়ে সমালোচনা: আবদুর রহমানের বিরোধী শিবিরের মধুখালী উপজেলার দুই মুক্তিযোদ্ধা নেতা (উপজেলা যাচাই-বাছাইয়ের সদস্য ছিলেন) বলেন, ‘যুদ্ধের সময় আবদুর রহমান নিজ এলাকায় ছিলেন না। 

তার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার প্রশ্নই উঠে না।’ তবে মুক্তিযুদ্ধকালীন তৎকালীন বোয়ালমারী উপজেলার ‘গোহাইলবাড়ি’ মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমার বাড়িসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে বিভিন্ন বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করতো আবদুর রহমান। 

তিনি খরসূতি চন্দ্র কিশোর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৭০ সালে এসএসসি পাশ করেন। আমার সরাসরি ছাত্র ছিলো। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমার কাছে গোহাইলবাড়ি মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে আশ্রয় নেয় আবদুর রহমান। এখান থেকে তাকে ভারতে পাঠানো হয়।’ 

তিনি বলেন, ‘স্থানীয়ভাবে যাচাই-বাছাইয়ের সময় মধুখালী উপজেলা কমিটির ৭ জন সদস্যের মধ্যে ২ জন দ্বিমত পোষণ করেন। দ্বিধাবিভক্ত হয়ে ‘খ’ তালিকা পর্যায় থেকে বিভাগীয় যাচাই-বাছাইয়ের পর মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় আবদুর রহমানকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেট প্রকাশ করেন। যুদ্ধকালীন সময় মধুখালী উপজেলা ছিলো না। 

বোয়ালমারীর আওতায় ছিল ওইসব এলাকা।’ মুক্তিযুদ্ধের সময় আবদুর রহমানের সঙ্গে ভারতে দেখা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন বোয়ালমারী উপজেলার সদ্য সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আব্দুর রশিদসহ কয়েকজন তার (আব্দুর রহমানের) সহযোদ্ধা।

আব্দুর রহমানের নিজ উপজেলা বিএনপির সভাপতি রাকিব হোসেন চৌধুরী ইরান বলেন, ‘আব্দুর রহমানের দ্বারা আমরা বিভিন্ন মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলার শিকার হয়েছি। বছরের পর বছর আমাদের নেতাকর্মীরা ঘরে থাকতে পারেনি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে।’

ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় কৃষকদলের সহসভাপতি খন্দকার নাসিরুল ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী পুলিশের দ্বারা সারাদেশের মতো আমার নির্বাচনী এলাকার বোয়ালমারী, মধুখালী ও আলফাডাঙ্গার বিএনপি নেতাকর্মীরা নির্যাতিত ও লাঞ্চনা-বঞ্চনার শিকার হয়েছে। গত ১৫ বছরে থানা পুলিশ, কোট কাচারী সবই ছিল আওয়ামী লীগের দখলে। ভিন্নমতের নেতাকর্মীরা ঘরে ঘুমাতে পারে নাই। মন খুলে কারো কথা বলার সুযোগ ছিলো না। এই আসনের সাবেক এমপি আবদুর রহমানের ছত্রছায়ায় তিন উপজেলার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ড্রাগ দিয়ে ছয়লাব করে দিয়েছিল। আবদুর রহমান সরকারি জায়গা দখল করে তার বাবা, ছেলে ও মার নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েছে, যা মানুষ ব্যক্তিগত জায়গা দিয়েও করতে পারে না। তিনি গরীব মানুষের জায়গা দখল করে নামমাত্র দাম দিয়ে কিনেছেন। মৎস্যমন্ত্রী হওয়ার পর আবদুর রহমানসহ তার লোকজন চাকরি দেওয়ার কথা বলে কোটি টাকা কামিয়েছেন।

নিজের নামে গত সরকারের শাসনামলে কতগুলো মামলা হয়েছে জানতে চাইলে খন্দকার নাসির বলেন, ‘আমার নামে বিষফোরক, অর্থনৈতিক ও লুটের মামলাসহ অসংখ্য মামলা হয়েছে। ঢাকা কোর্টে হাজিরা দিয়ে বসে আছি, সেই সময় আমার এলাকায় পুলিশ বোমাবাজি করে আমার নামে মামলা দিয়েছে। আবার বিদেশ থেকে এসেই ঢাকার উত্তরা থানা লুটের মামলায় আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সুনাম লুটে নিতে চেয়ে আওয়ামীরা আমাদেরকে ভয়াবহ দানবের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। আমরা উচ্চ আদালতে মামলা করেছি। আমাদের রাজনীতি করতে হবে, নইলে লজ্জা ছাড়া আমাদের থাকতে হবে।’

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে