আবুল কালাম আজাদ : সমাজ ও সংস্কৃতিতে ভাঙনের সুর বাজছে। রাজনীতিতে তার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল অনেক আগেই। সমাজ ও সংস্কৃতিতে এই পরিবর্তনটা বুঝা যায় ধীরে ধীরে। রাজনৈতিক পরিবর্তনটা যত সহজে চোখে পড়ে সেইদিক দিয়ে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনগুলো তত সহজে চোখে পড়ে না।
ভাঙন বলি আর পরিবর্তনই বলি না কেন- এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও অস্থিরতা একটি মূল কারণ। এই বিছিন্নতা বা অস্থিরতা মানুষ মানুষে, মানুষে ও সংস্কৃতিতে, মানুষ ও সমাজে, সমাজে ও সংস্কৃতিতে, সংস্কৃতির সাথে সমাজের, সর্বপরি সামাজিক জীব মানুষের আধুনিকতার চর্চার সাথে সমসাময়িক সমাজ ও সংস্কৃতির দন্দ্ব।
সমাজ ও সংস্কৃতির ভাঙন ও পরিবর্তনকে কি আমরা একভাবে দেখতে পারি? মোটেই না- ভাঙনটা অশুভ, পরিবর্তন হতেই পারে। পরিবর্তনের মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা বহন করে কিন্তু ভাঙন সেটিকে বুঝায় না। ভয়টি সেখানেই, ভাঙন একটি সমাজ ও সাংস্কৃতিকে বিপদে ধাবিত করে আর পরিবর্তন আগের ধারাবাহিকতায় ভবিষ্যৎকে সম্মৃদ্ধ করে। আমরা ভাঙনের দ্বারে দাঁড়িয়ে আছি। পরিবর্তনের দ্বারে হলে কোনো শঙ্কাই ছিল না। ভাঙনটি কিরকম তা একটু সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক।
শিক্ষা ও সংষ্কৃতি একটি সমাজে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে। আমাদের বাঙালি জাতির একটি বিশাল সংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। এই ঐতিহ্য একদিনে সৃষ্টি হয়নি। সেই প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত (আমি আধুনিক কাল বলব না, কারণ আধুনিক শব্দটা আপেক্ষিক। আধুনিকতা যেটি নির্ধারণ করা কঠিন। যদিও অনেকেই তথ্য প্রযুক্তির এই উন্নতির সময়টিকে আধুনিক কাল হিসেবে উল্লেখ করেন) দীর্ঘপথ পরিক্রমায় বাঙ্গালি জাতিসত্ত্বা আপন মহিমায় একটি সমৃদ্ধ অবস্থায় অবস্থান করছে।
বাঙালি জাতি সত্ত্বার প্রকৃত রুপ ও আঙ্গিক থেকে আমাদের বিচ্যুত করার প্রয়াস চলেছে দীর্ঘকাল থেকে। ধর্মীয় মৌলবাদ, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ইত্যাদি বহুবার বাঙালি জাতি সত্ত্বাকে আঘাত করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। কিন্তু বারবার ব্যর্থ হয়েছে। বিভিন্নভাবে বিভিন্ন কৌশলে এই পদ্ধতি কাজ করেছে। সাম্প্রতিক যে কৌশলগুলি লক্ষ্যণীয় সেইগুলি আমাদের তীক্ষ্মভাবে নজরে আনতে হবে।
সমাজ বিজ্ঞানী অধ্যাপক অনুপম সেন চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক এক সেমিনারে বলেছেন সামাজিক জাগরণের কথা। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম এক আলোচনা সভায় সমাজ ভেঙে যাচ্ছে সেই ইঙ্গিত দিয়েছে¦ন। সুতরাং ঋদমানেরা ঠিকই অনুভব করতে পেরেছেন অপশক্তি নতুন কৌশলের। শিক্ষা ও সংস্কৃতি একটি সমাজে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব ফেলে বলছিলাম-আমাদের শিক্ষার যে পদ্ধতি সেটি কিন্তু আমাদের বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতির সমন্বয়ক নয়।
একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, মানুষের জীবন যাত্রার সাথে যেহেতু অর্থনীতির একটি সম্পর্ক রয়েছে সেহেতু দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্ত করাটা সহজ হয়। তাই সেই উপকরণগুলোকে প্রাধান্য দেয়া এবং পৃষ্ঠপোষকতায়ই লক্ষণগুলোর আভাস মিলে, যেমন-শিক্ষায় বেসরকারি বাণিজ্য ও শিক্ষা বানিজ্যের সম্প্রসারণ, শিক্ষাকে সংক্ষিপ্তকরণ এবং বারবার শিক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন ও গবেষণার নামে লক্ষ্যহীন অস্থিরতায় আমরা আমাদের বাঙালিরা মূল জায়গা থেকে সরে যাচ্ছি।
বর্তমানে যে পদ্ধতিতে শিক্ষার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে অর্থাৎ বিভিন্নমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা (বাংলা মাধ্যম, ইংরেজী মাধ্যম ও মাদ্রাসা মাধ্যম ইত্যাদি) যে প্রজন্মকে গঠন করা হচ্ছে সেটি এখন থেকে ৫০ বছর কিংবা তারও পরে এই বাঙালি সমাজকে কঠিন একটি অস্তিত্বের পরিক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। বিশেষ করে ধর্মীয় শিক্ষার নামকরণে বিভিন্ন প্রকার ইসলামী শিক্ষা পদ্ধতি বিষয়টিকে ভাবিয়ে তুলছে।
ক্যাডেট মাদ্রাসা, আধুনিক ইসলামী শিক্ষার ক্ষেত্রে যেসব স্কুল ও মাদ্রাসায় পাঠদান চলছে তাতে এই মুহূর্তে যদি এই কৌশলটির মূল উৎপাটন করা না যায় তাহলে যতই দিন যাবে এর ব্যপ্তি ছড়িয়ে পড়বে এবং শিকড় শক্ত হতে থাকবে পরবর্তীতে চাইলেও সংস্কার করা সম্ভব হবে না। তাই শুরুতেই মূল উৎপাটন করা জরুরি। শিক্ষার সাথে যেহেতু সংস্কৃতির চর্চার ও গভীর সম্পর্ক রয়েছে তাই স্বাভাবিকভাবেই বাঙালির সংস্কৃতির উপরও একটি চ্যালেঞ্জ। বাঙালি সংস্কৃতিকে সজীব রাখতে না পারলে বাঙালি সমাজও পরিবর্তনশীল হয়ে দেখা দেবে।
আমরা চাইনা আমাদের হাজার বছরের সমাজকে পরিবর্তনশীলতার মুখোমুখী দাঁড় করাতে। বাঙালি মুসলমানরা এই ব্যবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়েছেন বহু পূর্বেই। যখন ধর্মীই শিক্ষাই ছিল মুসলমানদের মূল শিক্ষা। তাই নতুন করে পুরানো কায়দাকে আধুনিক কায়দায় অনুপ্রবেশ করতে দেয়া যায় না। এখনই সময় অনুপম সেনের ভাষায় বলতে হবে সমাজ জাগরণের কথা।
সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুুর কুদরাত-–এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রির্পোট অনুসরন করা অতি আবশ্যক। বঙ্গবন্ধু এ বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন এখন থেকে ৪০ বছর পূর্বে। তাই তিনি ভবিষ্যতের কথা ভেবে বাঙালির মূল চেতনায় সমৃদ্ধ একমুখী শিক্ষা পদ্ধতির কথা ভেবেছিলেন। যাতে একটি জাতি একই মন মানসিকতায় একই প্রজম্ম তৈরি হতে পারে। কবি অসীম সাহা বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্রের এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে বুঝতে হলে সর্বোপরি বাঙালিত্বকে ধারণ করতে হবে অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি দুটি শব্দ একই সূতায় বাঁধা।
কবি অসীম সাহার উক্তিতে বুঝা যায় সর্বকালে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি ও বাঙালিত্বের বিকাশের লক্ষ্যে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন প্রথমে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করে। শিক্ষার মাধ্যমেই একটি জাতীকে সঠিক দিক নির্দেশনা স্থাপন করা যায়।
পর্যায়ক্রমে আসা যাক-সমাজ ও সংস্কৃতির আলোচনায়। বর্তমান সমাজে ভাঙনের যে সুর বাজছে সেটির ইঙ্গিত বহু পূর্বেই লক্ষ্যণীয়। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় এই লক্ষণগুলো দ্রুত স্পষ্ট করা যায় যেমন ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্য। ধনীদের হাতে যখন সম্পদ জমা হয়ে যায় তখন দরিদ্র জনগোষ্ঠির মধ্যে একধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। এই অস্থিরতা বেঁচে থাকা কিংবা ধনীদের অবস্থানে নিজেদের অবস্থানে পৌঁছানোর প্রতিযোগিতা।
যার কারণে অপরাধ,অনৈতিকতা , খুন, হত্যার মত অসামঞ্জস্যপূর্ণ অসামাজিক কার্যক্রমে তারা জড়িত হয়ে পড়ে । এই ক্ষেত্রে মানুষ গুলোকে কখনো দায়ী করা সঠিক নয়। দায়ী করতে হবে সমাজ ব্যবস্থাকে অবশ্যই। আবার ধনীরা অত্যাধিক অর্থবিত্তের জৌলষে এক ধরণের মানসিক অস্থিরতায় ভোগে যেসব কারণে তাদের পারিবারিক ভাঙন, পারস্পারিক সম্পর্কের অবনতি সহ নানাবিধ অসঙ্গতিপূর্ণ কাজের মধ্যে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেন।
এই দুই শ্রেণীর মানষিক ও সামাজিক অস্থিরতাই সমাজকে ভাঙনের দিকে ধাবিত করে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা সত্যই আমাদের ভাবিয়ে তোলে তার মধ্যে - কিশোরীর হাতে পিতা-মাতা খুন এবং শিশু রাজনের হত্যাকাণ্ড। একটি সমাজ কতটুকু অধঃপতনের জায়গায় পৌঁছেছে ভাবা যায়? সন্তানের হাতে পিতা-মাতা খুন হচ্ছে আরও একটি শহরের শিক্ষিত পরিবারে।
রাজনের হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে শত শত মানুষের সামনে এবং সকলে তাকিয়ে দেখছে এবং ক্যামেরায় রের্কড করছে। ভাবতে অবাক লাগে মানুষগুলো কি সামাজিক জীব ? সামাজিক নীতি নৈতিকতা ও সচেতনার কতটুক খসে পড়লে এই মন-মানষিকতার সামাজিক হতে পারে! এই ক্ষেত্রে মানুষগুলোকে কোন দোষ দেয়া যায় না। তাদের মগজকে এমনভাবে ধৌত করা হয়েছে তাতে তাদের নৈতিকতা বোধকে হারিয়ে ফেলেছে এবং মানুষত্ববোধ লোপ পেয়েছে।
মগজ ধোলাইয়ের বিষয়টি এত সূক্ষ্মভাবে পরিচালিত হয়েছে যেটি কিনা দীর্ঘদিনের অমানবিক,অনৈতিক,বর্বর, পৈচাশিক কর্মকাণ্ডগুলোকে চর্চার মাধ্যমে মানুষগুলোকে অমানুষে পরিণত করেছে। একটি সুস্থ সমাজে কখনোই এমন চিত্র কাম্য নয়।
সাম্প্রতিক শিশু নির্যাতন ও অপহরণ শিক্ষালয়ে মেয়ে শিশুদের হয়রানি ইত্যাদি থেকেও সামাজিক অসঙ্গতিগুলোকে স্পষ্ট করে। এসব অসঙ্গতির জন্য আমাদের বিকৃত সংস্কৃতির চর্চার একটি প্রভাব রয়েছে কিংবা আকাশ সংস্কৃতিরও, অনিয়ন্ত্রিত সাইবার আসক্তিও কম দায়ী নয়।
আমাদের বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে গনতন্ত্র চর্চা যেমনটি অনুুপয্ক্তু ঠিক তেমনিভাবেই হঠাৎ আকাশ সংস্কৃতিরও অনিয়ন্ত্রত সাইবার আসক্তিও অনুপযুক্ত বলে আমি মনে করি। একজন শিক্ষিত কর্তা যেমন তার পরিবারকে সঠিক পথে দিক-নির্দেশনা দিতে পারে তেমনি একটি দেশের শিক্ষিত জনগণই একটি সমাজকে সঠিক দিক-নির্দেশনা দিতে পারে।
অর্থাৎ শিক্ষার অনুপাতে অপ্রতুলতা এবং অনগ্রসর শিক্ষা, বহুতান্ত্রিক শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যে শুদ্ধ ও সচেতন নাগরিক গঠনে ব্যর্থতার মধ্যেই উপরোক্ত লক্ষণগুলো পষ্ট হয়ে উঠবে স্বাভাবিক। এর জন্য আমাদের প্রথমে শিক্ষা নিশ্চিত ও সুস্থ সংস্কৃতির চর্চার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তবেই অগ্রসর হবে জাতী সঠিক নিয়মে।
সংস্কৃতিকে ঘুণে খেয়ে রেখেছে অনেক আগেই। এখন উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জন্য বিশেষ বিশেষ আঙ্গিক ভেদে সংস্কৃতি চর্চার প্রকাশ পায়। একটি বিষয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে-সমাজের বৃহত্তর একটি অংশ গরিব মানুষ,তাদের সংস্কৃতি চর্চার কোন মাধ্যমকে আমরা স্পষ্ট করতে পারছি না। বস্তাপচা অরুচিকর কিংবা অসামঞ্জস্যপূর্ণ গল্প সমৃদ্ধ কিছু সিনেমা, নাটক এই গরিব মানুষগুলোর জন্য নির্ধারিত। সমাজের এই অংশটি থেকে যে সব শিশু কিশোররা বড় হচ্ছে তারা কি সংস্কৃতির স্পর্শ নিয়ে বড় হচ্ছে সেটা কি আমরা কি কেউ ভেবে দেখেছি?
অনেকের মুখে আমরা শুনে থাকি যে-আগের দিনগুলো ভালো ছিল কিংবা ফেলে আসা দিনগুলি স্বর্ণালী ছিল। যেমন-স্বর্ণালী যুগের চলচিত্র,গান,বিটিভির এক ঘন্টার নাটক সাপ্তাহিক নাটক ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু বিষয়টি হওয়ার দরকার ছিল বিপরীত-ফেলে আসা দিনগুলো থেকে বর্তমান কিংবা আগামী দিনগুলো আরও স্বর্ণালী। এই বিষয়টি থেকে স্পষ্ট যে, আমরা কি সামনের দিকে এগোচ্ছি নাকি সামনের দিক থেকে পেছনের দিকে পিছিয়ে আসছি। আমরা কি সভ্য সমাজের দিকে অগ্রসর হচ্ছি নাকি অসভ্যতা, বর্বরতাকে বহন করে ক্রমশ অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছি?
শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজের সমন্বয় রেখে যে জাতি অগ্রসর হয় সেই জাতি পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। নতুবা শিশুর বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার শিকার হবে, বয়স্করা পরিবারচ্যুত হয়ে পড়বে, নারীদের শিক্ষিত হওয়ার সাথে সাথে ক্রমশ বিবাহ বিচ্ছেদের প্রবণতা বৃদ্ধি, তরুণ-তরুণীদের সাময়িক বন্ধুত্ব গঠন, চ্যাটিং, ডেটিং , ফেসবুকিং ইত্যাদির মত অস্থির, কৃত্রিম সম্পর্কগুলো ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে।
সময়ের দাবি- বাঙালির বাঙালিত্বকে অনুভব করা এবং সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা ও সঠিক শিক্ষায় অগ্রসরমান জাতির মেরুদণ্ড তৈরি করা।
২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম