এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : শনিবার দিবাগত রাতে মুছে ফেলা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষককেন্দ্র (টিএসসি) সংলগ্ন মেট্রোরেলের পিলারে থাকা শেখ হাসিনার গ্রাফিতি তথা ‘ঘৃণাস্তম্ভ’। ঘটনাটি জানাজানি হলে শিক্ষার্থীরা তাৎক্ষণিকভাবে রাজু ভাস্কর্যের পাশের ‘ঘৃণাস্তম্ভের’ সামনে জড়ো হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদের অনুমতি নিয়ে এই কাজ করা হয়েছে- এ তথ্য জানার পর শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করেন। তারা প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করেন।
ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, এদিন রাত আড়াইটা থেকে ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। ‘ঘৃণাস্তম্ভে’ থাকা গ্রাফিতিটি অর্ধেকটা মুছে ফেলা হয়েছিল। পরে ‘ঘৃণাস্তম্ভে’ হাসিনার আরেকটি গ্রাফিতি আঁকা হয়।
শনিবার দিবাগত রাত ২টার দিকে ঘৃণাস্তম্ভটিতে থাকা গ্রাফিতি মুছে ফেলার দৃশ্য চোখে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর। এ সময় তারা গ্রাফিতি মুছে ফেলার কারণ জানতে চান এবং তা বন্ধ করতে বলেন।
পরে ঘটনাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি গ্রুপে পোস্ট করা হয়। গ্রুপে শিক্ষার্থীরা এই গ্রাফিতি মুছে ফেলার প্রতিবাদ জানান।
পরবর্তীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক হাসিব আল ইসলামসহ আরও কয়েকজন ঘটনাস্থলে আসেন। এটি কেন মুছে ফেলা হচ্ছে— এমন প্রশ্ন তোলেন তারা। এর পেছনে কারা জড়িত, কার অনুমতিতে এমনটা করা হচ্ছে, তা তারা জানতে চান।
তখন মেট্রোরেলের পক্ষ থেকে ঘটনাস্থলে থাকা এই কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইউসুফ আহমেদ বলেন, এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতি নেওয়া হয়েছে। এ কথা শুনে শিক্ষার্থীরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এই ঘটনায় প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়। তিনি দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে আসেন।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে প্রক্টর বলেন, গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা যখন মন্ত্রণালয়ের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবি পাঠায়, তখন এখানে থাকা দুটি ছবিও (শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনা) চলে যায়। তাই তারা (মন্ত্রণালয়) প্রশ্ন তোলেন, এখনো এই দুজনের ছবি থাকবে কেন? তাকে বিষয়টি জানানো হলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেট অফিসারকে বলেন। স্টেট অফিসার তখন মেট্রোরেলকে বলে দেন। তাদের (মেট্রোরেল) পক্ষ থেকে লোক পাঠিয়ে এটা মুছে ফেলা হচ্ছিল।
প্রক্টরের এমন মন্তব্যে শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। এটা যে ‘ঘৃণাস্তম্ভ, তা কি প্রক্টর জানতেন না—এমন প্রশ্ন করেন শিক্ষার্থীরা।
তখন স্লোগান ওঠে, ‘বাহ্ প্রক্টর চমৎকার, স্বৈরাচারের পাহারাদার’, ‘খুনি হাসিনার দালালেরা হুঁশিয়ার-সাবধান’, ‘লেগেছেরে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে’, ‘খুনির ছবি মুছল কারা, স্বৈরাচারের দোসর তারা’; ‘জুলাইয়ের চেতনা বৃথা যেতে দেব না’, ‘ঘৃণাস্তম্ভ মুছল কেন, প্রক্টর জবাব চাই’।
উপস্থিত শিক্ষার্থীরা তখন প্রক্টর ও স্টেট অফিসার ফাতেমা বিনতে মোস্তফার পদত্যাগ দাবি করেন।
শিক্ষার্থীদের এমন প্রতিক্রিয়ায় ঘটনাস্থলে প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ভুল তো আমাদেরও হতে পারে।’
প্রক্টর বলেন, প্রয়োজনে এই ভুলের জন্য তিনি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ক্ষমা চাইবেন। তবু যেন শিক্ষার্থীরা তাকে ভুল না বোঝেন। এটা ষড়যন্ত্র নয়, ভুল।
পরে ভোর সাড়ে ৪টার দিকে স্টেট অফিসার ফাতেমা বিনতে মোস্তফাও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তিনি বলেন, ‘সব প্রক্টর জানেন। আমি কিছু বলতে পারছি না।’
এর আগে রাত ৩টার দিকে এ ঘটনা শুনে ঘটনাস্থলে আসেন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন। এসেই তিনি নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
আখতার হোসেন বলেন, ‘আন্দোলনের পর থেকে এটা সারা পৃথিবীতে ‘ঘৃণাস্তম্ভ’ বা হাসিনাকে ঘৃণার প্রতীক। এখানে শিক্ষার্থীদের রক্তের দাগ লেগে আছে। কে বা কারা কোন উদ্দেশ্যে এই রক্তচিহ্ন মুছে দিতে চায়, তা তদন্ত করে বের করে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।’
এদিকে প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ আজ রোববার বলেন, ‘এটি ‘ঘৃণাস্তম্ভ’ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এটার উদ্বোধন করবেন উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সব ধরনের গ্রাফিতি সংরক্ষণ করবে। কেউ মুছে ফেললে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক আবদুল কাদের ও আবু বাকের মজুমদার। তারাও একই কথা বলেন।
আবদুল কাদের প্রশ্ন করেন, প্রক্টর এটার অনুমতি কীভাবে দেন?
বাকের বলেন, ‘আমাদের তিন ছাত্র উপদেষ্টা এটি জেনেছেন এবং তারা এটার নিন্দা জানিয়েছেন।’
ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ফেসবুকে তাৎক্ষণিক পোস্ট দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। তিনি লিখেন, ‘২৪-এর ঘৃণাস্তম্ভ আবার আঁকানো হবে। জুলাইকে মুছে দেওয়া এত সহজ না।’
আরেক পোস্টে উমামা ফাতেমা লিখেছেন, ‘প্রক্টরের পদত্যাগ করতে হবে। এনএসআইয়ের প্রেসক্রিপশন নাকি ‘র’ এর প্রেসক্রিপশন এসব আমি চিনি না। এ সময় প্রশ্ন রেখে তিনি আরও লিখেছেন, কোন সাহসে হাসিনার গ্রাফিতি মোছে?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক আশরেফা খাতুন রোববার সকালে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বলেন, আগের ছবিটাই (গ্রাফিতি) চান। আগের ছবির মতো ঘৃণা আর কোনোটায় প্রকাশ পাবে না। আর যে বা যারা মুছেছেন, সবার খোঁজ চান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সাইয়েদ আব্দুল্লাহ এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে মেট্রোরেলের পিলার থেকে এই গ্রাফিতিটা গতকাল গভীর রাতে মুছে ফেলা হচ্ছিল। খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে গভীর রাতেই অনলাইনে সরব হই আমরা কয়েকজন। ওইটা মোছা হয়ে যাওয়ায় পর কয়েকজন হাসিনার অন্য একটা ক্যারিকেচার আঁকে।
কিন্তু কথাটা হলো, ভিন্নটা কেন করা হবে, আগেরটাই লাগবে। হুবহু আগেরটাই এবং ওইটার ওপরও কালি মেখে, রক্তের মতো লাল রঙ দিয়ে ডা–ই–নি টাইপ ভাইবই রাখতে হবে। আর ওইটাতে যেভাবে জুতার মালা দেওয়া ছিল, ওই একইভাবে রাখতে হবে। মানে হুবহু রিস্টোর করতে হবে।’
তিনি লিখেছেন, ওইটার ভেতর যে মেসেজ ছিল, নতুনটার ভেতর সেটা নাই। গণঅভ্যুত্থানে দেশের জনগণ হাসিনাকে যেভাবে প্রত্যাখ্যান করে উৎখাত করেছিল, সেটার অটো রিপ্রেজেনটেশন ছিল ওইটাতে৷ আর হুটহাট করে যারা এইটা মোছার প্ল্যান করেছিল বা যাদের মাথা দিয়ে এই প্ল্যান বের হয়েছিল, তাদের প্রত্যেককে আইডেন্টিফাই করে কঠোর জবাবদিহির ভেতর নিয়ে আসা উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এই সাবেক ছাত্র লিখেছেন, এই নির্দেশ এসেছিল কোন সংস্থা থেকে? এবং ক্যাম্পাসের ভেতর বড় টেকনিক্যাল ভেহিকেল নিয়ে এসে এই কাজ করা হয়েছে, তার মানে হলো এটার পারমিশনের সঙ্গে ভিসি বা প্রক্টরের অ্যাফিলিয়েশন থাকবার কথা। অর্থাৎ কোনো এজেন্সি থেকে যদি বলা হয় এবং প্রক্টর বা ভিসি যারা এইটা প্রতিরোধ করে নাই, তাদের প্রত্যেককে কঠোর জবাবদিহির ভেতর নিয়ে আসতে হবে।
স্বৈরাচারী হাসিনাকে প্রত্যাখ্যান করার চিহ্নগুলো মুছে দিয়ে এরা কী করতে চায়, সেটা বোঝার দরকার আছে। এবং একইসঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ওই জুতারমালা গলায় দেওয়া প্রত্যাখ্যাত হাসিনার ডা-ই-নি রূপ ফুটিয়ে তোলা দরকার। যতবার মুছতে চাইবে, ততবার আরও বেশি করে সব জায়গায় ফুটিয়ে তুলতে হবে।
সবশেষে তিনি লিখেছেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে এরা প্রথমে গ্রাফিতি মুছতে চাইবে, তারপর দেশের মানুষের মন থেকেই ওই হয়েনাদের অপকর্মের ফিরিস্তি মুছে দিতে চাইবে। কিন্তু আমরা তা হতে দেব না। দেশের জনগণের উচিত সেটা কোনো অবস্থাতেই না হতে দেওয়া।