শনিবার, ০৪ জানুয়ারী, ২০২৫, ১২:০৭:৫৪

শেখ হাসিনার পতন যেভাবে উঠে এলো এবারের পাঠ্যবইয়ে

শেখ হাসিনার পতন যেভাবে উঠে এলো এবারের পাঠ্যবইয়ে

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : ছাত্র-জনতার জুলাই বিপ্লবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নতুন বছরে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ে। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের চালু করা সৃজনশীল শিক্ষাক্রম বাদ দিয়ে চালু করা হয়েছে ২০১২ সালের শিক্ষা কারিকুলাম।

নতুন বছরের প্রথম দিনেই শিক্ষার্থীদের হাতে সীমিত পরিসরে তুলে দেওয়া হয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রণীত নতুন শিক্ষাবছরের পাঠ্যবই। সংশোধিত ও পরিমার্জিত সব বইয়ের অনলাইন ভার্সন পাওয়া যাচ্ছে এনসিটিবির ওয়েবসাইটে। তাতে দেখা গেছে, বিভিন্ন শ্রেণির পরিবর্তিত পাঠ্যপুস্তকে স্থান পেয়েছে ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানের বিভিন্ন গল্প, ছবি, কার্টুন, গ্রাফিতিসহ বিভিন্ন বিষয়। ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে গত ১৫ বছরের রাজনৈতিক অতিকথন ও বন্দনায়। নবম-দশম শ্রেণির বইতে তুলে ধরা হয়েছে শেখ হাসিনার পতনের গল্পও।

এ দুই শ্রেণির বাংলা সাহিত্য বইয়ে স্থান দেওয়া হয়েছে ‘আমাদের নতুন গৌরবগাঁথা’ অধ্যায়। এ অধ্যায়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের গল্প তুলে ধরা হয়েছে এভাবে-

‘সেদিন ৫ আগস্ট ২০২৪- ৩৬শে জুলাই। বাংলাদেশের ক্যালেন্ডার জুলাইতে থেমে গেছে। শুধু দেশ নয় সারা দুনিয়ার মানুষ তাকিয়ে আছে বাংলাদেশের দিকে। আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা এক দফা দাবি পেশ করেছে। সারা দেশ থেকে মানুষ ঢাকায় ছুটছে। ঘেরাও করবে গণভবন। মূলোৎপাটন করবে শাসনক্ষমতা আঁকড়ে থাকা ফ্যাসিবাদী শাসককে। কারফিউ উপেক্ষা করে ঢাকার উত্তরার পথে মানুষের দেখা মিলল। যাত্রাবাড়ীর দিকে মানুষ জড়ো হতে থাকল ধীরে ধীরে। নামল মানুষের ঢল। জনতা গণভবনে পৌঁছে যায় দুপুর নাগাদ। পতন অত্যাসন্ন টের পেয়ে স্বৈরাচার সরকারপ্রধান পালিয়ে যান দেশ ছেড়ে।’

অধ্যায়টিতে আরও বলা হয়, ২০২৪ সালের শুরুতে প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সরকার। উঠে আসে হাসিনা সরকার উৎখাতে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজ- মাদরাসা শিক্ষার্থীদের অবদানের কথাও। সেখানে বলা হয়, সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো বন্ধ করে দেওয়ার পর আন্দোলন কর্মসূচি গতি হারাতে পারতো। কিন্তু বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ ও মাদরাসাশিক্ষার্থীরা তখন ব্যাপকভাবে এগিয়ে আসেন।

‘আমাদের নতুন গৌরবগাঁথা’ অধ্যায়টিতে উঠে এসেছে আওয়ামী লীগের আমলের দীর্ঘ দুঃশাসনের কথাও। সামান্য দাবির কারণে নির্বিচারের নির্যাতন আর গুম-খুন করা হয়েছে- বলে উল্লেখ করা হয়েছে এতে। যুক্ত করা হয়েছে বছরের পর বছর ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুট হওয়ার কথাও।

এতে আরও বলা হয়েছে, সাবেক সরকারের দানবীয় শাসন চালানোর জন্য প্রধান অবলম্বন ছিল মুক্তিযুদ্ধের গল্প। কিন্তু লোকে দেখল, হাজার সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধার জন্ম হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পরে। জাল সনদ সংগ্রহ করে চাকরির সুবিধা নিয়েছে অনেকে। সরকার সব অনিয়ম-অবৈধতাকে ঢেকে দিতে চেয়েছে অবকাঠামোগত ‘উন্নয়নের গল্প’ দিয়ে।

নবম-দশম শ্রেণির বাংলা সাহিত্য ছাড়াও উল্লেখযোগ্য বহু পরিবর্তন এসেছে অন্যান্য শ্রেণির বিভিন্ন পাঠ্যবইয়েও। এর মধ্যে বিশেষভাবে পাঠ্যবই থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত শেখ মুজিববন্দনা। চার নেতার বিবরণীতে স্থান পেয়েছেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেইসঙ্গে স্বাধীনতার ঘোষণায় স্থান পেয়েছেন মেজর জিয়াউর রহমান।

নবম ও দশম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা’ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ২৬ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর তিনি ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আবারও স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

তৃতীয় শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ে ‘আমাদের জাতির পিতা’ অধ্যায়টি বাদ দিয়ে যুক্ত করা হয়েছে ‘আমাদের চার নেতা’। চার নেতার বিবরণীতে তথ্য দেওয়া হয়েছে শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। এই বইয়ে প্রত্যেকের ছবিসহ তাদের সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া জুলাই আন্দোলনে রাজধানীর বাড্ডায় হেলিকপ্টার থেকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করার বিষয়টিও পাঠ্যবইয়ে কার্টুনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। পাঠ্যবইয়ে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে জুলাই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আবু সাঈদ ও মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের আত্মত্যাগের গল্প।

পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ে যুক্ত করা হয়েছে ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’ নামে একটি অধ্যায়। সেখানে দেশের জন্য যুদ্ধ করে শহীদ মীর নিসার আলী তিতুমীর, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, শহীদ মতিয়ুর রহমান মল্লিক, সার্জেন্ট জহুরুল হক, ড. মুহম্মদ শামসুজ্জোহা, নূর হোসেনসহ বিভিন্ন শহীদের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এই অধ্যায়েই সংযোজন করা হয়েছে জুলাই আন্দোলনের শহীদ আবু সাঈদ ও মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের নাম। সেখানে বলা হয়েছে, অধিকারের দাবি ও বৈষম্যের কথা বলতে গিয়ে ২০২৪ সালে রাস্তায় নামেন শিক্ষার্থীরা। সরকারি বাহিনী নির্মমভাবে সেই আন্দোলন দমন করতে চায়। পুলিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রংপুরে ছাত্রনেতা আবু সাঈদ দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়ান। পুলিশ তাকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে। এতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সারা দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, বিশাল গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়। আরও বলা হয়, রাজধানীর উত্তরায় শিক্ষার্থী মুগ্ধ আন্দোলনরত সবাইকে পানি বিতরণ করতে করতে নিহত হন।

ষষ্ঠ শ্রেণির চারুপাঠে ছাপানো হয়েছে ‘কার্টুন, ব্যঙ্গচিত্র ও পোস্টারের ভাষা’ শিরোনামে একটি লেখা। কার্টুনের ছবির মাধ্যমে যে প্রতিবাদ বা বিদ্রোহের প্রকাশ ঘটে, তা দেখানো হয়েছে এই লেখায়। এখানে বলা হয়েছে, ’৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত বারবার কার্টুনে প্রতিবাদের প্রকাশ দেখা গেছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সারা দেশের দেয়ালে দেয়ালে অসংখ্য গ্রাফিতির কথাও বলা হয় এই লেখায়। এই লেখায় কার্টুনের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়ার চিত্র।

সপ্তম শ্রেণির বাংলা বইয়ে যুক্ত করা হয়েছে জুলাই আন্দোলন নিয়ে রচিত ‘সিঁথি’ নামে একটি কবিতা। কবিতায় বলা হয়েছে, ভাই মরলো রংপুরে সেই/ রংপুরই তো বাংলাদেশ। কবিতায় বলা হয়, খোদার আরশ কাঁইপা ওঠে/ শুইনা বাপের হাহাকার/ একটা মানুষ মারার লাগি/ কয়টা গুলি লাগে ছার?

নতুন পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন এবং জুলাই অভ্যুত্থানের বিভিন্ন বর্ণনা উপস্থাপনার বিষয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ২০২৪-এর অভ্যুত্থান ছিল ব্যাপক। স্বৈরাচারবিরোধী এ গণঅভ্যুত্থানে কোমলমতি শিক্ষার্থীরাও অংশ নিয়েছিল। এটি বাংলাদেশের আশাবাদী হওয়ার বড় জায়গা। এই আন্দোলন, অভ্যুত্থান আমরা পাঠ্যবইয়ে স্থান দিয়েছি নতুন প্রজন্মকে উৎসাহ দিতে। রাজনৈতিক অতিকথন ও বন্দনাও বাদ দেওয়া হয়েছে পাঠ্যবই থেকে।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে