সোমবার, ১০ মার্চ, ২০২৫, ১২:৩১:৫৭

টমেটোর কেজি মাত্র ১ টাকা!

টমেটোর কেজি মাত্র ১ টাকা!

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : ক্ষেতে চাষ করা সারি সারি গাছে ঝুলে আছে টমেটো। গাছ থেকে মাটিতে পড়ে নষ্ট হচ্ছে সব। লাখ টাকা বিনিয়োগে এ টমেটোতেই স্বপ্ন পূরণ হওয়ার কথা ছিল চাষিদের। কিন্তু তা এখন দুঃস্বপ্নের কারণ। বিক্রি তো দূরের কথা কোনো রকমে কোথাও ফেলতে পারলেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচেন সুনামগঞ্জের চাষিরা।

চাষের আগে লাভের সম্ভাবনা দেখলেও এখন বিপাকে টমেটো চাষিরা। বাজারে নিয়ে কোনো রকমে কিছু টমেটো বিক্রি করলেও তাতে শ্রমিক ও পরিবহন খরচই উঠছে না। হিমাগার না থাকায় সংরক্ষণ করতে পারছেন না তারা।

জামালগঞ্জ উপজেলার মান্নানঘাট,গজারিয়,কাশীপুর, শরীফপুর, সেলিমগঞ্জ, কালাগুজা,ভুতিয়ারপুর,রামপুর সংবাদপুরসহ ১৫ গ্রামের চাষিরা এখন ক্ষতির সম্মুখীন।

উপজেলার কাশিপুর গ্রামের চাষি আব্দুল কাদির বলেন, ‘গেল বার টমেটো বিক্রি করে বেশ লাভ হয়েছিল। এবারও চাষ করে ছিলাম। প্রতিবিঘা জমিতে চাষবাস থেকে শুরু করে টমেটো চারা সার, সুতলি, বাঁশের খুঁটি কীটনাশক শ্রমিক খরচ সেচসহ ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। তিন বিঘা জমিতে টমেটো চাষ করে  ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা খরচ। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র ১০ হাজার টাকার টমেটো বিক্রি করছি। বাকিগুলো ক্ষেতেই ঝরে পড়ে পচে গলে নষ্ট হচ্ছে। বিশাল ক্ষতি হয়ে গেল।’

 এমন অবস্থার কারণ জানতে চাইলে এই চাষি বলেন, ‘বাজারে ক্রেতা নেই, চাহিদাও নেই। সরংক্ষণের হিমাগার নেই। সড়ক যোগাযোগ ভালো না থাকায় বাইরের জেলা থেকে কোনো পাইকার এসেও মাল কেনে না। এসব কারণে এবার টমেটো চাষ করে আমরা সব চাষিরা মহাবিপদে পড়েছি।’

সংবাদপুর গ্রামের হারুন মিয়া বলেন, ‘এলাকায় বাজারে নিয়ে গেলে প্রতিকেজি টমেটো ২ টাকা কেজি আর স্থানীয় পাইকার ক্ষেত থেকে টমেটো কিনলে ১ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে হয়। ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ করে জমিতে টমেটো চাষ করে এখন মনে হচ্ছে ঋণের দায়ে এলাকা ছাড়তে হবে। ’

একই গ্রামের জহিরুল মিয়া বলেন, ‘গেল ১ মাস ধরে টমেটোর দরপতন চলছে। চাষিরা বস্তা ভরে ইজিবাইক বা ট্রলিতে করে টমেটো বিক্রির জন্য মান্নানঘাট ও গোলকপুর ও গজারিয়া বাজারে পানির দরে টমেটো বিক্রি করেন। প্রতি মণ ৩০ থেকে ৪০ টাকা দরে বিক্রি করে পরিবহন খরচ ও শ্রমিকের মজুরির টাকা না ওঠায় টমেটো বাজারে বিক্রি তো দূরের কথা, ক্ষেত থেকে তোলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন সবাই।’

আরেক চাষি সমছু মিয়া বলেন, ‘বাজারে এক কেজি গরুর মাংসের দাম ৮০০ আর এক মণ টমেটোর দাম বাজারে ৮০, ক্ষেতে ৪০ টাকা। ২০ মণ টমেটো বিক্রি করতে পারলে এক কেজি মাংস কেনা যায়। দেশে কাচামরিচ, টমোটোর ঘাটতি দেখা দিলে সরকার ভারত থেকে আমদানি করে। অথচ হিমাগার না থাকায় আমরা সবজি সংরক্ষণ করতে পারি না। সবজি সংরক্ষণ করতে পারলে ভারত থেকে কাঁচামরিচ টমেটো আমদানি করা লাগতো না।’

কাশিপুর গ্রামের চাষি মঙ্গল মিয়া বলেন, ‘রমজান মাসে বাজারে চাল, ডাল তেল, পেঁয়াজ, রসুন, ছোলা, মাছ, মাংস, সব কিছুর দাম বেশি শুধু সবজির দাম কম। আড়াই মণ টমেটোর দামে এক লিটার তেল কিনতে হয়। এ বছর পানির দামে সবজি বিক্রি করেছেন তাই আগামীতে সবজি চাষের আগ্রহ থাকবে না।’ 

আজিজ নামে আরেক টমেটো চাষি বলেন, ‘মনে হচ্ছে টমেটো চাষ করে বড় কোনো অপরাধ করেছি। নিজের খেতের টমেটো এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। টমেটো চাষ করেছিলাম স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য। অথচ এখন এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে মনে হচ্ছে মানুষকে ফ্রিতে দিলেও টমেটো নিবে না। পাইকারি প্রতি মণ টমেটো বিক্রি করতে হচ্ছে ৪০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজির দাম ১ টাকা করে। আর বাজারে এক কেজি চালের দাম ৬০ টাকা। তার মানে আমি দেড় মণ টমেটো বিক্রি করলে এক কেজি চাল কিনতে পারব।’

ভাটিলালপুর গ্রামের চাষি আব্দুল হালিম বলেন, ‘বন্যা বা অতিবৃষ্টির কারণে দেশে বর্ষাকালীন সবজি নষ্ট হলে আলু, কাঁচামরিচ, টমেটোসহ বিভিন্ন সবজির সংকট দেখা দেয়। তখন পাশের দেশ ভারত থেকে ডলার দিয়ে উচ্চমূল্যে সবজি আমদানি করে চাহিদা পূরণ করে। সবজি আমদানি করতে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়। এ টাকা দিয়ে সুনামগঞ্জে একটি সবজি সংরক্ষণের হিমাগার নির্মাণ করলে ভারত থেকে সবজি আমদানি করতে হতো না।’

সবজি চাষিরা বছরের পর বছর হিমাগার স্থাপনের দাবি জানিয়ে এলেও কোনো সরকার তাদের সমস্যা নিয়ে ভাবছেন না। একমাত্র কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলা ছাড়া সিলেট বিভাগের কোথাও সবজির হিমাগার নেই। এতে সবজি চাষিদের পাশাপাশি সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইকবাল আজাদের দাবি, গেল বার সবজির ভালো দাম পেয়েছিলেন তাই এবার ধানের জমিতে সবজি চাষ করেছেন। তাই বেশি উৎপাদন হয়েছে। তবে আগাম জাতের সবজি চাষ করলে চাষিরা এত সমস্যায় পড়তেন না। তারা একই প্রজাতির হাইব্রিড সবজির চাষ করেছেন তাই সব সব সবজি একসঙ্গে সংগ্রহের উপযোগী হয়ে ওঠেছে। এজন্য কৃষকদের আগাম জাতের সবজি চাষের পরামর্শ দেন তিনি।

সবজি সংরক্ষণাগার স্থাপনের দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, সুনামগঞ্জ বন্যা ও পাহাড়ি ঢল এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা। তাই হিমাগারে নিরবচ্ছিন্ন বিদুৎ সরবরাহ করা কঠিন। বিদ্যুৎ না থাকলে সবজি পচে নষ্ট হবে। তবে চাষিদের অবিক্রিত সবজি সংরক্ষণের জন্য  সিলেটে একটি হিমাগার স্থাপনে প্রকল্প প্রস্তাবনা দেয়া আছে। প্রকল্পটি পাস হলে চাষিরা সবজি সংরক্ষণ করে বাজারে বিক্রি করতে পারবেন।
 
এছাড়াও আগামী মৌসুমে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের প্রণোদনা ও কৃষি উপকরণ দিয়ে সহায়তার আশ্বাস দেন তিনি।

জানা যায়, চলতি বছর জেলায় ২ হাজার ৩৪ হেক্টর জমিতে টমেটো চাষ করা হয়েছে। সুনামগঞ্জ সদরে ১৫০, শান্তিগঞ্জে ১৬৫, দোয়ারাবাজারে ১৭০, বিশম্ভরপুরে ২২০, জগন্নাথপুরে ৭৫, জামালগঞ্জে ৪৭০, তাহিরপুরে ৩১২, ধর্মপাশায় ২৫০, ছাতকে ১৭০,দিরাইয়ে ৫২, শাল্লায় ২৫ হেক্টর জমিতে টমেটো চাষ করেছেন সবজি চাষিরা। সবেচেয় বেশি চাষ হয়েছে জামালগঞ্জে ও সবচেয়ে কম শাল্লা উপজেলায়। 

 

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে