শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৫, ০২:৪৮:৫৯

যে জেলায় এখনো প্রকাশ্যে চলে আ.লীগের কর্মসূচি!

 যে জেলায় এখনো প্রকাশ্যে চলে আ.লীগের কর্মসূচি!

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : দেশের কোথাও প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের কোনো কর্মসূচি পালিত না হলেও একমাত্র বরগুনাতেই নিয়মিত পালিত হয় ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের কর্মসূচি। চলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হটানোর লিফলেট আর ঈদ উপহার বিতরণ। ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনাকে ফেরানোর দাবিতে কয়েকশ লোকের মিছিল হয়েছে সেখানে।

গত বছরের ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন অভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যায়। এরপর থেকে আওয়ামী লীগ কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারে নাই। এমনকি হাসিনার নির্বাচনি এলাকা গোপালগঞ্জেও দলটি প্রকাশ্যে মিছিল মিটিং করতে গিয়ে জনরোষে পড়েছে। কিন্ত বেশ কয়েকদিন ধরে রাজধানীসহ বেশ কিছু জায়গায় দলটি ঝটিকা মিছিল করছে। 

স্থানীয় অনেকের মতে, নেতৃত্বের ধারাবাহিক ব্যর্থতা আর ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলতে গিয়েই এখানে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড ঠেকাতে পারছে না বিএনপি। যে কারণে সদর আসনে কখনোই জিততে পারেনি ধানের শীষ। অবশ্য এই অভিযোগ মানতে নারাজ বিএনপির স্থানীয় নেতারা। আওয়ামী লীগের মামলা-হামলার কারণে এমন অবস্থা হলেও বিএনপি এখন অনেক শক্তিশালী বলে দাবি তাদের।

হাসিনাকে ফেরানোর দাবিতে প্রথম মিছিল : ৫ আগস্টের পর হাসিনাকে ফেরানোর দাবিতে গোপালগঞ্জেরও আগে বরগুনায় প্রথম প্রকাশ্যে মিছিল করে জেলা আওয়ামী লীগ। গত বছরের ৮ আগস্ট জেলা শহরে অনুষ্ঠিত ওই মিছিলে অংশ নেন কয়েকশ নেতাকর্মী। পরে শেরেবাংলা সড়কে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করেন তারা। মিছিল-সমাবেশের পুরোটা সময় কেবল পুলিশ নয়, বিএনপি নেতাকর্মীরাও যেন ছিলেন দর্শক। এখনো সেখানে চলছে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি। ১২ আগস্ট রাতে ভারত থেকে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবিরের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন শেখ হাসিনা। ফোনে কথোপকথনের সেই ভিডিও প্রচার করা হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ভিডিওতে দুর্বার আন্দোলন গড়ার প্রতিশ্রুতি দেন সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির। এবারও চুপ থাকার ভূমিকাতেই থাকে বিএনপি। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া শেখ হাসিনার ফোনালাপের ওই ভিডিও দেখে ফুঁসে ওঠেন অনেকে। শেষ পর্যন্ত ১৪ আগস্ট গ্রেফতার করা হয় জাহাঙ্গীর কবিরকে। রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং চাঁদাবাজির ৩ মামলায় জেলে পাঠানো হয় তাকে। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, মাত্র কদিনের মধ্যেই জামিন পেয়ে যান তিনি। জেলখানা থেকে যখন বেড়িয়ে যাচ্ছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে তাকে আবার গ্রেফতার দেখানো হয় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক এমপি নুরুল ইসলাম মনির ওপর হামলার মামলায়। আদালত অঙ্গনের অনেকের মতে, পুলিশের দুর্বল মামলা আর তার চেয়েও দুর্বল প্রতিবেদনের কারণেই জামিন পেয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। এরপরও বরগুনায় চলছে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড। ফেসবুক লাইভ করে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে বিতরণ হয়েছে ঈদ উপহার। ২৫ মার্চ ব্যাংক কলোনি এলাকার ওই আয়োজনে ছিলেন যুবলীগ নেতা সাবেক কাউন্সিলর তৌহিদ মোল্লা, শ্রমিক লীগের জেলা আহ্বায়ক হালিম মোল্লা, গৌরিচন্না ইউনিয়নের চেয়ারম্যান যুবলীগ নেতা তানভীর সিদ্দিকি, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জাফর হোসেন ও যুবলীগ নেতা বিকাশ সাহাসহ আরও অনেকে। ২৫ মার্চ রাতের ওই আয়োজনের পর ২৬ মার্চ শহিদবেদিতে পুস্পমাল্য দেয় আওয়ামী লীগ। এর আগে তালতলীর আওয়ামী লীগ নেতা ফোরকান ফরাজী প্রধান উপদেষ্টার বিরুদ্ধে একটি গান লিখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাড়লে খুশি হয়ে তাকে ফোনে ধন্যবাদ জানান শেখ হাসিনা। এছাড়া শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা এবং বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের আহ্বান জানিয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি লিফলেট বিতরণ হয় সেখানে। এসব বিষয়ে বিএনপি তো দূরের কথা, পুলিশ প্রশাসনও যেন উদাসীন।

যে কারণে বরগুনায় সবল আওয়ামী লীগ : বহুবছর ধরে বরগুনায় বিএনপির নিয়ন্ত্রণ স্থানীয় মোল্লা পরিবারের হাতে। মূল দলসহ অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতৃত্বেও আছেন তারাই। ওই পরিবারের নজরুল ইসলাম মোল্লা জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। তার চাচাতো ভাই ফিরোজ উজ্জামান মামুন মোল্লা দলের কেন্দ্রীয় সহ-শ্রমবিষয়ক সম্পাদক। একই পরিবারের মাহবুবুল আলম ফারুক মোল্লা জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সদ্য বিলুপ্ত আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক। কমিটি গঠনে দলীয় পদ বিক্রি নিয়ে ওঠা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ওই কমিটি বাতিল করে দেয় কেন্দ্র। নজরুল মোল্লার ভাই জাহিদ মোল্লা জেলা যুবদলের সভাপতি। চাচাতো ভাই নাসিউদ্দিন মোল্লা জেলা শ্রমিক দলের সভাপতি। আরেক চাচাতো ভাই বাবুল মোল্লা কাঁঠালতলী ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। এই মোল্লা পরিবারের বসতবাড়িও কাঁঠালতলী ইউনিয়নে। এছাড়া ফারুক মোল্লার স্ত্রী আফরোজা বুলবুল ছিলেন জেলা মহিলা দলের সাবেক সভাপতি। মোল্লা পরিবারের হাতে বিএনপির নিয়ন্ত্রণ থাকা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠত না যদি সেখানে দল শক্তিশালী হতো। কিন্তু সাংগঠনিক শক্তি শূন্যতে নেমে আসার পাশাপাশি সেখানে যেন সবসময়ই আওয়ামী লীগের দয়া-দাক্ষিণ্যে চলেছে দল। জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, বরগুনা সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি ও জেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রেজভিউল কবির বলেন, ‘এমন একটি পরিবারের হাতে দলের নিয়ন্ত্রণ, যারা দলকে শক্তিশালী করার চেয়ে দলের নাম ভাঙিয়ে সুবিধাই নিয়েছে বেশি। একটি উদাহরণ দিই, তাদের বাড়ির পাশের যে ভোটকেন্দ্র, সেখানেই কখনোই প্রথম হতে পারেনি বিএনপি। বরাবরই জিতেছে আওয়ামী লীগ।’

মোল্লা পরিবারে কেবল বিএনপি নয়, রয়েছে আওয়ামী লীগেরও অনেক প্রভাবশালী নেতা। তারা সবাই আবার একে অপরের আত্মীয়। নজরুল মোল্লার মেয়ের জামাই রাসেল জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও জেলা যুবলীগের বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক। ৫ আগস্টের পর থেকে বিএনপি নেতা শ্বশুরের দেওয়া নিরাপত্তায় আছেন রাসেল। গ্রেফতার তো দূর, একটি মামলাও হয়নি তার বিরুদ্ধে। নজরুল ও ফারুক মোল্লার চাচাতো ভাই লাভলু মোল্লা কাঁঠালতলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। মোল্লা পরিবারের সদস্য বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা মামুন মোল্লার দুই খালাতো ভাইয়ের একজন মনিরুল ইসলাম মনির আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সদ্য সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এবং আরেকজন তানভীর আহম্মেদ সিদ্দিকি জেলা যুবলীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক। জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মন্টু মোল্লার মামা এই মামুন মোল্লা। শেখ হাসিনার সঙ্গে বরগুনার আওয়ামী লীগ নেতাদের ফোনালাপের সময় উপস্থিত ছিলেন মন্টু মোল্লা। কিন্তু ফোনালাপের ঘটনায় হওয়া রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় আসামি করা হয়নি মন্টুকে। অন্য একটি সাধারণ মামলায় গ্রেফতার দেখানোয় মন্টু ছাড়া পেয়ে যান ২/৩ দিনের মধ্যে। বর্তমানে বরগুনায় যারা আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম মন্টু মোল্লা ও তানভীর। বিএনপির একাধিক নেতাকর্মী বলেন, আ.লীগ আমলে এসব নেতার ছায়ায় নিরাপদে থেকেছেন মোল্লা পরিবারের বিএনপি নেতারা। প্রতিদান হিসাবে এখন আবার আ.লীগ নেতাদের নিরাপত্তা দিচ্ছেন তারা।

পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন, সব অস্বীকার বিএনপি নেতাদের : প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে একের পর এক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেলেও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে উল্লেখ করার মতো তেমন কোনো বড় অভিযানের রেকর্ড নেই বরগুনা জেলা পুলিশের। বরং এসব ঘটনায় মামলা করতে গেলে তা না নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। জেলা বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, ‘স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে শেখ হাসিনার ফোনালাপের পর একটি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয় বরগুনায়। এছাড়া দায়ের হয় আরও দুটি চাঁদাবাজির মামলা। এসব মামলা হয় পূর্ববর্তী পুলিশ সুপারের সময়ে। বর্তমান পুলিশ সুপার ইব্রাহিম খলিলের যোগদানের পর থমকে যায় আওয়ামীবিরোধী কার্যক্রম। আওয়ামী লীগের প্রতি তার কোমল মনোভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নিয়ে যাওয়া মামলার আবেদন গ্রহণ করে না পুলিশ। এরকম অন্তত ৩টি ঘটনা ঘটেছে তিনি যোগ দেওয়ার পর।’

বিএনপি নেতাদের এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার ইব্রাহিম খলিল বলেন, ‘মামলা করতে এসে কেউ ফিরে গেছেন-এমন কোনো তথ্য জানা নেই। সবার সব অভিযোগই গুরুত্বের সঙ্গে দেখি আমরা। আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে যা বলা হচ্ছে তার কোনোটি প্রকাশ্য ছিল না। কেউ একজন ঘরের মধ্যে কোনোকিছু ভিডিও করে ছেড়ে দিলে সেটা তো তাৎক্ষণিকভাবে ঠেকানো যায় না। তারপরও ওইসব ভিডিওর সঙ্গে জড়িত অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন। বাকিদের গ্রেফতারেও অভিযান চলছে।’

মোল্লা পরিবারের প্রবীণ ব্যক্তি বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম মোল্লা বলেন, ‘বরগুনায় বিএনপি বলতেই তো মোল্লা পরিবার। ৫ আগস্টের আগে এখানে আর কেউ ছিল বিএনপিতে? যারা এসব বলে, তারা ৫ আগস্টের আগে কোথায় ছিলেন? সামনে জেলা বিএনপির কমিটি হবে। সেই কমিটির পদ-পদবি দখলের জন্য এসব অপপ্রচার ছড়ানো হচ্ছে।’

পরিবারের সদস্যদের আওয়ামী লীগের পদ-পদবিতে থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার চাচাতো ভাই যদি আওয়ামী লীগ করে তো আমি বাধা দেওয়ার কে? আমার মেয়ে আমি বিয়ে দিইনি। সে নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করেছে। আমরা তাদের শেলটার দিই বলে যে অভিযোগ, তা সঠিক না। এসবই আমাদের মোল্লা পরিবারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার। যারা এসব করছেন, ৫ আগস্টের আগে বিএনপির কর্মকাণ্ডে তাদের কোনো অস্তিত্বই ছিল না।’-যুগান্তর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে