তৌহিদুজ্জামান তন্ময় : রাজধানীর আদাবর কাঁচাবাজারে ডিম ব্যবসায়ী সজীবের দোকানে কাজ করতেন সুজন শিকদার (২০)। কয়েকদিন আগে সুজন ভ্যানে ডিম নিয়ে যাওয়ার সময় কিছু ডিম ভেঙে যায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ডিম ব্যবসায়ী সজীব সুজনকে মারধর করেন।
ওই ঘটনায় আদাবরে একটি দোকানে ডিম ব্যবসায়ী সজীব ও তার ভাই রুবেল এবং দোকান কর্মচারী সুজন ও তার মামা ইব্রাহিম শিকদার সালিশে বসেন। সালিশে সজীব উত্তেজিত হয়ে ইব্রাহিমের গালে চড় মারেন। এ নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়। একপর্যায়ে সালিশ শেষ না করেই উঠে চলে যাওয়া ব্যাগ থেকে পিস্তল বের করে ইব্রাহিমকে গুলি করেন সজীব।
স্থানীয় বাসিন্দারা ঘটনার পরই গুলি করা সজীব (৩২) ও তার ভাই রুবেলকে (৩৫) আটক করে মারধর করেন। পুলিশ দুই ভাইকে উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। এই দুই ভাইয়ের কাছ থেকে তিনটি গুলিভর্তি একটি বিদেশি পিস্তল ও একটি মোটরসাইকেল জব্দ করে। তাদের বিরুদ্ধে আদাবর থানায় হত্যা ও অস্ত্র আইনে দুটি মামলা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, আদাবর থানাধীন নবোদয় হাউজিংয়ের ‘এ’ ব্লকের সাত নম্বর সড়কের ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়ার এক নম্বর দোকানে বসে উভয় পক্ষ সালিশ করছিল। সেখানে ৮/১০ জন উপস্থিত ছিলেন। সন্ধ্যা থেকে শুরু হওয়া সালিশ এক ঘণ্টা ধরে চলে।
সালিশে কয়েকবার উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং শেষ পর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতিও হয়। এক পর্যায়ে সালিশ মানেন না, এমন বলে সুজনের মামা ইব্রাহিম উঠে চলে যেতে চান। ইব্রাহিম ২০ গজের মতো দূরত্বে চলা যাওয়া মাত্রই ডিম ব্যবসায়ী সজীব গুলি করেন। এসময় আশপাশে থাকা লোকজন সজীব ও তার ভাই রুবেলকে আটকে মারধর করেন।
পাশের টপ ওয়ান টেইলার্সে কর্মরত মোক্তার আলী ঘটনার সময় দোকানেই ছিলেন। উত্তেজনা দেখে তিনি দোকান থেকে বেরিয়ে আসেন। এরপর দেখেন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় একজন সড়কে পড়ে আছেন। তিনি জানান, নিহত ইব্রাহিম তার টেইলার্সের পাশের ভবনের তৃতীয় তলায় সাবলেট থাকতেন। তিনি পেশায় গাড়িচালক ছিলেন। তার আচার-আচরণ অনেক ভালো ছিল। ভাগনের ডিম ভাঙার সালিশে গিয়ে প্রাণ দিতে হলো এভাবে...। এটা মেনে নেওয়া যায় না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক মুদি দোকানি বলেন, মোহাম্মদপুরে এভাবে গোলাগুলির ঘটনায় আমরা ব্যবসায়ীরা অনেক আতঙ্কের মধ্যে আছি। এতদিন শুধু খবরে দেখেছি গোলাগুলি আর গতকাল পাশের দোকানেই দেখলাম গুলি করে একজন তাজা মানুষকে মাইরা ফেলাইলো। মোহাম্মদপুরের নিরাপত্তা আরও বাড়ানো দরকার।
পুলিশের একটি সূত্র বলছে, ডিম ব্যবসায়ী সজীবের কাছে যে পিস্তলটি ছিল সেটি নতুন চকচকে। হয়তো নতুন কিনেছিল অথবা কারও কাছ থেকে ধার হিসেবে এনেছে। তবে পিস্তলটি দিয়ে একটি গুলিই করেছিল। গুলির লক্ষ্যবস্তু দেখলে মনে হয় হয়তো এর আগেও সজীব গুলি চালিয়েছিল।
ঘটনার দিন রাত ১১টার দিকে সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, যেখানে ইব্রাহিমের মরদেহ পড়ে ছিল সেই সড়কের ওপর, অনেক রক্ত। সড়কের অপর প্রান্তে পড়ে ছিল নিহত ইব্রাহিমের স্যান্ডেল। আর কিছু দূরে সজীব ও তার ভাই রুবেলকে মারধর করা হয় সেখানেও রক্তের দাগ দেখতে পাওয়া যায়।
বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) দুপুরেও সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় অনেক লোকের ভিড়। ঘটনাস্থলে থাকা বেশ কয়েকজন স্থানীয়রা জানান, মানুষের নিরাপত্তা কোথাও নেই। একটা সামান্য ডিম ভাঙার সালিশ থেকে এভাবে গুলির ঘটনা বিরল। এ ঘটনার পেছনে যত বড় শক্তিশালী গোষ্ঠীই থাকুক সবাইকে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।
নিহত ইব্রাহিমের বাড়ি ভোলা জেলার দুলারহাট থানার মুজিবনগরে। তার স্ত্রী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, বিনা দোষে সন্ত্রাসীরা আমার স্বামীকে চিরতরে শেষ করে দিল। তিনি ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। তিন বছরের সন্তান নিয়ে আমি কোথায় যাব, কীভাবে ওদের বড় করব?
মামলার বাদী ও নিহত ইব্রাহিমের বড় ভাই কবির হোসেন শিকদার জানান, ইব্রাহিম তার স্ত্রী লাইজু আক্তার ও তিন বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে নবোদয় হাউজিংয়ের একটি ভবনে ভাড়া থাকতেন। তাদের ভাগনে সুজন শিকদার আদাবর ১৬ নম্বর সড়কসংলগ্ন কাঁচাবাজারে ডিম ব্যবসায়ী সজীবের দোকানে কাজ করতেন। কয়েকদিন আগে সুজন ভ্যানে ডিম নিয়ে আসার সময় কিছু ডিম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সজীব সুজনকে মারধর করেন।
ওই ঘটনা নিয়ে ১৬ জুলাই সন্ধ্যার পর নবোদয় হাউজিংয়ে বায়তুল মামুর মসজিদের কাছে একটি দোকানে সুজন ও রুবেলের সঙ্গে সালিশ বৈঠকে বসেন ইব্রাহিম ও তার স্বজনরা। সালিশের মধ্যে সজীব উত্তেজিত হয়ে ইব্রাহিমের গালে চড় মারেন। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়। একপর্যায়ে সজীব ব্যাগ থেকে পিস্তল বের করে ইব্রাহিমকে গুলি করেন।
আদাবর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম জাকারিয়া জানান, এ ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। একটি হত্যা মামলা অন্যটি অস্ত্র মামলা। হত্যা মামলার বাদী নিহতের ভাই এবং অস্ত্র মামলার বাদী পুলিশ। গুলির ঘটনায় দুজন গ্রেফতার আছেন। অজ্ঞাত আসামিদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
এ বিষয়ে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. ইবনে মিজান বলেন, ডিম ভাঙার সালিশ থেকে তর্কাতর্কি এবং একপর্যায়ে হাতাহাতির ঘটনার পর গুলির ঘটনা ঘটে। এরপর স্থানীয় বাসিন্দারা ঘটনার পরই গুলি করা সজীব ও তার ভাই রুবেলকে আটক করে মারধর করেন। পুলিশ দুই ভাইকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। এই দুই ভাইয়ের কাছ থেকে তিনটি গুলিভর্তি একটি বিদেশি পিস্তল ও একটি মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়। তাদের রিমান্ডে নিয়ে পিস্তলের মালিকানা ও উৎস সম্পর্কে জানতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
দিনের পর দিন মোহাম্মদপুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি কেন হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। প্রত্যেকটি বিট অফিসার নিজ নিজ বিটে নজরদারি রাখছে, চেকপোস্ট ও ব্লকরেইড চলমান। আদাবর ও মোহাম্মদপুর থানার নিয়মিত অভিযানে আসামি গ্রেফতার হচ্ছে। এছাড়া সাদা পোশাকে ডিবি পুলিশও অভিযান পরিচালনা করে, পাশাপাশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও কাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্মানিত রাখার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।- জাগোনিউজ