বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৬:০২:২৮

কমতে কমতে এখন আলুর কেজি মাত্র ১০ টাকা!

কমতে কমতে এখন আলুর কেজি মাত্র ১০ টাকা!

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : আগের মৌসুমের (২০২২- ২০২৩) উচ্চ মূল্য গেল মৌসুমে (২০২৩-২০২৪) কৃষকদের আলুচাষ বাড়াতে উৎসাহিত করেছিল। যার ফলে দেশে আলু উৎপাদনে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি বেসরকারি হিসাবে বলা হয়েছে, গত মৌসুমে ১ কোটি ১৫ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়েছে, যা বার্ষিক ৮০ লাখ টন চাহিদার প্রায় দেড় গুণ। এ কারণেই আলুর দাম ব্যাপকভাবে কমে গেছে বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন এ কৃষিপণ্য সংশ্লিষ্টরা।

চাহিদার অতিরিক্ত আলুর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আগামী মৌসুমে নতুন আলু ওঠার আগে নাও বিক্রি হতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন দেশের উত্তরাঞ্চলের আলুচাষিরা। এ ধারণা থেকে অনেক কৃষক ১০ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করেছেন—যা তাদের উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক কম । আবার যেসব কৃষক ভালো দাম পাবার আশায় বাড়তি খরচে হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করেছেন তারা লাভ তো দূরের কথা, উৎপাদন খরচও তুলতে পারবেন কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।

রংপুর অঞ্চলে কৃষকরা সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রতি কেজি আলুর দাম পেয়েছিলেন ১২-১৩ টাকা। আলু উৎপাদন খরচ ধরা হয়েছিল ১৬-১৭ টাকা প্রতি কেজি, এবং হিমাগারে অতিরিক্ত ছয় টাকা প্রতি কেজি। সুতরাং, একজন কৃষকের মোট খরচ হয় ২৩-২৪ টাকা প্রতি কেজি।

‘১৬-১৮ টাকা খরচে প্রতি কেজি আলু উৎপাদন করে, আমি ফসল তোলার পরপরই ৪০০ ব্যাগ (প্রতিটি ৬০ কেজি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন) ১২-১৩ টাকা প্রতি কেজিতে বিক্রি করতে সক্ষম হয়েছি। প্রায় ৭৫০ ব্যাগ একটি হিমাগারে আছে, কিন্তু বাম্পার ফলনের কারণে আমি আরো ৫৫০ ব্যাগ সংরক্ষণের জায়গা পাইনি, এবং আমাকে প্রতি কেজি সাত টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হতে হয়েছিল, বলেন রংপুর সদরের বাবু খান এলাকার কৃষক গোলাম মোস্তফা (৪৮)। ২০২৪ সালের শেষের দিকে, সরবরাহের চেয়ে চাহিদা বেশি থাকায় তিনি ৭০ থেকে ১৪০ টাকা দরে আলু বিক্রি করেছিলেন।

এরপর তিনি জমি লিজ নেন এবং ২২ একর জমিতে আলু রোপণ করেন, আশা করেন যে, উচ্চমূল্য অব্যাহত থাকবে। গত মৌসুমে তিনি ৩৭০০ বস্তা আলু সংগ্রহ করেছিলেন। আলু সংরক্ষণের জন্য তাকে প্রতি কেজি আলুতে প্রায় ছয় টাকা খরচ করতে হয় এবং বর্তমান বাজারমূল্য দেখে মনে হয় উৎপাদন খরচ তিনি পুষিয়ে অধিক চাষ ও বিপুল নিতে পারবেন না। তার মোট ক্ষতি প্রায় ২.২ লক্ষ টাকা হতে পারে বলে তিনি আগাম ধারণা ব্যক্ত করেন।

কাউনিয়া উপজেলার টেপা মধুপুরের কৃষক কাওসার আলম (৩৮), যিনি ২৬ একর জমিতে আলু চাষ করেছিলেন, তিনি বলেন, কৃষকরা সার ও কীটনাশক কেনার জন্য দোকানদারদের কাছ থেকে পাওনা টাকা পরিশোধ করতে পারবেন না। তিনি বলেন, ফলস্বরূপ, আগামী মৌসুমে অনেক কৃষক আলু রোপণ করবেন না এবং আলু চাষ কমে যাবে। 

তিনি বলেন, সরকার যদি কৃষকদের হিমাগারের জন্য পাওনা টাকা পরিশোধে সহায়তা না করে, তাহলে কৃষকরা অর্থ পরিশোধ করতে পারবেন না এবং হিমাগারের মালিকরাও ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।

রংপুর সদরের কিষাণ হিমাগারের ব্যবস্থাপক মাজেদুল ইসলাম (৪০) বলেন, হিমাগারগুলো আলুতে পূর্ণ ছিল এবং প্রচুর উৎপাদনের কারণে তারা অনেক কৃষকের কাছ থেকে আলু গ্রহণ করতে পারছিলেন না । ‘আমরা ১,৫৩,০০০ ব্যাগ আলু মজুত করেছিলাম, কিন্তু আরো ৩০,০০০ ব্যাগ পেতে পারিনি। আমরা আশঙ্কা করছি যে, পরবর্তী মৌসুম শুরু হওয়ার আগে আলুর মজুত শেষ নাও হতে পারে,' তিনি পর্যবেক্ষণ বর্ণনা করেন।

বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু এই প্রতিবেদককে বলেছেন যে, ৩৩৯টি কোল্ড স্টোরেজে রক্ষিত ৩৫ লাখ টনের মধ্যে মাত্র ৮ লাখ টন বিক্রি হয়েছে। ‘প্রতি কেজি ন্যূনতম মূল্য ২২ টাকা নির্ধারণের সরকারি ঘোষণা উলটো ফল দিয়েছে।' কৃষকরা গুদাম থেকে আলু উদ্ধার করছেন না, কারণ তারা সরকারের ঘোষিত উচ্চ মূল্যের আশা করছেন। ব্যবসায়ীরা কৃষকদের বাড়িতে রাখা মজুত থেকে আলু কিনছেন, যা কম দামে বিক্রি হচ্ছে, যা নষ্ট হওয়ার আগে বিক্রি করতে হবে। 

তিনি বলেন, যে বাজার মূল্য চাহিদা এবং সরবরাহের ওপর নির্ভর করে এবং সরকার যদি সর্বোচ্চ বা সর্বনিম্ন মূল্য নির্ধারণ করে তবে তা কাজ করে না।

তিনি আরো বলেন, যেসব পণ্যে হাজার হাজার উৎপাদক ও ব্যবসায়ীর সম্পৃক্ততা থাকে তার দাম কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না । বাজারে আলুর চাহিদা বৃদ্ধি ও কৃষকের লোকসান সামলাতে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার রেশনে গমের আটা ও চালের পরিমাণ কমিয়ে তদস্থলে আলু বিতরণ করা যেতে পারে বলে পরামর্শ
দেন।।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আসরার চৌধুরী ব্যাখ্যা করেছেন যে, বর্তমানে আলু এবং অন্যান্য কৃষিপণ্যের দাম আগের আবাদ মৌসুমে নেওয়া সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। তিনি বলেন, গত বছর সরবরাহ পর্যাপ্ত না থাকায় আলুর দাম বেশি ছিল। 

তাই কৃষকরা আরো একর জমিতে আলু রোপণ করেছিলেন, আশা করেছিলেন যে, এ বছরও উচ্চ মূল্য অব্যাহত থাকবে। হাজার হাজার কৃষক একই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে আরো বেশি আলু উৎপাদন হয়েছে। এর ফলে এ বছর অতিরিক্ত উৎপাদন হয়েছে এবং আলুর দাম কমেছে। যেহেতু আরো মজুত রয়েছে, তাই মজুতের মালিকরা কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।

অধ্যাপক আসরার বলেন, এ বছর আলুর কম দাম অনেক কৃষককে আলু চাষ থেকে নিরুৎসাহিত করবে, যার ফলে আগামী বছর দাম বেশি হবে। যদি তা হয়, তাহলে সরকারকে সে সময় আলু আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। 

তিনি বলেন, সরকার প্রায়শই দাম নির্ধারণের চেষ্টা করে উদ্বৃত্ত বা ঘাটতির প্রতিক্রিয়া জানায়, কিন্তু এটি অধিকাংশ সময়েই কাজ করে না।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে