এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : প্রাচীনকাল থেকেই প্রাচুর্যের অপর নাম স্বর্ণ। একে বলা হয়, অর্থের সবচেয়ে স্থায়ী রূপ। হাজার বছর ধরে মূল্যবান এই ধাতুর চোখ ধাঁধানো ঔজ্জ্বল্য, দীপ্তি আর চাকচিক্য মানুষকে অভিভূত করে চলেছে।
তাই প্রাচীনকাল থেকেই অন্যান্য ধাতুর চেয়ে স্বর্ণের দাম কয়েকগুণ বেশি। স্বর্ণ দামি বা মূল্যবান; কারণ আমরা সমাজগতভাবে মনে করি, এর মূল্য অতীতে যেমন ছিল, আগামীতেও থাকবে। আর এই প্রয়োজনীয়তা মাথায় রেখে মানুষ স্বর্ণ সঞ্চয় করতে থাকে।
ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয়- দুই পর্যায়েই স্বর্ণ জমিয়ে রাখার প্রবণতা দেখা যায়। কারণ এটি এমন এক বিনিয়োগ যাতে বড় ধরনের লোকসানের আশঙ্কা থাকে না। অর্থনীতির দুর্দিনে মানুষ স্বর্ণ কেনার দিকে ঝুঁকে পড়ে। অর্থের মূল্য ধরে রাখা যায় না, তবে স্বর্ণ কিনে রাখা লাভজনক কারণ এর মূল্য কমার চেয়ে বাড়ার প্রবণতাই বেশি।
সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও স্বর্ণ দীর্ঘদিন ধরেই মূল্য সংরক্ষণের মাধ্যম হিসেবে পরিচিত। তবে সাম্প্রতিক বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও বিশ্ববাজারে চলমান অস্থিরতা স্থানীয় বাজারেও প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। বিনিয়োগকারী ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বহুদিন ধরেই স্বর্ণ ‘নিরাপদ আশ্রয়’ হিসেবে পরিচিত, তবে সম্প্রতি এটিকে অনেকে ‘স্মার্ট ইনভেস্টমেন্ট’ হিসেবেও দেখছেন। তবে স্বর্ণে বিনিয়োগ করতে চাইলে বাজার পরিস্থিতি বুঝে ধাপে ধাপে এগোনো উচিত।
সম্প্রতি ব্যাংক অব আমেরিকার এক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ২০২৬ সালে স্বর্ণের দাম প্রতি আউন্স ৫ হাজার ডলারে পৌঁছাতে পারে, যেখানে গড় দাম থাকবে ৪ হাজার ৪০০ ডলার। ব্যাংকটি উল্লেখ করেছে, স্বল্পমেয়াদে দাম কিছুটা কমতে পারে, তবে আগামী বছরে মূল্যবান এই ধাতুর দাম আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কয়েক বছর আগেও স্বর্ণের প্রতি ভরি ছিল ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার মধ্যে। তবে এরপরই স্বর্ণের দাম বাড়তে বাড়তে আকাশচুম্বি হয়ে যায়। চলতি মাসেই প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ২ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এ অবস্থায় স্বর্ণের বিক্রিও অনেক কমে যায়। স্বর্ণের দাম মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় অনেকেই এই ধাতু কেনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ভবিষ্যতে দাম আরও বেড়ে গেলে হয়তো গ্রাহক আরও কমে যাবে এমন আশঙ্কা থেকে এখানে বিনিয়োগ নিয়েও অনেকেই চিন্তিত হয়ে পড়েন। তবে মঙ্গলবার বিশ্ববাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের বাজারেও স্বর্ণের দামে বড় পতন হয়েছে। হঠাৎ করে স্বর্ণের দামে বড় লম্ফন বা বড় পতনও অনেককে চিন্তায় ফেলেছে। তবে বাজুস বলছে বর্তমান অস্থিরতা স্বর্ণ ক্রেতাদের জন্য তেমন কোনো ঝুঁকি তৈরি করবে না।
বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিংয়ের চেয়ারম্যান ও বাজুস সহ-সভাপতি মাসুদুর রহমান সময় সংবাদকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের চলমান অর্থনৈতিক শাটডাউনই বর্তমানে স্বর্ণের বিশ্ববাজারে অস্থিরতার অন্যতম বড় কারণ। আমেরিকার শাটডাউনের কারণে রিজার্ভ ব্যাংকগুলো ডলারের বদলে স্বর্ণ কিনতে শুরু করে। এই কারণেই স্বর্ণের দাম হঠাৎ করে বেড়ে গিয়েছিল।
‘তবে এরপরই হঠাৎ কেরে বিশ্ববাজারে বড় পতন হয়েছে। এর মূল কারণ হচ্ছে-যেসব বড় বড় প্রতিষ্ঠান এক্সচেঞ্জ ট্রেড ফান্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছিল, তারা মুনাফা তুলে নিচ্ছে।’
স্বর্ণের দাম ঊর্ধ্বগতির ধারা কবে থাকমে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিশ্বে চলমান অস্থিরতা থামলে, স্বর্ণের বিশ্ববাজারের অস্থিরতাও কমে আসবে। যার প্রভাব দেশেও পড়বে। তবে আগের মতো এক লাখ বা দেড় লাখ টাকার পর্যায়ে আর নামবে না; বরং এমন এক ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় থাকবে, যেখানে মানুষ কেনাকাটা করতে পারবে।
বর্তমান অস্থিরতা স্বর্ণ ক্রেতাদের জন্য তেমন কোনো ঝুঁকি তৈরি করবে না বলেও মনে করেন বাজুসের এই কর্মকর্তা। তার মতে, স্বর্ণ কেনা মানে শুধু বিনিয়োগ নয়, এটি নিরাপত্তারও প্রতীক। কেউ বিয়ে বা প্রয়োজনীয় কারণে স্বর্ণ কিনলে তার লোকসানের সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ স্বর্ণ সব সময়ই একটি নিরাপদ ও স্থিতিশীল সম্পদ।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্যের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে ১৪.৫৮ টন স্বর্ণ রিজার্ভে রয়েছে। এই পরিমাণ প্রায় চার বছর ধরে অপরিবর্তিত আছে। মূলত দেশের রিজার্ভের অংশ হিসেবেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এই স্বর্ণ ধরা পড়ছে। সরকার চাইলে এই রিজার্ভের পরিমাণ আরও বাড়াতে পারে, যা দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।
মাসুদুর রহমান বলেন, বিদেশের অভিজ্ঞতা দেখলে দেখা যায়, সেখানে ২৪ ক্যারেট স্বর্ণের বার ও কয়েন কেনা সহজলভ্য। বড় জুয়েলারি শোরুমগুলোতে এগুলো পাওয়া যায় এবং সরকার অনুমোদিতভাবে আমদানি ও বিক্রি হয়। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে পোর্টগুলো ‘ফ্রি পোর্ট’ হিসেবে ঘোষণা করা আছে, অর্থাৎ স্বর্ণ আনতে কোনো বাধা নেই। বিক্রির সময় নির্দিষ্ট ট্যাক্স দিতে হয়। যেমন সৌদি আরবে ১৫ শতাংশ জিএসটি প্রযোজ্য। এভাবেই তারা প্রতিদিন কোটি কোটি ডলার আয় করছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, নতুন ব্যাগেজ বিধিমালা (অপর্যটক যাত্রী ব্যাগেজ বিধিমালা, ২০২৫) অনুসারে, বিদেশফেরত একজন যাত্রী কোনো শুল্ক ছাড়াই বছরে একবার সর্বোচ্চ ১০০ গ্রাম স্বর্ণালঙ্কার আনতে পারেন। তবে একই ধরনের গয়না ১২ পিসের বেশি আনা যাবে না। এ ছাড়া নতুন বিধিমালার আওতায় তোলাপ্রতি ৫ হাজার টাকা শুল্ক দিয়ে একজন যাত্রী বছরে একবার সর্বোচ্চ ১০ তোলা ওজনের একটি স্বর্ণের বার আনতে পারেন।
তবে বাংলাদেশেও যদি ফ্রি পোর্ট সিস্টেম চালু করা হয়, তাহলে স্বর্ণ আনার নিয়ম সহজ ও স্বচ্ছ হবে জানিয়ে মাসুদুর রহমান বলেন, সরকার জানতে পারবে, কে কত স্বর্ণ এনেছে, কোথায় বিক্রি করেছে। এতে সরকারের ট্যাক্স আদায়ও বাড়বে। স্বর্ণ বাজারে ছাড়ার বা এক্সপোর্টের সুযোগ থাকলেও সরকারের কাছে সঠিক হিসাব থাকবে। ফলে অতিরিক্ত রাজস্ব পাওয়া সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
দেশে স্বর্ণকে কমোডিটি এক্সচেঞ্জের আওতায় আনা হলে দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে বলেও মনে করেন বাজুসের এই কর্মকর্তা। তার মতে, বিদেশি মুদ্রা প্রবাহিত হবে, বাজারে স্বচ্ছতা বাড়বে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দুবাই ২০-২৫ বছর আগে কোথায় ছিল, আর আজ স্বর্ণ ট্রেডের মাধ্যমে তারা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। বাংলাদেশও যদি এমন নীতি গ্রহণ করে, স্বর্ণ খাতে দ্রুত উন্নতি করা সম্ভব।’
‘দেশে যেসব জুয়েলারি ব্যবসায়ী আছেন, তারা ডিসি অফিস থেকে ডিলিং লাইসেন্স নিয়ে ব্যাবসা করেন। সরকার চাইলে সকল লাইসেন্সধারীকে স্বর্ণ আমদানির অনুমতি দিতে পারে। এতে কয়েকটি কোম্পানির হাতে লাইসেন্স বন্দি থাকবে না, সিন্ডিকেট তৈরি হবে না। যারা লাইসেন্সধারী, তারা বৈধভাবে বিমানবন্দর দিয়ে ট্যাক্সসহ স্বর্ণ আনতে পারলে, সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের ডলার রিজার্ভও বাড়বে। সরকারের কাছে থাকবে স্পষ্ট ডাটাবেজকে কত স্বর্ণ এনেছে এবং কোথায় বিক্রি করেছে।’
বিদেশের মতোই যদি বাংলাদেশে ইনভেস্টমেন্ট ক্যাটাগরির স্বর্ণ বার বা কয়েন বিক্রি চালু করা হয়, সাধারণ মানুষও নিরাপদভাবে স্বর্ণে বিনিয়োগ করতে পারবে। বর্তমানে এই ব্যবস্থা নেই, তাই মানুষ বিদেশে গিয়ে ট্যাক্স দিয়ে স্বর্ণ কিনছে বলেও জানান মাসুদুর রহমান। তার দাবি, বাংলাদেশে স্বর্ণে বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। তবে তা আরও নিরাপদ ও লাভজনক করতে হলে সরকারকে ফ্রি পোর্ট, কমোডিটি এক্সচেঞ্জ ও ইনভেস্টমেন্ট ক্যাটাগরির বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এতে স্বর্ণ বিনিয়োগকারীর জন্য নিরাপদ হবে এবং দেশের অর্থনীতিকেও শক্তিশালী করবে।