এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে একই দিনে গণভোট এবং জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে আগামী দিনগুলোতে পথ চলবে বিএনপি। সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়—এমন কিছু করবে না দলটি। এর অংশ হিসেবে শালীনতা বজায় রেখে সরকার সম্পর্কে বক্তব্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
দলের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে সংশ্লিষ্টদের এই নির্দেশনা জানিয়েও দেওয়া হয়েছে। এদিকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের দিনক্ষণ নিয়ে সৃষ্ট সংকট নিরসনে জামায়াতে ইসলামীর আলোচনায় বসার আহ্বানকে ‘সঠিক পন্থা’ বলে মনে করছে না বিএনপি। দলটির অভিমত, সমস্যার সৃষ্টি করেছে সরকার এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
কারণ, সনদ বাস্তবায়নে কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে দলগুলোর ঐকমত্যে স্বাক্ষরিত সনদের মিল নেই। বিএনপির ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (দ্বিমত) সনদে লিপিবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা রাখা হয়নি। ফলে সরকারের পক্ষ থেকে দলগুলোকে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসার প্রস্তাবকে এক ধরনের তামাশা বলে মনে করছে বিএনপি।
দলটির অবস্থান হচ্ছে, এটা নিয়ে আলোচনার জন্য সরকার দলগুলোকে ডাকতে পারে এবং ডাকলে তাতে সাড়া দিয়ে বিএনপি তাদের অবস্থান জোরালোভাবে তুলে ধরবে। ঐকমত্য কমিশনে দীর্ঘ আলোচনায় ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ ঐকমত্য হওয়া সংস্কার প্রস্তাবগুলোর ভিত্তিতে স্বাক্ষরিত জুলাই সনদের আইনানুগ বাস্তবায়ন চায় বিএনপি। একই সঙ্গে যথাসময়ে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানও চায় দলটি।
রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার রাতে অনুষ্ঠিত দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এমন আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
রাজনৈতিক দলগুলো গত ১৭ অক্টোবর জুলাই সনদে স্বাক্ষর করলেও এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে মতভেদ রয়ে গেছে। এমন অবস্থায় ২৮ অক্টোবর জাতীয় নির্বাচনের আগে বা নির্বাচনের দিন গণভোট করাসহ জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
তবে জাতীয় নির্বাচনের দিনই সনদের ‘নোট অব ডিসেন্টস’হ গণভোট আয়োজনের দাবিতে অটল রয়েছে বিএনপি। অন্যদিকে, জামায়াতসহ আট দল জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট চায়। বিএনপি ও জামায়াতের এমন বিপরীতমুখী অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার গণভোট ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে যে মতানৈক্য তৈরি হয়েছে, তা দূর করে এক সপ্তাহের মধ্যে সরকারকে সুপারিশ দেওয়ার আহ্বান জানায় অন্তর্বর্তী সরকার। এ সময়ের মধ্যে দলগুলো নিজেরা আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা করে একমত হতে না পারলে সরকার নিজের মতো করে কাজ করবে বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট প্রশ্নে উদ্ভূত সংকট নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচিয়ে যাতে ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়, সে লক্ষ্যে গত বুধবার এক বৈঠক থেকে উদ্যোগী হয় গণতন্ত্র মঞ্চ, এনসিপিসহ ৯ দল। এর পরদিনই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ফোন করে আনুষ্ঠানিক আলোচনার আহ্বান জানান জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের। বিএনপি মহাসচিব তখন দলের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে জানাবেন বলে জানান।
জানা গেছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। নেতাদের মতে, জামায়াত যেহেতু সরকার নয়, তারা রাষ্ট্রীয় কোনো বিষয় নিয়ে বিএনপিকে ডাকতে পারে না। ব্যক্তিগত কোনো দাওয়াতে কিংবা দুই দলের মধ্যকার কোনো বিষয় হলে সেক্ষেত্রে ডাকতে পারে। সুতরাং জামায়াতের আহ্বানকে সংকট নিরসনের ‘সঠিক পন্থা’ বলে মনে করে না বিএনপি। তাই জামায়াতের আহ্বানে তারা সাড়া না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, জামায়াতের পক্ষ থেকে আমাদের আলোচনায় বসার আহ্বান জানানোর প্রস্তাব কি সঠিক? এটি তো রাষ্ট্রীয় বিষয়। তাই জামায়াতের আহ্বানকে আমরা সঠিক মনে করছি না। এ অবস্থায় সরকার আমাদের আলোচনার জন্য ডাকলে ডাকতে পারে, সেক্ষেত্রে আমরা যাব।
কারণ, সমস্যার সৃষ্টি করেছে সরকার এবং ঐকমত্য কমিশন মিলে। তারপরও সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে বলা হয়েছে, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সমঝোতায় পৌঁছাতে এক সপ্তাহ সময় দিলাম। সরকার কি এমন বলতে পারে? এটি কতটা যৌক্তিক, তা জনগণ বোঝে।
এদিকে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি এবং ওই আদেশের ওপর চলতি নভেম্বরের মধ্যেই গণভোট আয়োজন করাসহ পাঁচ দফা দাবি আগামী ১১ নভেম্বরের মধ্যে সরকারকে মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে জামায়াতসহ আট দল। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীতে এক ব্রিফিংয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এ আহ্বান জানিয়ে বলেন, অন্যথায় ১১ নভেম্বর আটটি রাজনৈতিক দলের উদ্যোগে রাজধানীতে মহাসমাবেশ হবে। সেদিন ঢাকার চিত্র ভিন্ন হবে।
জামায়াতের এই আলটিমেটাম নিয়েও আলোচনা হয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে। দলটির নেতারা এর তীব্র সমালোচনা করে বলেন, দেশ যখন নির্বাচনমুখী, তখন এমন কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। একে আগামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন বানচাল বা পেছানোর ষড়যন্ত্র হিসেবেও দেখছেন তারা।
বিএনপি দৃঢ়ভাবে মনে করে, দীর্ঘ আলোচনায় উপনীত ঐকমত্যকে বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ থাকবে এবং কোনোমতেই নিত্যনতুন প্রশ্ন উত্থাপন কিংবা সংকট সৃষ্টি করে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টি করবে না। কারণ, নির্বাচন বাধাগ্রস্ত বা বানচাল হলে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তির পুনরায় ফেরার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
এদিকে ঢাকায় জামায়াতের মহাসমাবেশের পাল্টা হিসেবে বিএনপি কোনো কর্মসূচিতে যাচ্ছে না। কারণ, নির্বাচন সামনে রেখে দেশে কোনো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হোক, বিএনপি সেটা চায় না। তবে স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জনসমর্থন ও সাংগঠনিক সক্ষমতা দেখাতে গতকাল ঢাকাসহ দেশব্যাপী জেলা ও উপজেলা সদরে অনুষ্ঠিত বিপ্লব ও সংহতি দিবসের র্যালি ঘিরে ব্যাপক শোডাউন করেছে বিএনপি।
এদিকে স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে বৃহস্পতিবার রাতে বিএনপির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলো জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে দীর্ঘ ও বিস্তারিত আলোচনা শেষে কিছু বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ যেসব বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং গত ১৭ অক্টোবর ঐতিহাসিক আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে স্বাক্ষরিত হয়েছে, আমরা তার অংশীদার হিসেবে সনদে বর্ণিত সব বিষয়কে ধারণ করি এবং দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী তা বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। বিএনপি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি জুলাই সনদের যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, তার আইনানুগ বাস্তবায়ন এবং যথাসময়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আন্তরিক ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছে।