মুনজের আহমদ চৌধুরী, লন্ডন : অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ করতে যুক্তরাজ্য সরকার তাদের ভিসা ব্যবস্থাকে একটি বিশেষ কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক কূটনীতির প্রেক্ষাপট আমূল বদলে দিয়েছে। আধুনিক ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ব্রিটিশ হোম অফিস সেই সব দেশগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে, যারা নিজেদের নাগরিকদের ফেরত নিতে অসহযোগিতা করছে। বর্তমানে ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো (ডিআরসি) এই কঠোর নিষেধাজ্ঞার মুখে রয়েছে। আশঙ্কার বিষয় হলো, এই উচ্চ-ঝুঁকির শংকার পরবর্তী টার্গেট হতে পারে বাংলাদেশ।
ঢাকার ওপর চাপ এবং ২০২৪ সালের চুক্তি
বাংলাদেশের ওপর এই বিশেষ সম্ভাব্য ব্যবস্থার শঙ্কা পুরোপুরি আকস্মিক নয়। ২০২৪ সালের ১৬ মে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকারের আগ্রহে যুক্তরাজ্য এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটি দ্রুত প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল ব্যর্থ আশ্রয়প্রার্থী এবং ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়া ব্যক্তিদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা। জাতীয়তার স্পষ্ট প্রমাণ থাকলে বাধ্যতামূলক সাক্ষাৎকারের প্রয়োজনীয়তা বাদ দিয়ে এই চুক্তি করা হয়েছিল। তবে ব্রিটেনে বৈধভাবে আসা বাংলাদেশি অ্যাসাইলাম প্রার্থীদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকায় এই অংশীদারিত্ব এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্রিটিশ হোম অফিসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার তালিকায় শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ উঠে এসেছে, যা মোট আবেদনের প্রায় ৬ শতাংশ। গত এক বছরেই ৬৬০০-এর বেশি বাংলাদেশি আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন এবং হাজারো মানুষ অপেক্ষায় রয়েছেন। এমতাবস্থায় ব্রিটিশ সরকার স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় সহযোগিতার গতি আরও বাড়াতে হবে।
এ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার মো. ইকবাল হোসেন রবিবার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যদি বাংলাদেশের ওপর এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা কোনভাবে কার্যকর হয়, তবে তা হবে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। শিক্ষার্থী থেকে কর্মী, ভিজিট ভিসা প্রত্যাশী— সবার ভ্রমণের ওপর এই শংকাজনক বিধিনিষেধ মোকাবিলায় এখনই সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অটুট রেখে ব্যর্থ আশ্রয়প্রার্থীদের সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে সরকারকে অবশ্যই জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে।’
পরবর্তী তালিকায় কোন দেশগুলো
ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাবানা মাহমুদের বর্তমান কৌশলটি মূলত বৈদেশিক নীতির একটি লেনদেনমূলক বিবর্তন। এর যুক্তি -কোনও রাষ্ট্র যদি ব্রিটেনে অবৈধভাবে থাকা তাদের নাগরিকদের ফেরত নিতে অস্বীকার করে, তবে সেই রাষ্ট্রের উচ্চবিত্ত শ্রেণি— অর্থাৎ কূটনীতিক, ব্যবসায়ী এবং পর্যটকরা যুক্তরাজ্যে প্রবেশের বিশেষ সুবিধা হারাবেন। এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থার ধাপগুলো শুরু হয় এক মাসের নোটিশ দিয়ে, যা পরবর্তীতে ফাস্ট-ট্র্যাক ভিসা সেবা বাতিল এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে সব ধরনের ভিসা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার দিকে গড়ায়।
সম্প্রতি অ্যাঙ্গোলা এবং নামিবিয়া শেষ মুহূর্তে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে এই ‘ট্রাম্প-স্টাইল’ নিষেধাজ্ঞা থেকে রক্ষা পেলেও, যুক্তরাজ্যের হোম অফিস ২০২৫ সালের জন্য একটি নতুন ‘ওয়াচ লিস্ট’ বা নজরদারি তালিকা তৈরি করেছে। কঙ্গোর পাশাপাশি পাকিস্তান, ভারত, নাইজেরিয়া এবং মিসরের ওপর কড়া নজর রাখা হচ্ছে।
২০২৪ সালের চুক্তি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এই তালিকায় নিবিড় পর্যবেক্ষণের শংকায় রয়েছে। যদি এই চুক্তির ফলে প্রত্যাবাসনের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে না বাড়ে, তবে ঢাকাকেও কঙ্গোর মতো কঠোর ভিসা জটিলতার মুখে পড়তে হতে পারে।
ব্রিটিশ অভিবাসন কৌশলের কঠোর পরিবর্তন
২০২২ সালের ‘ন্যাশনালিটি অ্যান্ড বর্ডারস অ্যাক্ট’-এর অধীনে প্রাপ্ত ক্ষমতা এবারই প্রথম প্রয়োগ করা হলো। এর মাধ্যমে লেবার সরকার এটিই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, তারা আগের সরকারগুলোর তুলনায় আশ্রয়প্রার্থীদের জট কমাতে অনেক বেশি কঠোর।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাবানা মাহমুদ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি অটল বার্তা দিয়েছেন- হয় নিয়ম মেনে চলতে হবে, না হয় তাৎক্ষণিক পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে। এই পদক্ষেপটি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের কঠোর অভিবাসন নীতিরই প্রতিফলন, যেখানে ভিসাকে সীমান্ত সুরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
গত বছর, যুক্তরাজ্যে রেকর্ড ১,১১,০৮৪ জন আশ্রয়ের আবেদন করেছেন, এবং আবেদনের প্রত্যাখ্যানের হার গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এমতাবস্থায় বহিষ্কারের চাপ এখন আর কেবল অভ্যন্তরীণ নীতি নয়, বরং এটি ব্রিটিশ কূটনীতির নতুন মূলে পরিণত হয়েছে। হোম অফিস যখন তাদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগুলোর মাত্রা বাড়াচ্ছে, তখন বিশ্ব সম্প্রদায় গভীর উদ্বেগের সাথে পর্যবেক্ষণ করছে যে, এই ‘লেনদেনমূলক’ পদ্ধতি কি সত্যিই সীমান্ত সুরক্ষিত করবে, নাকি দীর্ঘদিনের মিত্রদের সাথে যুক্তরাজ্যের কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন ফাটল তৈরি করবে। -বিডি প্রতিদিন