মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০৬:৫২:৩৬

খালেদা জিয়াকে নিয়ে দরবেশের সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হলো

 খালেদা জিয়াকে নিয়ে দরবেশের সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হলো

রোস্তম আলী মন্ডল, বাসস (দিনাজপুর): কৈশোরে খেলার মাঠে বন্ধুদের সাথে খেলার সময় এক অজ্ঞাতনামা দরবেশ খালেদা খানম পুতুলকে ডেকে বলেছিলেন, ‘মা তুই একজন ভাগ্যবতী মেয়ে। দেখিস একদিন তুই রাজরানী হবি।’ এই কথা বলে দরবেশ সেদিন চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু কিশোরী পুতুলের মনে রোপণ করেছিলেন জীবনের অমিত সম্ভাবনার বীজ। 

একজন কিশোরী থেকে যৌবনে পদার্পণ করতে না করতেই তিনি জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন জিয়াউর রহমানকে। বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই তিনি রাজরানী হয়েছেন। খালেদা খানম পুতুল থেকে হয়ে উঠেছেন বেগম খালেদা জিয়া। 

সময়ের পরিক্রমায় তিনি রাজরানী থেকে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি হয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। দেশের দু:সময়ে লড়াই সংগ্রাম করেছেন। জাতির ক্রান্তিলগ্নে দিশা দেখিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। 

আজ বেগম খালেদা জিয়ার প্রয়াণে তাঁরই স্মৃতিবিজড়িত দিনাজপুরের মানুষ শোকে ভাসছেন। শোকে মুহ্যমান তাঁর শৈশবের খেলার সাথি, শিক্ষক, প্রতিবেশী ও আত্মীয়-পরিজন। 

দিনাজপুর শহরের মুদিপাড়ার বাসিন্দা ব্যবসায়ী ইস্কান্দর মজুমদার ও বেগম তৈয়বা মজুমদার দম্পতির তৃতীয় সন্তান খালেদা খানম পুতুল। তিনি ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুরে জন্মগ্রহণ করেন। দিনাজপুর শহরে তাঁর জন্ম। এখানেই কেটেছে তাঁর শৈশব ও কৈশোর। ১৯৬০ সালে তিনি এসএসসি পাশ করেন। সেবছরই তিনি জিয়াউর রহমানের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। শুরু হয় তাঁর জীবনের অবশ্যম্ভাবী ভবিষ্যতের দিকে পথচলা।  

বেগম খালেদা জিয়ার শৈশবের খেলার সাথি দিনাজপুর শহরের সুইহারী মহল্লার বাসিন্দা কামরুন নাহার বেগম বাসসের সাথে স্মৃতিচারণ কালে বলেন, আমার বাবা মরহুম জামিল উদ্দিনের বাড়ি এবং বেগম খালেদা জিয়ার বাবা ইস্কান্দর মজুমদারের বাড়ি শহরের ঈদগা বস্তি এলাকায় পাশাপাশি ছিল। শৈশবে তিনি ছিলেন আমার বড় বোন মাহমুদা বেগমের বান্ধবী। আমরা একসাথে খেলাধুলা ও স্কুলে যাতায়াত করতাম। আমার বড় বোন মাহমুদা বেগম এবং খালেদা আপা দুজন দিনাজপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে একই ক্লাসে পড়াশুনা করতেন। 

কামরুন নাহার খালেদা জিয়ার সাথে শৈশবের স্মৃতিচারণ করে বলেন, শহরের ঈদগা বস্তি মহল্লায় আমাদের বাড়ির পাশে আমরা একদিন খালেদা আপাসহ খেলাধুলা করছিলাম।  সে সময়ে হঠাৎ একজন দরবেশ ওখানে আসেন এবং আমাদের মধ্যে থেকে খালেদা আপাকে কাছে ডেকে নেন। তিনি সেদিন খালেদা আপাকে দেখে বলেন, ‘মা তুই একজন ভাগ্যবতী মেয়ে। দেখিস একদিন তুই রাজরানী হবি।’ 

শহরের সুইহারীতে নিজ বাড়িতে বসে ৭৬ বছর বয়সি কামরুন নাহার বাসসকে বলেন, সেদিন এই কথা বলে দরবেশ বাবা সেখান থেকে চলে গিয়েছিলেন। তাকে আমরা কখনও আর দেখিনি। কিন্তু তার কথাটা আমাদের সবার মনে দাগ কেটেছিল। তিনি জানান, বেগম খালেদা জিয়ার বান্ধবী কামরুন নাহারের বড় বোন মাহমুদা বেগমও ৪ মাস আগে মৃত্যুবরণ করেছেন। 

বেগম জিয়ার আরেক সহপাঠী মরহুম শামসুন্নাহার বেগমের পুত্র অ্যাডভোকেট মোল্লা মো. সাখাওয়াত হোসেন তার মায়ের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়া যখন দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, তখন আমার মা বলেছিলেন, ‘দেখ, ছোট বেলায় সেই দরবেশ বাবার বলে যাওয়া কথাই আজ বেগম খালেদা জিয়ার জীবনে সত্যি হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া শুধু একজন রাষ্ট্রপতির স্ত্রী নন, তিনি এখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন।’

বেগম খালেদা জিয়ার সহপাঠী ও বান্ধবী দিনাজপুর শহরের মিশন রোডস্থ সুরেন্দ্রনাথ শীলের কন্যা ঊষারাণী শীল(৮০) বলেন, আমি এবং খালেদা দিনাজপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে এক সাথে ছোটোবেলা থেকে পড়াশোনা করেছি। ছোটোবেলা থেকেই তিনি একজন ভালো মনের মানুষ ও নিরহংকার ছিলেন। তিনি স্কুলে সবার সাথে মিশতেন এবং সব সময় হাসি-খুশি থাকতেন। তিনি বলেন, ‘সে সময় দিনাজপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের সবচেয়ে সুন্দরী স্কুলছাত্রী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া।’

দিনাজপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষিকা নাজমা ইয়াসমিন বাসসকে বলেন, দিনাজপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে ১৯৫৪ সালে চতুর্থ শ্রেণিতে বেগম খালেদা জিয়া ভর্তি হয়েছিলেন। এই বিদ্যালয় থেকেই ১৯৬০ সালে এসএসসি পাস করেন। বেগম খালেদা জিয়া এই স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন, এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। আমরা তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি। 

দিনাজপুর পৌর শহরের বালুবাড়ি এলাকায় অবস্থিত তৈয়বা ভিলায় গিয়ে দেখা যায়, ভবনটি বর্তমান ‘ন্যাশনাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে দ্বিতীয় তলায় বেগম খালেদা জিয়া এবং তাঁর বাবা-মা যে কক্ষে বসবাস করতেন, ঐ কক্ষগুলো সংরক্ষিত হিসেবে তালাবদ্ধ রয়েছে। এসব কক্ষ রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য কারিনা বেওয়া নামের একজন বৃদ্ধা আছেন। তিনি দীর্ঘদিন খালেদা জিয়ার বাবা-মাকে দেখাশোনা করেছেন। বর্তমান তিনি ওই কক্ষগুলো দেখাশোনা করেন।

বেগম খালেদা জিয়ার শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ৭৮ বছর বয়সি মোস্তা হাসানুর নামে এক প্রতিবেশী বলেন, ‘তৈয়বা ভিলাটি খালেদা (পুতুল) আপার মায়ের নামে নামকরণ করা হয়েছে। আপা আমার থেকে দুই থেকে তিন বছরের বড় হবেন। পাশাপাশি বাড়ি আমাদের। আমি সবসময় তাঁদের বাড়িতে যাওয়া-আসা করতাম। তাঁর বাবা-মা আমাকে অনেক ভালোবাসতেন এবং পুতুল আপাও আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আজ তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি এই শুনে শোকাহত হয়েছি। আল্লাহর কাছে হাত তুলে দোয়া করছি, আপার বেহেশত নসিব হোক।’

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে