বৃহস্পতিবার, ০৫ মে, ২০১৬, ০১:৪৭:৪৭

জামায়াতের শেষ পরিণতি কী?

জামায়াতের শেষ পরিণতি কী?

মাহমুদ আজহার ও শফিকুল ইসলাম সোহাগ: একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে ৯০ বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে জামায়াতের আধ্যাত্মিক গুরু অধ্যাপক গোলাম আযম মারা গেছেন। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামীর চূড়ান্ত রায় আজ। একই অপরাধে দলের শীর্ষ তিন নেতা আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসিও কার্যকর হয়েছে। প্রভাবশালী আরও কয়েক নেতার বিচারও শেষ পর্যায়ে। সারা দেশে দলটির কার্যালয় তালাবদ্ধ। মামলা-হামলায় বিপর্যস্ত নেতা-কর্মীরা এখনো ঘরছাড়া। চরম নেতৃত্ব সংকটে পড়েছে দলটি।

যে কোনো সময় নিষিদ্ধ হয়ে যেতে পারে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ নামে দলটিও। এ ছাড়া জামায়াত সমর্থিত ব্যাংক, বীমা, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও আতঙ্ক বিরাজ করছে। যে কোনো সময় এসব প্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে পড়তে পারে। জানা যায়, জামায়াতের নতুন প্রজন্মের একটি অংশ ’৭১-এর ভূমিকার জন্য ক্ষমা চেয়ে বাংলাদেশের সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় রাজনীতি করার পক্ষে। যুদ্ধাপরাধের দায় থেকে মুক্তি চান তারা।

রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত নিষিদ্ধ হলে নতুন নামে আত্মপ্রকাশের পক্ষেও এ অংশটি। তবে কট্টরপন্থি আরেকটি অংশ চায়, অতীতের কৃতকর্মের জন্য দল ক্ষমা চাইবে না। এজন্য মৃত্যুকে বরণ করে নিতেও তারা প্রস্তুত। তারা ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ নামেই রাজনীতির পক্ষে।

এ প্রসঙ্গে জামায়াতের সিনিয়র কোনো নেতা মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে ঢাকা মহানগরীর দায়িত্বশীল তরুণ নেতা আবদুর রহমান বলেন, তারা আশা করেন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার মতো সিদ্ধান্ত সরকার নেবে না। তার পরও রাজনীতির মাঠে টিকে থাকতে বিকল্প সব পথেই হাঁটছেন তারা। জামায়াত নিষিদ্ধ হলে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ নেই এমন নেতাদের সামনে রেখে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ, জনকল্যাণ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উদারনীতির নতুন দল গঠনের কথা ভাবা হচ্ছে। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড ও তুরস্কের জাস্টিস একে পার্টির ইতিহাস সামনে রাখা হয়েছে।’

১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠার পর তিনবার নিষিদ্ধ হয় জামায়াত। এর মধ্যে ১৯৫৯ ও ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রতিষ্ঠার পর অন্য সব ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে জামায়াতও নিষিদ্ধ হয়। সাত বছর পর জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৯ সালের ২৫ মে আবার প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ পায় জামায়াত। এর পরই ধারাবাহিকভাবে রাজনীতি করে আসছে দলটি। জামায়াত নিষিদ্ধ করার বিষয়টি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, নিষিদ্ধ হলে নতুন নামে রাজনীতির মাঠে নামবে জামায়াত। এই জন্য ভবিষ্যৎ রাজনীতির কথা চিন্তা করে জামায়াতের কেন্দ্র থেকে চারটি নতুন নাম প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে তৃণমূলের নেতাদের কাছে মতামতও চাওয়া হয়েছে। নামগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি), তুরস্কের ক্ষমতাসীন পার্টির নামে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (জেডিপি), ইসলামী জাগরণ দল ও বাংলাদেশ জাগরণ মঞ্চ। তবে জামায়াতের সিনিয়র নেতাদের ক্ষুদ্র একটি অংশ নতুন নামকরণের ঘোরতর বিরোধী। সরকার নিষিদ্ধ করার আগেই নতুন নামকরণ করা হবে, না নিষিদ্ধ করার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনুযায়ী নতুন নামকরণ করা হবে তা নিয়ে নেতাদের মধ্যে মতদ্বৈধতা চলছে বলে জানা গেছে।

সূত্রমতে, দলের দায়িত্ব যাচ্ছে সাবেক শিবির নেতাদের কাছে। নতুন দলের সভাপতি হতে পারেন জামায়াতের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান। আর সাধারণ সম্পাদক হতে পারেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য হামিদুর রহমান আযাদ। এ পদের জন্য ঢাকা মহানগরীর আমির রফিকুল ইসলাম খানের নামও শোনা যাচ্ছে। অন্যান্য পদের নেতাদের দায়িত্ব বণ্টনের কাজ চলছে।

জানা গেছে, দু-এক জন ব্যতিক্রম ছাড়া জামায়াতের ষাটোর্ধ্ব নেতারা নতুন দলের নেতৃত্বে থাকবেন না। তারা মূল দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীতেই থেকে যাবেন। তবে তারা প্রকাশ্য রাজনীতি করবেন না। মূলত এসব নেতা গোপনে জামায়াতের দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। নেপথ্যে থেকে নতুন দলকে পরিচালনায় ভূমিকা রাখবেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দলের নেতাদের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক এড়াতে বয়সভিত্তিক এই শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জামায়াতের সিনিয়র এক নেতা বলেন, ‘দল নিষিদ্ধ হলে নতুন নাম কী হবে তা এখনো ঠিক হয়নি। তবে নীতিনির্ধারক মহল থেকে চারটি নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। সেখান থেকে নতুন নামকরণ হবে। নেতৃত্বে কারা আসবেন তাও চূড়ান্ত হয়নি।’

বিগত ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত জামায়াত নেতা-কর্মীদের কর্মকাণ্ড দৃশ্যমান ছিল। বিগত আন্দোলনে জ্বালাও-পোড়াওসহ বিভিন্ন নাশকতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা। দেশ-বিদেশে এ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে যুদ্ধাপরাধের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ থাকা এ দলটি। নির্বাচনের পরই আত্মগোপনে চলে যায় জামায়াত-শিবির। এর মধ্যে দু-এক বার হরতাল দিয়েও মাঠে থাকেনি দলটি। প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারছে না তারা। জামায়াত-শিবির দমনে কঠোর অবস্থানে রয়েছে সরকার। স্বাধীনতার পর এমন সংকটে আর পড়তে হয়নি দলটিকে। নিষিদ্ধ দলের মতোই আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে চলছে সংগঠনটির কার্যক্রম।

জামায়াতের মধ্যসারির এক নেতা বলেন, আগামী দিনে ‘স্লো’ গতি নিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে মাঠে থাকবে জামায়াত। মাঝেমধ্যে হরতাল, জনসভা, ঝটিকা মিছিলে সচল থাকবে। ২০-দলীয় জোটের নানা কর্মসূচিতে প্রয়োজন অনুযায়ী তারা অংশ নেবেন। আগের মতো ব্যাপক শোডাউন করবেন না। নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড থেকেও বিরত থাকবেন। বিরূপ পরিস্থিতিতে টিকে থাকার নীতি গ্রহণ করা হবে।

এদিকে জামায়াত সমর্থিত বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানও নজরদারির আওতায় আনায় বেকায়দায় পড়েছে দলটি। ওইসব প্রতিষ্ঠানে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা এখনো কর্মরত। এ কারণে চাপে থাকলেও কার্যক্রম চলছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এসব প্রতিষ্ঠান হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। জামায়াত সমর্থিত ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোয় আতঙ্ক বিরাজ করছে।

জানা যায়, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসে অর্থায়নে সন্দেহভাজন সারা দেশের ৫৬৩টি প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে সরকার। জামায়াত-শিবির চালিত ও নিয়ন্ত্রিত স্কুল, কলেজ, কোচিং সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

জামায়াত নেতাদের পরিচালিত বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া জামায়াত পরিচালিত বিভিন্ন ধরনের সংগঠন, এনজিও এবং জামায়াত নেতাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো কাজ শুরু করেছে। এ নিয়ে আর্থিক সংকটে পড়েছে জামায়াত।

জামায়াতের ঢাকা মহানগরীর শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা বলেন, স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সংকট এখন মোকাবিলা করছে জামায়াত-শিবির। জামায়াতের সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লার পর চলে গেলেন সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদও। এ শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর সর্বোচ্চ আদালতের শেষ ধাপের রায়ও আজ। নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় নিয়েও তোড়জোড় চলছে। এ অবস্থায় দল টিকিয়ে রাখাই চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। দলের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় নজরদারি থাকায় নেতা-কর্মীদের সহযোগিতা করাও যাচ্ছে না। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মামলা চালানোও কঠিন হয়ে পড়ছে।-বিডি প্রতিদিন

৫মে, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে