বৃহস্পতিবার, ০৯ জুন, ২০১৬, ০১:০২:০৯

তবুও লাভ দেখছে বিএনপির তৃণমূল

তবুও লাভ দেখছে বিএনপির তৃণমূল

কাফি কামাল: ইউপি নির্বাচন ছিল বিএনপির তৃণমূল নেতৃত্বের সামনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনের স্বপ্নপূরণ ও দলে নিজের অবস্থান সুসংহত করার সুযোগ। ফলাফল যাই হোক, তৃণমূলের বিবেচনায় এ সুযোগ ভবিষ্যৎ রাজনীতির পাথেয়। সেই সঙ্গে এলাকায় নিজের অবস্থান ধরে রাখতে সুযোগটি হাতছাড়া করতে চায়নি তারা। তার ওপর ছিল সরকারদলীয় প্রার্থীদের ফাঁকা মাঠ না দেয়ার মনোভাব। স্বপ্ন এবং প্রত্যাশা থেকেই ইউপি নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল বিএনপির তৃণমূল। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচনের ব্যাপারে অনীহা থাকলেও তৃণমূল নেতাকর্মীদের চাপে ইউপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। তবে প্রথম ধাপেই স্বপ্নভঙ্গ ঘটে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীদের। হুমকি ধুমকি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় হয়রানি, প্রস্তাব-সমর্থককে হুমকি-ধমকি দিয়ে সমর্থন প্রত্যাহার করানো, প্রচারণায় বাধা, মামলা দায়ের, কেন্দ্র থেকে এজেন্টদের বের করে দেয়া, আগের রাতে সিল দিয়ে ব্যালটবাক্স ভর্তি করানোসহ নানা প্রতিকূলতা আসতে থাকে বিএনপি প্রার্থীদের সামনে। ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিলেও পরিস্থিতি দেখে অনেকেই সেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বহু ইউপিতে বিএনপি উপযুক্ত প্রার্থীও দিতে পারেনি।

প্রথম দুই ধাপের নির্বাচনের পর বর্জনের একটি আলোচনাও শুরু হয়েছিল দলীয় মহলে। তবে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে মধ্যপথ থেকে সরে দাঁড়াতে চায়নি বিএনপি। ফলাফল যাই হোক, শেষ পর্যন্ত যুক্ত থাকার মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে নিজেদের দাবিকে শক্তিশালী করার সিদ্ধান্ত নেয় দলটির নীতিনির্ধারণী ফোরাম। কিন্তু পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, সরকারদলীয় প্রতীকই হয়ে ওঠে জয়ের নিশ্চয়তা। তারপরও দলের নানা পর্যায়ে লবিং-তদবির করে, নির্বাচনের মাঠে অর্থব্যয়, মামলা-হামলার শিকার হয়েও প্রতিটি ধাপেই নির্বাচনে লড়েছেন বিএনপি প্রার্থীরা। নিশ্চিত পরাজয় জেনেও কেন এ অংশগ্রহণ? রাজনৈতিক মহলে এ নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তারা প্রত্যেকেই এ নির্বাচনে অংশগ্রহণের ভেতর খুঁজছেন রাজনৈতিক লাভের সান্ত্বনা। অন্যদিকে তাদের আলাপে উঠে এসেছে দলে নানা জটিলতার চিত্র।


চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি ইউপিতে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছিলেন নুর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। বয়সে তরুণ এবং রাজনীতিতে নতুন হলেও এলাকায় জনপ্রিয়তা দেখেই তার হাতে ধানের শীষ প্রতীক দিয়েছিল বিএনপি। ভোটের দিন ভোটারদের চেয়ারম্যান পদের ব্যালট না দেয়া ও কেন্দ্র দখলের প্রতিবাদে সকাল ১০টায় নির্বাচন বর্জন করেছেন তিনি। তারপরও পেয়েছেন তিন হাজারের বেশি ভোট। শহীদুল্লাহ বলেন, দলের সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানিয়ে এবং চুনতিতে বিএনপির শক্ত অবস্থানের জানান দিতেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। এ নির্বাচনের মাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে আমি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও মামলার শিকার হলেও ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনের সম্মান এবং মানুষের ভালোবাসা অর্জনের সুযোগ পেয়েছি। বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকার রাখার ভিত্তি অর্জন করতে পেরেছি। ব্যক্তিগতভাবে এটাকে বড় অর্জন বিবেচনা করি। অন্যদিকে কেড়ে নেয়া ফল যতই সরকারের বাক্সে যাক, জনগণের ভালোবাসা এবং সমর্থন অর্জন করেছে বিএনপি। পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে না পারায় মানুষের মনে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে তা সারা জীবন আওয়ামী লীগকে ঘৃণার আগুনে পোড়াবে।
মাদারীপুর জেলার শিবচর থানার উমেদপুর ইউপি থেকে ধানের শীষ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন দেলোয়ার হোসেন খান। উপজেলার প্রথম ধাপে অনুষ্ঠিত ১৬টি ইউপির মধ্যে সবকটি বাতিল হওয়ার পর উচ্চ আদালতের রায়ে দুটি মাত্র ইউপিতে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছিলেন বিএনপি প্রার্থীরা।

ষষ্ঠ ধাপে অনুষ্ঠিত তিনটি ইউপির মধ্যে একমাত্র দেলোয়ার হোসেন খানই সক্রিয় ছিলেন নির্বাচনের মাঠে। কিন্তু সার্বিক প্রতিকূলতার কারণে ফলাফল পক্ষে আসেনি। দেলোয়ার খান বলেন, সরকারদলীয় প্রার্থীকে খালি মাঠে গোল করার সুযোগ দিতে রাজি ছিল না কর্মীরা। তাদের চাপেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। বিগত নির্বাচনে দিনভর নানা ঘটনা-অঘটনের পর শেষ রাতে আমাকে পরাজিত দেখানো হয়েছিল। এবার সেটা দিনের বেলায় সম্পন্ন করেছে। এ নির্বাচনে আমার অর্জন ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করার সম্মান। অন্যদিকে নৈরাজ্য আর নানামুখী অনিয়ম ছাড়া যে বিএনপিকে হারানো যায় না সেটা প্রমাণ করতে পারা হচ্ছে বিএনপির অর্জন।

তিনি বলেন, বিএনপি নেতাকর্মীরা চাইলে ফলাফল কোনোদিন এরকম একতরফা নিতে পারতো না সরকার। কিন্তু সেটার জন্য যে নৈরাজ্য ও রক্তপাত হতো সেটা এড়াতে চেয়েছে বিএনপি। তাই নেতাকর্মীরা প্রতিবাদ করলেও প্রতিরোধ করেনি। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার রাজাবাড়ি ইউপিতে বিএনপির মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন কুতুব উদ্দিন। সারা দেশের মতো নৈরাজ্য ও ভোট লুটপাটের মুখে হেরেছেন তিনি। কুতুব উদ্দিন বলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি আলোচনা ছিল ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি ভুল করেছে। এবার তাদের সে ভুল ভেঙেছে। মানুষ চাক্ষুষ দেখতে এবং বুঝতে পেরেছে, ওই নির্বাচনে অংশ নিলেও এভাবেই ভোট কেড়ে নেয়া হতো। পৌরসভা ও উপজেলার পর ইউপি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তিনবার একই সত্য প্রমাণ হয়েছে। দল এখানে লাভবান হয়েছে।

তিনি বলেন, বিএনপির ক্ষতির জায়গা হচ্ছে, ইউপি নির্বাচনে নেতাকর্মীদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাঠে নামাতে না পারা। বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলের কমিটি গঠনে ব্যর্থতার কারণে বেশিরভাগ নেতাই ছিল নিষ্ক্রিয়। কেউ কেউ সরকারদলীয় প্রার্থীর সঙ্গে সমঝোতা করেছে, গোপনে তাদের সহায়তা করেছে। বিএনপিকে আন্দোলন বা নির্বাচনের মাঠে ঘুরে দাঁড়াতে হলে তৃণমূলে প্রতিটি সংগঠন পুনর্গঠন করতে হবে। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া সদর ইউনিয়নে ধানের প্রতীকে নির্বাচন করেছেন সাবেক চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান মানিক। ছাত্রদল ও যুবদলের মাধ্যমে বিএনপির রাজনীতিতে এসেছেন তিনি। মানিক বলেন, ইউপি নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপির অনেক অর্জন যেমন আছে, তেমনি আছে ক্ষতিও। ইউপি নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ বর্তমান সরকারের ভোট ডাকাতির দেখেছে। জনমানুষের এ ঘৃণা আওয়ামী লীগকে আজীবন বইতে হবে। আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছিল বিএনপির আন্দোলনের একটি অংশ। এর মাধ্যমে নেতাকর্মীরা আন্দোলন সংগ্রামের একটি শক্তি সাহস পেল।

মানিক আরও বলেন, আমাদের দলের নেতাকর্মীরা শক্ত মনোবল নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারেনি। হুমকি-ধমকির কারণে উল্লেখযোগ্য একটি অংশই সরকার দলীয় প্রার্থীর সঙ্গে সমঝোতা করেছে। নইলে ফলাফল অন্যরকম হতে পারতো। অন্যদিকে মনোনয়ন জটিলতাসহ নানা কারণে তৃণমূলে কোন্দল বাড়বে নিশ্চিতভাবেই। সার্বিক বিপর্যয়ের মধ্যেও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার শিয়ালকোল ইউপিতে ধানের শীষ প্রতীকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন আবদুল মান্নান শেখ। দীর্ঘ ১৯ বছর ইউপি সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনে অভিজ্ঞ আবদুল মান্নান ইউপি বিএনপিরও সভাপতি। তিনি বলেন, সিরাজগঞ্জে বিএনপির শক্ত অবস্থান এবং ব্যক্তিগত জনপ্রিতার সমন্বয়ে বিপর্যয়ের মধ্যেও বিজয়ী হয়েছি। কিন্তু সারা দেশের চিত্র বিবেচনা করতে গেলে নিজেকে ভাগ্যবানই মনে হয়। দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না বলে আমাদের দলের যে দাবি সেটা এবারের ইউপি নির্বাচনে চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এটা রাজনৈতিকভাবে বিএনপির অর্জন।

নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যুক্ত থেকে সরকারের অনিয়ম নৈরাজ্যকে প্রকাশ্যে আনতে পারা বিএনপির স্বার্থকতা। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই মামলা-হামলার কারণে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ফলাফল যাই হোক, নির্বাচনকে উপলক্ষে করে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আমরা আবারও কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে পেরেছি। সে হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত ছিল ইতিবাচক। তবে কিছু কিছু জায়গায় পছন্দের প্রার্থী মনোনয়ন না পাওয়াসহ নানা কারণে তৃণমূল পর্যায়ে কিছুটা আন্তকোন্দলও বেড়েছে। ইউপি নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীদের মতে, রাজনৈতিকভাবে অনেক বক্তব্য দেয়া হয়, অনেক দাবি করা হয়। কিন্তু এ নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি নিজেদের জনপ্রিয়তা ও অবস্থান সম্পর্কে সত্যিকারের পরিস্থিতি জানতে পেরেছে।

সারা দেশের বেশিরভাগ এলাকায় ভোটের দিন সকাল ৯-১০টার পর প্রশাসনের পক্ষপাত, সরকারদলীয় লোকজনের নৈরাজ্য ও নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ততায় পরিস্থিতি পুরোপুরি বিএনপি প্রার্থীদের প্রতিকূলে চলে গেছে। তারপরও বেশিরভাগ ইউপিতেই বিএনপি প্রার্থীরাই ছিল মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। অন্যদিকে বিএনপির জনসমর্থন আছে, কিন্তু সেটাকে কাজে লাগিয়ে ফলাফল পক্ষে নেয়ার মতো দক্ষ, সাহসী ও ত্যাগী কর্মীর অভাব ঘুচেনি। তবে বিপরীত মতও রয়েছে। তৃণমূলের বেশ কয়েকজন নেতার মতে, দলীয় প্রতীকে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না। নির্দলীয় সরকার ছাড়া জাতীয় নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে যেখানে অনড় সেখানে এ সিদ্ধান্ত সেটাকে নৈতিকভাবে দুর্বল করবে। প্রার্থীদের অনেকেই বলেছেন, ইউপি নির্বাচনে অনেক জায়গায় দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন বিএনপির তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ।

কেউ কেউ সরকারদলীয় প্রার্থীর সঙ্গে করেছেন গোপন আঁতাত। উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ছিল পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়। বিষয়গুলো কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে অবহিতও করেছেন অনেক প্রার্থী। যার প্রেক্ষিতে তৃণমূল পর্যায়ের অনেক নেতাকে দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। দল মনোনীত ধানের শীষের প্রার্থী এবং তৃণমূল নেতাকর্মীরা জানান, ইউপি নির্বাচনের মাধ্যমে দলের তৃণমূল পর্যায়ের সুবিধাবাদীরা চিহ্নিত হয়েছেন। যারা দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সরকারদলীয় প্রার্থীদের ভোট ডাকাতিতে সহায়তা করেছেন। আগামী দিনের পথচলায় এসব সুবিধাবাদীর ব্যাপারে কর্মী-সমর্থকরা সতর্ক হতে পারবে।-এমজমিন

৯ জুন,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে