ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান: আজ শুক্রবার পবিত্র ঈদুল আজহা, মুসলমানদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব। অনেক ঝক্কি-ঝামেলা পেরিয়ে ঢাকা শহরের একগুঁয়ে প্রাণহীন যান্ত্রিক জীবনের অবসরে ঈদ উদ্যাপন করতে গ্রামের বাড়ি এলাম।কেন জানি বুঝতে পারি না, গ্রাম- গ্রাম্য প্রকৃতি, চিরচেনা গ্রামীণ দৃশ্যপট, বাল্য-
কৈশোরের সেই স্মৃতিবিজড়িত পথ ঘাট প্রান্তর, মানুষজন সব কিছুই সব সময় আমায় কাছে টানে।
গ্রামের কথা মনে হলেই অতীত সুখ-স্বপ্নে বিভোর হয়ে নিজের অজান্তেই কেমন জানি আনমনা হয়ে হারিয়ে যাই সেই ফেলে আসা বাল্য- কৈশোরের দিনগুলোতে।তাই তো– প্রতি বছর ঈদে মা-মাটি-মানুষের টানে সেই চিরচেনা গ্রামীণ পরিবেশেই বারবার ছুটে আসি, ঘুড়ে বেড়াই গ্রামের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে, মিশে যাই গ্রামের আলো-বাতাসের সাথে।এ এক অন্যরকম আনন্দ, অন্যরকম অনুভুতি।
আমার জন্মস্থান রাজধানী থেকে ১০০ কিলোমিটার উত্তরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশঘেষা ত্রিশাল উপজেলার বীররামপুর গ্রামে।ঈদের আগের দিন ব্যস্ত রাস্তার ঝক্কি-ঝামেলা পেরিয়ে উপজেলা সদর ত্রিশাল পৌঁছতেই হৃদয়ের গহীনে লুকিয়ে থাকা অতীত আমাকে তাড়িয়ে বেড়াতে থাকে, সেইদিন আর এইদিনের কিছু স্মৃতি বারবার মানসপটে উঁকি মারতে থাকে, দু-চোখে ভেসে উঠতে থাকে অতীতের খন্ড খন্ড পুরোনো অনেক স্মৃতিই।তবে আজ সেই ছোটকালের ঈদ আনন্দের কথাই বেশি মনে পড়ছে।
সেই আশির দশকের গোড়ার দিকের কথা।সেসময় সুতিয়ানদীর তীরঘেষা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত সেই দরিরামপুর-ত্রিশালের বাহ্যিক অবস্থা ছিল খুবই ঝরাজীর্ণ, হাতেগোনা কয়েকটা একতলা ভবন শোভাপেত। যোগাযোগ ব্যবস্থাও তেমন একটা ভাল ছিল না,
অনেক সময় পাঁয়ে হেঁটেই বাবার সাথে হাটে যেতাম।এখানেই বসতো আমাদের অঞ্চলের সবচেয়ে বড় পশুর হাট। বাবার সাথে কোরবানির পশু কিনতে যেতাম। বড়দের সাথে কোরবানির পশু কিনতে যাওয়া আর পশু নিয়ে বাড়ি ফেরা, পথে পথে হাজার লোকের প্রশ্নের উত্তরে পশুর দাম
বলা- সে কি যে এক আনন্দের অনুভুতি তা ভাষায় ব্যক্ত করার মতো নয়।
কিন্তু সেই ত্রিশাল অনেক পাল্টে গেছে, এই সময়ের অত্যাধুনিক ফোরলেনের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশঘেষা সেই ছোট উপজেলা শহরটির অনেক বিস্তৃত হয়েছে, লেগেছে নগরায়নের ছুঁয়া।এখানে গড়ে উঠেছে অনেক বহুতল অত্যাধুনিক ভবন। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়সহ গড়ে উঠেছে
অনেক নতুন নতুন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।অন্যদিকে ছোটকালে আমাদের গ্রামটাও ছিল অনেকটাই অজোঁপাড়াগাঁ।অন্ধকার নিবৃতে চাঁদের জোৎস্নায় সেইসময় আমরা পথ চলতাম, মাঠঘাট প্রান্তর পায়ে হেঁটে চষে বেড়াতাম। আজ সেই অবহেলিত গ্রামেও যান্ত্রিক সভ্যতা ও নগরায়নের ছোঁয়ায় উদ্ভাসিত হয়ে যাচ্ছে; দিনদিন গ্রামের চিরচেনা রুপ পাল্টে যাচ্ছে।যেখানে এক সময় সব ঘরেই কেরোসিনের কুপি বাতি জ্বলতো, আজ সেখানে ঘরে ঘরে জ্বলছে বিদ্যুতের বাতি। ফলে চাঁদের জোৎস্না সেভাবে আর অনুভুত হয় না।অবশ্য আমাদের গ্রামের গাছগাছালি ঘেড়া
বাড়ির অবকাঠামো আজও কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আমার প্রিয় সেই গ্রাম, সেই মাঠ, সেই বাড়িঘর-আঙ্গিনা, সেই প্রাইমারি স্কুল, সেই ঈদগাহ, সেই কবরস্থান সব কিছু ঠিক আগের মতই আছে, শুধু আমরাই গ্রামে নেই।বাল্য-কৈশোরের সেই সহপাঠীদের অধিকাংশই এখন গ্রাম
ছেড়ে শহরের বাসিন্দা।অবশ্য সারাবছর যে যেখানেই থাকি না কেন ঈদে প্রায় সবাই বাড়ি যাই।অনেকের সাথেই দেখাসাক্ষাৎ কথাবার্তা হয়, কয়দিনের জন্য প্রাণচাঞ্চল্যতা ফিরে আসে গ্রামে।এই তো আমার জন্মস্থান চিরচেনা আপন আঙ্গিনা বীররামপুর গ্রাম।
এবার আসি ঈদ উদযাপন প্রসঙ্গে, সেই ছোটকালের কথা।তখন কোরবানির ঈদে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকায় গরু কিনে সাতজন মিলে কোরবানি দিতেন আমাদের গ্রামের লোকেরা।আর যদি কেউ ১০/২০ হাজার টাকার গরু দিয়ে কোরবানি করতেন।তবে সেই গরু দেখার জন্য গ্রামের কয়েক পাড়ার লোক ভিড় করতেন। কিন্তু সে অবস্থা অনেক পাল্টেছে। এখন এক/দুই লাখ টাকার গরু দিয়েও কোরবানি দিচ্ছেন অনেকেই। ঈদের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই কোরবানির পশুকে গোসল করানো, এরপর দলবেধে ঈদগাহে যাওয়া।ঈদের নামাজ শেষে পাড়াপ্রতিবেশী, পরিচিতজন
ও বন্ধু-সহপাঠীদের সাথে কোলাকুলি, মোলাকাত ও নিমন্ত্রণ, ঈদগাহ থেকে ফিরে গোরস্থানে পূর্বসূরীদের কবর জিয়ারত, সবাই মিলে কোরবানির পশু জবাই আর সেই কোরবানির পশুর গোস্তের একটা অংশ গরীব-মিসকীনদের ঘরে ঘরে এবং স্বজনদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছানো এবং কয়েক ধরে ঈদ দাওয়াত খাওয়ার মাঝে কী যে এক আনন্দের অনুভুতি সেটা কোনোভাবেই ভুলে যাবার মত নয়।অনেক কিছুই পাল্টে গেলেও গ্রামের ঈদ আনন্দে এগুলো আজও বিদ্যমান।
শহরের রাস্তাঘাটে অনেককেই বলতে শোনা যায়- এত কষ্ট করে আর ঝক্কি-ঝামেলা পোহায়ে গ্রামে ঈদ করার মানে কী! তাদের উদ্দেশ্যে বলবো- গ্রামবাংলার ঈদ যে কত আনন্দের, কত খুশির তা ইট-সিমেন্টের তৈরি বহুতল ভবনে বসবাস করা শহরের মানুষদের বুঝানো মুশকিল। গ্রামের ঈদ
আনন্দের অনুভুতি তারা কোনোভাবেই বুঝতে পাবেন না।আজও গ্রামের আলো-বাতাসা যেমন দূষণমুক্ত, তেমনি মানুষের ভালবাসা ও ঈদ আনন্দও। তাই ঈদ মানেই খুশি, ঈদ মানেই আনন্দ।শিশু-কিশোর, যুবা-বৃদ্ধ সবার মনেই বয়ে যায় আনন্দের
অন্যরকম ধারা।ঈদ আসে সত্য ও সুন্দরের জয়গান নিয়ে। প্রতিটি মুসলিম হৃদয়ে জাগিয়ে তোলে অফুরন্ত প্রেম-প্রীতির নবজাগরণ। নতুন সুর বীণায় ছন্দময় করে তোলে প্রতিটি প্রান্তর এবং জনপদ।মানবকল্যাণের সব ধরনের উচ্ছ্বাস জাগিয়ে দেয় নবচেতনায় এবং নতুন মাত্রায়। দূর হয়ে
যায় মনের সব কালিমা।আর এভাবেই ধর্মের মর্ম বাণীতে যেন নিজেদের শুদ্ধ করে নিচ্ছেন সবাই।এটাই বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়ের হাজার বছরের ঐতিহ্য।তাই ঈদুল আজহার দিনে মানুষের সেই চেতনারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে নবউদ্যমে।
মুসলমানদের জীবনে ঈদুল আজহার গুরুত্ব ও আনন্দ অপরিসীম।উৎসব হিসেবে পবিত্র ধর্মীয় অনুভূতি এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইসলামের জীবন আর ধর্ম একই সূত্রে গাঁথা।তাই ঈদ শুধু আনন্দের উৎস নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কর্তব্যবোধ, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের বৈশিষ্ট্য।সমাজের
সর্বস্তরের মানুষের সম্প্রীতির ভাবটা এখানে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এলাকার লোকেরা ঈদের নামাজের জন্য নির্দিষ্ট ঈদগাহে সমবেত হয়।এতে সবার মধ্যে একাত্মতা ও সম্প্রীতি ফুটে ওঠে- ইসলামের মহান ভ্রাতৃত্ববোধে সবাই উদ্দীপ্ত হয়।পরস্পর কোলাকুলির মাধ্যমে সব বিভেদ ভুলে
গিয়ে পরস্পর ভাই বলে গৃহীত হয়, আর এতে সামাজিক বন্ধন হয় আরো সুদৃঢ়। ধনী-গরিবের ব্যবধান তখন প্রাধান্য পায় না।ঈদের আনন্দ সবাই ভাগ করে নেয়।এর ফলে ধনী-গরিব, শত্রু-মিত্র, আত্মীয়স্বজন- সবাই পরস্পর ভ্রাতৃত্বের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকে। ঈদ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভোলার জন্য, মানুষের মধ্যে প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি হওয়ার জন্য পরম মিলনের বাণী নিয়ে আসে।ঈদুল আজহায় যে কোরবানি দেওয়া হয়, তার মাধ্যমে মানুষের মনের পরীক্ষা হয়, কোরবানির রক্ত-মাংস কখনোই আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না।শুধু দেখা হয় মানুষের ইচ্ছা, মনের ত্যাগ-তিতীক্ষাকে। ঈদের মধ্যে আছে সাম্যের বাণী, সহানুভূতিশীল হৃদয়ের পরিচয়।পরোপকার ও ত্যাগের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয় মানুষের মন।
হজরত ইব্রাহিমের (আ.) ত্যাগের সেই ঐতিহাসিক শিক্ষাকে উঁচু করার জন্য প্রতি বছর আমাদের মাঝে ফিরে আসে পবিত্র ঈদুল আজহা। এক কথায়, মানুষের পশুত্ব মানবিকতার উদ্যত ও অহমিকার মূলোৎপাটন করতেই মূলত ঈদুল আজহার আগমন ঘটে মুসলিম জাহানে।
বিশ্বব্যাপী আজ যে হাহাকার ও বিপন্ন মানবতার চিৎকার, তা থেকে বিশ্ববাসীকে মুক্ত করতে ঈদুল আজহার শিক্ষা ফি বছর আমাদের সামনে এসে স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে।মানবতার কল্যাণ সাধনে ইসলাম যে ক'টি শিক্ষা মানুষের সামনে তুলে ধরে তার মধ্যে
অন্যতম হচ্ছে ঈদুল আজহার শিক্ষা। ঈদুল আজহার পবিত্র এ দিনে পশু কোরবানি দিয়ে মানব মনের সমস্ত পশু প্রবৃত্তির মূলোৎপাটন
এবং আত্মশুদ্ধি ও মানবিক কল্যাণ চেতনাকে শাণিত করার এটি একটি জ্বলন্ত শিক্ষা। আর এতে নবজাগৃতি এবং নবশক্তির উদ্বোধন ঘটে প্রতিটি মুসলিম অন্তরে।এভাবে ধর্মীয় একটি উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে মানুষ ও সমাজকে তুলে আনার যে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি তা অবশ্যই গুরুত্ববহ এবং ইসলামী বিধানের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যকেই উন্মোচিত করে। অতএব আসুন, ঈদুল আজহার দিনে প্রকৃত ঈদের খুশি নিয়ে মানবতার কল্যাণে যা পবিত্র
কোরআনে ঘোষিত হয়েছে, 'বলো আমার নামাজ, আমার ইবাদতের সমস্ত অনুষ্ঠান, আমার জীবন ও মৃত্যু সবকিছুই মহান আল্লাহর জন্য। আর সেই আলোকে জীবনকে গড়ে তুলি।মনের পশুবৃত্তিকে সংহার করে মানবতার জয়গানে মেতে উঠি। সেই সাথে ত্যাগের মাধ্যমে সবার মনের কালিমা দূর
হোক, আমাদের সমাজে গড়ে উঠুক দৃঢ় সম্প্রীতি। ধর্ম-বর্ণ, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে আমরা সবাই ভাইয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শান্তিতে বসবাস করি।তাই সবার জীবনেই ঈদ বয়ে আনুক অনাবিল আনন্দ আর ত্যাগের মহিমা একামনায় আজ এখানেই শেষ করছি।
সবাইকে ঈদ মোবারক।
লেখক: শিক্ষা ও সমাজবিষয়ক গবেষক এবং কলাম লেখক। ই-মেইল:[email protected]
২৫ সেপ্টেম্বর/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস