শুক্রবার, ২৪ জুন, ২০১৬, ১২:৪৫:০৩

শিহাবের জবানবন্দিতেও সেই জিয়া

শিহাবের জবানবন্দিতেও সেই জিয়া

নুরুজ্জামান লাবু: প্রকাশক টুটুলের হত্যাচেষ্টার ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গি সদস্য শিহাব আদালতে যে জবানবন্দি দিয়েছে সেখানেও এসেছে সেই মেজর জিয়ার নাম। ২০১২ সালে সেনা অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন তিনি। এ ঘটনার পর তাকে বহিষ্কার করা হয় সেনাবাহিনী থেকে। এরপর থেকেই পলাতক। সেনা সদস্য থাকা অবস্থাতেই তিনি হিযবুত তাহরীর-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। বর্তমানে তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সামরিক শাখার দায়িত্বে রয়েছেন। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের স্লিপার সেলের কিলার বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেন তিনি। চার বছর ধরে পালিয়ে থাকলেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে ধরতে পারছে না। গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সেনা সদস্য থাকার সময় কমান্ডো ট্রেনিং নিয়েছিলেন বহিষ্কৃত এই মেজর জিয়াউল হক। তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়েও দক্ষ। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেপ্তার অভিযানের কৌশলও তার জানা। ফলে বারবার অভিযান চালালেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত ফস্কে যাচ্ছেন তিনি।


গত ১৫ই জুন বিমানবন্দর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলকে হত্যাচেষ্টাকারী সুমন পাটোয়ারী ওরফে শিহাব ওরফে সাকিব ওরফে সাইফুলকে। ৫ দিনের রিমান্ড শেষে গত মঙ্গলবার সে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। জবানবন্দিতে শিহাব বড় ভাই হিসেবে বহিষ্কৃত এই সেনা সদস্যের নাম বলেছে। শিহাবের জবানবন্দির একটি অনুলিপি এই প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে। জবানবন্দিতে শিহাব জানিয়েছে, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য হিসেবে যোগ দেয়ার কিছুদিন পর তাকে ঢাকায় ডেকে পাঠানো হয়। সংগঠনের নির্দেশনা অনুযায়ী সে টঙ্গীর একটি বাসায় অবস্থান করে। ওই বাসাতেই তাকে চাপাতি ও অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। শেষের দিকে একদি হাদী (চশমা পরে), সাকিব, ও বড়ভাই নামে একজন আসে। বড়ভাই আমাদের সকলের নেতা। বড়ভাই আমাদের বলে আল্লাহ্‌র জন্য জিহাদ করতে হবে এবং নাস্তিকদের কতল করতে হবে। তিনি আমাদের জানান যে, তিনি সেনবাহিনীতে চাকরি করতেন এবং জিহাদের জন্য চাকরি ছেড়ে চলে এসেছেন। আমার নেতা বড়ভাইয়ের সাংগঠনিক ছদ্মনাম ইশতিয়াক।


জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সঙ্গে সম্পৃক্ত গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই ইশতিয়াকই আসলে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর জিয়াউল হক ওরফে জিয়া। সেই পলাতক থেকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সামরিক শাখার কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন জানান, শিহাব তাদের দলনেতাসহ অনেকের নাম বলেছে। তাদের অনেককেই শনাক্ত করা গেছে। এদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। গোয়েন্দা পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, শিহাব তাদের দলনেতা হিসেবে যার কথা বলেছে তাকে আমরা অনেক আগে থেকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি। সে খুব ধূর্ত ও কৌশলী। তাকে ধরার জন্য নানা কৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে।


গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০১২ সালের ১০ই জানুয়ারি সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই আত্মগোপনে চলে যান জিয়া। শুরুর দিকে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় ইশরাক নামে প্রবাসী এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে আত্মগোপন করে ছিলেন তিনি। এরপর পুরোপুরি চলে যান আন্ডারগ্রাউন্ডে। কখনো পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল কখনো টেকনাফ-কক্সবাজারসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পালিয়ে থেকে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান তিনি। সে সময় তিনি হিযবুত তাহ্‌রীর-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের তাত্ত্বিক নেতা জসিমউদ্দিন রাহমানীর মাধ্যমে এই সংগঠনের সামরিক কমান্ডারের দায়িত্ব নেন।

গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ছদ্মবেশে থাকা অবস্থায় জিয়া রাজধানী ঢাকার বাড্ডা, মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় পালিয়ে ছিলেন। বাড্ডা এলাকার এক বাসার তার অবস্থানের কথা জানতে পেরে বছর খানেক আগে সেখানে অভিযান চালিয়ে ছিলো ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল। অভিযানে থাকা ওই দলের একজন কর্মকর্তা জানান, অভিযানের বিষয়টি যে কোনোভাবে টের পেয়ে গিয়েছিল জিয়া। এ কারণে অভিযানের ২০ মিনিট আগে বিশেষ কৌশলে পালিয়ে যায় সে। ওই বাসাটি ছিলো জিয়ার এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সহচর আহমেদ রফিকের। রফিক নিজেও জঙ্গি সংগঠন হিযবুতের সক্রিয় সদস্য।

সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, জিয়ার সঙ্গে একাধিক বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও কারো কারো সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে বলে ওই কর্মকর্তা জানান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা জানান, সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় মেধাবী হিসেবে পরিচিত বহিষ্কৃৃত এই সেনা কর্মকর্তা বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কাউন্টার সার্ভিল্যান্সের বিস্তারিত কৌশলগুলো জানে। এ কারণে সে নিজেকে আড়াল করতে সক্ষম হচ্ছে। এছাড়া তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে দক্ষ হওয়ায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের স্লিপার সেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন বিশেষ কৌশলে। জঙ্গি শিহাবও তার জবানবন্দিতে প্রযুক্তির মাধ্যমে সুরক্ষিতভাবে যোগাযোগের কৌশলের কথা উল্লেখ করেছেন।

আদালতে দেয়া শিহাব তার জবানবন্দিতেও বড়ভাই ও অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে ‘প্রটেক্টেড টেক্সট’- এর মাধ্যমে যোগাযোগ করার কথা উল্লেখ করেছে। এর আগে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুর দুই হত্যাকারীকে হাতেনাতে ধরার পর তারা যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ‘প্রটেক্টেড টেক্সট‘ ব্যবহারের কথা জানিয়েছিল। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, প্রযুক্তির এই বিষয়গুলো মূলত বহিষ্কৃত মেজর জিয়াই সদস্যদের শিখিয়েছে। জিয়াকে ধরতে পারলেই টার্গেট কিলিং পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে বলে তাদের ধারণা।-এমজমিন

২৪ জুন, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে