বুধবার, ২৯ জুন, ২০১৬, ১০:৪২:০৪

যাদের উপর যাকাত ফরজ

যাদের উপর যাকাত ফরজ

নিউজ ডেস্ক : নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক সকল মুসলিম নর-নারীর উপর যাকাত প্রদান করা ফরজ। কোনো ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার পর চাঁদের হিসাবে পরিপূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হলে তার উপর পূর্ববর্তী বছরের যাকাত প্রদান করা ফরজ। অবশ্য যদি কোনো ব্যক্তি যাকাতের নিসাবের মালিক হওয়ার পাশাপাশি যদি ঋণগ্রস্ত হয়, তবে ঋণ বাদ দিয়েও নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তার উপর যাকাত ফরজ হবে। যাকাত ফরজ হওয়ার পর যদি কোনো ব্যক্তি তা প্রদান না করে অর্থ-সম্পদ খরচ করে ফেলে তাহলেও তার পূর্বের যাকাত দিতে হবে।

যাকাতের নিসাব কী?
রূপা ৫৯৫ গ্রাম (৫২.৫০ ভরি) কিংবা স্বর্ণ ৮৫ গ্রাম (৭.৫০ ভরি) অথবা স্বর্ণ বা রূপা যে কোনো একটির নিসাবের মূল্য পরিমাণ অর্থ-সম্পদ বা ব্যবসায়িক সামগ্রীকে যাকাতের নিসাব বলে।

কোনো ব্যক্তির মৌলিক প্রয়োজন পূরণের পর যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ তার মালিকানায় থাকে এবং চন্দ্র মাসের হিসাবে এক বৎসর তার মালিকানায় স্থায়ী থাকে তাহলে তার উপর এ সম্পদ থেকে চল্লিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত রূপে প্রদান করা ফরজ। মনে রাখতে হবে বছরের শুরু ও শেষে এ নিসাব বিদ্যমান থাকা জরুরি। বছরের মাঝখানে এ নিসাব পূর্ণ না থাকলেও যাকাত প্রদান করতে হবে।

সম্পদের প্রত্যেকটি অংশের উপর এক বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয় বরং শুধু নিসাব পরিমাণের উপর বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত। অতএব, বছরের শুরুতে শুধু নিসাব পরিমাণ অর্থ-সম্পদ থাকলেও বছরের শেষে যদি সম্পদের পরিমাণ বেশী হয় তাহলে ওই বেশী পরিমাণের উপর যাকাত প্রদান করতে হবে। বছরের যে কোনো অংশে অধিক সম্পদ যোগ হলে তা পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয়। যাকাত ফরজ হওয়ার ক্ষেত্রে মূল নিসাবের উপর বছর অতিক্রম করা শর্ত। যাকাত, যাকাতুল ফিতর, কুরবানি এবং হজ এ সকল শরীয়তের বিধান সম্পদের মালিকানার সাথে সম্পৃক্ত।

যাকাত বহির্ভুত সম্পদ :
জমি, বাড়ি-ঘর, দালান, দোকানঘর, কারখানা, কারখানার যন্ত্রপাতি, কলকব্জা, যন্ত্রাংশ, কাজের যন্ত্র, হাতিয়ার, অফিসের আসবাবপত্র ও সরঞ্জাম, যানবাহনের গাড়ি, নৌকা, লঞ্চ, জাহাজ, বিমান ইত্যাদি, যানবাহন বা চলাচলের অথবা চাষাবাদের পশু, ব্যবহারিক গাড়ি, ব্যবহারিক কাপড়-চোপড়, ঘরের আসবাবপত্র ও সরঞ্জামাদি, নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যবহার্য সামগ্রী, গৃহ-পালিত পাখি, হাঁস-মুরগী ইত্যাদির যাকাত হয় না।

ঋণ পরিশোধের জন্য জমাকৃত অর্থের উপর যাকাত হয় না। শস্য ও গবাদি পশুর যাকাত পরিশোধ করার পর ওই শস্য বা গবাদি পশু বিক্রি করে নগদ অর্থ প্রাপ্ত হলে ওই অর্থের উপর একই বছরে যাকাত দিতে হবে না। কারণ একই সম্পদের একই বছরে দুইবার যাকাত হয় না।

যেসব সম্পদের যাকাত ফরজ :
১. স্বর্ণ-রূপা ও নগদ অর্থ, ২. বাণিজ্যিক পণ্য, ৩. মাঠে বিচরণকারী গবাদি পশু, ৪. শস্য ও ফলমূল।

স্বর্ণ ও রূপার যাকাত :
যদি কারো নিকট ৮৫ গ্রাম বা ৭.৫০ ভরি (১ ভরি=১১.৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণ অথবা ৫৯৫ গ্রাম (৫২.৫০ ভরি) রূপা থাকে তাহলে তার উপর যাকাত ফরজ। স্বর্ণ-রূপা চাকা হোক বা অলংকার, ব্যবহৃত বা অব্যবহৃত, স্বর্ণ বা রৌপ্যনির্মিত যে কোনো বস্তু, সর্বাবস্থায় স্বর্ণ-রূপার যাকাত ফরজ।

হীরা, ডায়মন্ড, হোয়াইট গোল্ড, প্লাটিনাম প্রভৃতি মূল্যবান ধাতু যদি সম্পদ হিসেবে বা টাকা আটকানোর উদ্দেশ্যে ক্রয় করা হয়, তাহলে বাজার মূল্য হিসাবে তার যাকাত দিতে হবে। অলংকারসহ সকল প্রকার স্বর্ণ-রূপার যাকাত দিতে হবে।

নগদ অর্থের যাকাত :
নগদ অর্থ, টাকা-পয়সা, ব্যাংকে জমা, পোস্টাল সেভিংস, বৈদেশিক মূদ্রা (নগদ, এফসি অ্যাকাউন্ট, টিসি, ওয়েজ আর্নার বন্ড), কোম্পানির শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড, ঋণপত্র বা ডিবেঞ্চার, বন্ড, সঞ্চয়পত্র, জমাকৃত মালামাল (রাখী মাল), প্রাইজবন্ড, বীমা পলিসি (জমাকৃত কিস্তি), কো-অপারেটিভ বা সমিতির শেয়ার বা জমা, পোস্টাল সেভিংস সার্টিফিকেট, ডিপোজিট পেনশন স্কিম কিংবা নিরাপত্তামূলক তহবিলে জমাকৃত অর্থের যাকাত প্রতিবছর যথা নিয়মে প্রযোজ্য হবে।

প্রতিষ্ঠানের রীতি অনুযায়ী বাধ্যতামূলকভাবে চাকরিজীবীর বেতনের একটি অংশ নির্দিষ্টহারে কর্তণ করে ভবিষ্যৎ তহবিলে জমা করা হলে ওই অর্থের উপর যাকাত ধার্য হবে না। কারণ ওই অর্থের উপর চাকরিজীবীর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ভবিষ্যৎ তহবিলের অর্থ ফেরৎ পাওয়ার পর যাকাতের আওতাভুক্ত হবে। ঐচ্ছিকভাবে (অপ্শনাল) ভবিষ্যৎ তহবিলে বেতনের একটা অংশ জমা করা হলে তার উপর যাকাত প্রযোজ্য হবে অথবা বাধ্যতামূলক হারের চাইতে বেশি হারে এই তহবিলে বেতনের একটা অংশ জমা করা হলে ওই অতিরিক্ত জমা অর্থের উপর বছরান্তে যাকাত প্রযোজ্য হবে। চাকরিজীবীর অন্যান্য সম্পদের সাথে এই অর্থ যোগ হয়ে নিসাব পূর্ণ হলে যাকাত প্রদান করতে হবে।

পেনশনের টাকাও হাতে পেলে যাকাত হিসাবে আসবে। মানত, কাফ্ফারা, স্ত্রীর মাহরের জমাকৃত টাকা, হজ ও কুরবানির জন্য জমাকৃত টাকার উপরেও বছরান্তে যথা নিয়মে যাকাত দিতে হবে। ব্যাংক জমা বা সিকিউরিটির (ঋণপত্র বা ডিবেঞ্চার, বন্ড, সঞ্চয়পত্র ইত্যাদি) উপর অর্জিত সুদ ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ উপার্জন নয় বিধায় যাকাতযোগ্য সম্পদের সঙ্গে যোগ করা যাবে না। অর্জিত সুদ কোন জনহিতকর কাজে ব্যয় করতে হবে। তবে মূল জমাকৃত অর্থের বা সিকিউরিটির ক্রয় মূল্যের উপর যাকাত প্রদান করতে হবে। ব্যাংক জমার উপর বৈধ মুনাফা প্রদান করা হলে ওই মুনাফা মূল জমার সঙ্গে যুক্ত করে যাকাতযোগ্য অন্যান্য সম্পত্তির সাথে যোগ করতে হবে।

বৈদেশিক মুদ্রার উপর যাকাত :
যাকাত প্রদানের সময় উপস্থিত হলে মালিকানাধীন সকল বৈদেশিক মুদ্রার নগদ, ব্যাংকে জমা, টিসি, বন্ড, সিকিউরিটি ইত্যাদি যাকাত প্রদানকারী ব্যক্তির বসবাসের দেশের মুদ্রাবাজারে বিদ্যমান বিনিময় হারে মূল্য নির্ধারণ করে অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে যোগ করে প্রদান করতে হবে।

মোহরাণার অর্থের উপর যাকাত :
’মাহর’ বিধানের মাধ্যমে ইসলাম নারীদের জন্য এক অনন্য অধিকার নিশ্চিত করেছে। কনে, বরের সাথে তার বিবাহবন্ধনে স্বীকৃতির সম্মানীস্বরূপ, বরের কাছ থেকে মাহর (মোহরাণা) পেয়ে থাকে। মাহর বাবদ প্রাপ্ত জমাকৃত অর্থের উপর যাকাত ধার্য হবে। মাহরের অর্থ নিসাব মাত্রার হলে অথবা অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে যোগ হয়ে নিসাব পূর্ণ হলে যাকাত প্রদান করতে হবে। মোহরাণার যে অর্থ আদায় করা হয়নি তার উপর যাকাত ধার্য হবে না, কারণ এই অর্থ তার আওতাধীনে নেই।

প্রচলিত মুদ্রায় (টাকায়) ধার্যকৃত ’মাহর’ বিয়ের সময় সাথে সাথে পরিশোধ না করে, বিলম্বে প্রদান করা হলে তা আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়। বর্তমানকালে বিদ্যমান মুদ্রার ক্রমবর্ধমান মূল্যহ্রাসের ফলে এই পাওনা পরবর্তীতে যখন পরিশোধ করা হয়, তখন মাহরের বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থ একান্ত নগণ্য বা তুচ্ছ পরিমাণ হয়ে যায়। শরীয়াহ্ বিশারদরা এই সমস্যার সমাধানে দৃঢ় মত পোষণ করেন যে, প্রচলিত মূদ্রার পরিবর্তে স্বর্ণ বা রৌপ্যের পরিমাণের ভিত্তিতে ’মাহর’ নির্ধারণ করা উচিত। যাতে করে বিবাহিত নারীদের এই অধিকার যথার্থভাবে সংরক্ষিত থাকে এবং পরবর্তীকালে প্রচলিত মুদ্রার মূল্যহ্রাসজনিত কারণে তাদের ক্ষতি হওয়া থেকে রক্ষা পায়।

শেয়ার :
যৌথ মূলধনী কোম্পানির মোট মূলধনকে সমমূল্য বিশিষ্ট বহুসংখ্যক ক্ষুদ্রাংশে বিভক্ত করা হয়। এরূপ ক্ষুদ্রাংশগুলোকে শেয়ার বলে। শেয়ার মালিককে কোম্পানির নিট সম্পত্তির একজন অংশীদার হিসাবে গণ্য করা হয়। শেয়ার ক্রয়ের উদ্দেশ্য বৃহৎ কোম্পানির ব্যবসায় বিনিয়োগ, কোম্পানির আংশিক মালিকানা অর্জন এবং লভ্যাংশ বা মুনাফা উপার্জন করা। ইসলামের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ যেমন-

অসামাজিক বা অনৈতিক ব্যবসায়ে লিপ্ত, নিষিদ্ধ পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয় বা সুদী কারবার ও দৈবনির্ভর লেনদেনে নিয়োজিত কোম্পানির শেয়ার ক্রয় বৈধ নয়। কোম্পানি নিজেই যদি শেয়ারের উপর যাকাত প্রদান করে তা হলে শেয়ারমালিককে তার মালিকানাধীন শেয়ারের উপর যাকাত দিতে হবে না। কোম্পানি যাকাত প্রদান করতে পারবে যদি কোম্পানির উপ-বিধিতে এর উল্লেখ থাকে অথবা কোম্পানির সাধারণ সভায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় অথবা শেয়ারমালিকরা কোম্পানিকে যাকাত প্রদানের ক্ষমতা প্রদান করেন।

কোম্পানি নিজে তার শেয়ারের উপর যাকাত প্রদান না করলে শেয়ার মালিককে নিম্নোক্ত উপায়ে যাকাত প্রদান করতে হবে-

১. শেয়ারমালিক যদি শেয়ারগুলো বার্ষিক লভ্যাংশ অর্জনের কাজে বিনিয়োগ করে, তাহলে যাকাতের পরিমাণ নিম্নোক্ত উপায়ে নির্ণয় করা হবে-
ক) শেয়ারমালিক যদি কোম্পানির হিসাবপত্র যাচাই করে তার মালিকানাধীন শেয়ারের বিপরীতে যাকাতযোগ্য সম্পদের পরিমাণ জানতে পারেন, তাহলে তিনি ২.৫% হারে যাকাত প্রদান করবেন।
খ) কোম্পানির হিসাবপত্র সম্পর্কে যদি তার কোন ধারনা না থাকে তাহলে তিনি তার মালিকানাধীন শেয়ারের উপর বার্ষিক অর্জিত মুনাফা যাকাতের জন্য বিবেচ্য অন্যান্য সম্পত্তির মূল্যের সঙ্গে যোগ করবেন এবং মোট মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে ২.৫% হারে যাকাত প্রদান করবেন।

২. শেয়ার মালিক যদি শেয়ার বেচাকেনার ব্যবসা (মূলধনীয় মুনাফা) করার জন্য শেয়ারগুলো ব্যবহার করেন তাহলে যেদিন যাকাত প্রদানের ইচ্ছা হবে, শেয়ারের সেদিনের বাজার মূল্য ও ক্রয়-মূল্যের মধ্যে যেটি কম তারই ভিত্তিতে মূল্যায়ন করে ২.৫% হারে যাকাত প্রদান করবেন। একজন শেয়ার মালিক ইচ্ছে করলে যে কোনো সময় শেয়ার বিক্রি করে দিতে পারেন। কোম্পানির শেয়ার ক্রয় ও বিক্রয়ের এই স্বাধীনতা শেয়ার বাজারকে এমন পরিণতির দিকে নিয়ে যায় যে, কিছু ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে শেয়ারের মূল্য বাড়িয়ে বা কমিয়ে একটি সাধারণ ব্যবসা কার্যক্রমকে প্রায় জুয়াখেলায় পরিণত করে। যা ইসলামী শরীয়ার দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অবৈধ।

বাণিজ্যিক সম্পদের যাকাত :
ব্যবসার নিয়তে (পুনঃবিক্রয়ের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ মুনাফা অর্জনের জন্য) ক্রয়কৃত, আমদানি-রপ্তানি পণ্য, ট্র্যানজিট বা পরিবহন পণ্য, বিক্রয় প্রতিনিধির (এজেন্ট) কাছে রাখা পণ্যদ্রব্য ও মজুদ মালামালকে ব্যবসার পণ্য বলে। ব্যবসার পণ্যের উপর সর্বসম্মতভাবে যাকাত ফরজ। এমনকি ব্যবসার উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত জমি, দালান বা যে কোনো বস্তু অথবা মালামালের মূল্যের উপরও যাকাত প্রদান করতে হবে। বাকী বিক্রির পাওনা, এলসি মার্জিন ও আনুষঙ্গিক খরচ, ব্যবসার নগদ অর্থসহ অন্যান্য চলতি সম্পদ যাকাতের হিসাবে আনতে হবে। অন্যদিকে ব্যবসার দেনা যেমন বাকীতে মালামাল বা কাঁচামাল ক্রয় করলে কিংবা বেতন, মজুরি, ভাড়া, বিদ্যুৎ, টেলিফোন ও গ্যাস বিল, কর ইত্যাদি পরিশোধিত না থাকলে উক্ত পরিমাণ অর্থ যাকাত যোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে।

যাকাত নির্ধারণের জন্য বিক্রেতা তার পণ্যের ক্রয়-খরচ মূল্যকে (ক্রয়মূল্যের সাথে ভাড়াসহ ক্রয়-সংক্রান্ত অন্যান্য খরচ যোগ করে) হিসাবে ধরবেন। ‘আল্লাহ তায়ালা ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন’। (সুরা বাক্বারা, আয়াত-২৭৫)

উৎপাদিত পণ্য :
তৈরি বা উৎপাদিত পণ্য, উপজাত দ্রব্য, পঙক্রিয়াধীন পণ্য, উৎপাদন পঙক্রিয়ায় ব্যবহৃত কাঁচামাল ও প্যাকিং সামগ্রী ইত্যাদি যাকাতের আওতাভুক্ত হবে। যাকাত নির্ধারণের জন্য তৈরি বা উৎপাদিত পণ্যের মূল্যায়ন উৎপাদন খরচ মূল্যের অথবা পাইকারি বাজার দরের ভিত্তিতে হবে। পপঙক্রিয়াধীন বা অসম্পূর্ণ পণ্যের মূল্যায়ন ব্যবহৃত কাঁচামাল ও অন্যান্য উপাদানের খরচের ভিত্তিতে করতে হবে। মজুদ কাঁচামাল এবং উৎপাদন পঙক্রিয়ায় কাঁচামালের সাথে ব্যবহৃত প্যাকিং সামগ্রী ক্রয়- খরচ মূল্যের ভিত্তিতে হিসাব হবে এবং যাকাতের আওতাধীন পণ্যদ্রব্যসহ ব্যবসার নগদ অর্থ ও অন্যান্য চলতি সম্পত্তির সাথে যোগ করে যাকাত নির্ধারণ করতে হবে। উৎপাদন পঙক্রিয়ায় নিয়োজিত স্থায়ী সম্পদ যেমন- জমি, দালান, যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র, যানবাহন ইত্যাদির উপর যাকাত প্রযোজ্য হবে না।

স্থায়ী সম্পত্তির যাকাত :
স্থায়ী সম্পত্তি বলতে বুঝায় জমি, দালানকোঠা, আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, যানবাহন ইত্যাদি।

ক. বসবাস, ব্যবহার, উৎপাদন কাজে বা কার্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত স্থায়ী সম্পত্তির উপর যাকাত ধার্য হয় না।
খ. আয় উপার্জনের জন্য ভাড়ায় নিয়োজিত স্থায়ী সম্পত্তি যেমন- গৃহ, দোকান, দালানকোঠা, জমি, যন্ত্রপাতি, গাড়ি, যানবাহন ইত্যাদির উপর যাকাত ধার্য হয় না। তবে এসব সম্পত্তি থেকে ভাড়া বাবদ অর্জিত নিট আয় অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পত্তির সঙ্গে যোগ করে ২.৫% হারে যাকাত প্রদান করতে হবে।
গ. বেচা-কেনার উদ্দেশ্যে নিয়োজিত স্থায়ী সম্পত্তি যেমন- জমি, গৃহ, দোকান, এপার্টমেন্ট, দালানকোঠা, আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, গাড়ি, যানবাহন ইত্যাদি ব্যবসায়িক পণ্য বলে গণ্য করা হবে এবং এগুলোর মূল্যের উপর যাকাত ধার্য হবে।

ঋণদাতার উপর যাকাত :
ক. আদায়যোগ্য ঋণ আদায় হওয়ার পর অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে যোগ করে যাকাত প্রদান করতে হবে।

১. যে ঋণ নগদে বা কোন দ্রব্যের বিনিময়ে কারো কাছে পাওনা হয়, এরূপ ঋণ আদায় হওয়ার পর যাকাত দিতে হবে এবং বিগত বৎসরগুলোরও যাকাত প্রদান করতে হবে।
২. যে পাওনা কোনো দ্রব্য বা নগদ ঋণের বিপরীতে নয়, যেমন উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অস্থাবর সম্পদ, দান, অছিয়ত, মোহরাণার অর্থ ইত্যাদি বাবদ প্রাপ্ত হয়। এরূপ ক্ষেত্রে আদায়ের পর যাকাত ধার্য হবে। এগুলোর উপর বিগত বৎসরগুলোর যাকাত প্রদান করতে হবে না।

খ. আদায় অযোগ্য বা আদায় হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ থাকলে সে ঋণ যাকাতের হিসাবে আসবে না। যদি কখনও উক্ত ঋণের টাকা আদায় হয়, তবে কেবলমাত্র এক বছরের জন্য এর যাকাত দিতে হবে।

ঋণগ্রহিতার উপর যাকাত :
ক. ঋণগ্রহিতার ঋণের টাকা মোট যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। কিন্তু যদি ঋণগ্রহিতার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্থায়ী সম্পত্তি (যেমন-অতিরিক্ত বাড়ি, দালান, এপার্টমেন্ট, জমি, মেশিনারী, যানবাহন, গাড়ি ও আসবাবপত্র ইত্যাদি) থাকে, যার মাধ্যমে এরূপ ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম, তবে উক্ত ঋণ যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে না।

খ. স্থাবর সম্পদের উপর কিস্তিভিত্তিক ঋণ (যেমন-হাউজিং লোন ইত্যাদি) যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে না। তবে বার্ষিক কিস্তির টাকা অপরিশোধিত থাকলে তা যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে।

গ. ব্যবসায়ে বিনিয়োগের জন্য ঋণ নেয়া হলে উক্ত ঋণের টাকা যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। কিন্তু যদি ঋণগ্রহিতার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্থায়ী সম্পত্তি থাকে তবে উক্ত ঋণ যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে না।

ঘ. শিল্প-বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঋণের টাকা যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। তবে যদি ঋণগ্রহিতার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্থায়ী সম্পত্তি থেকে উক্ত ঋণ পরিশোধ করা যায় তবে তা যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে না।

ঙ. যদি অতিরিক্ত স্থায়ী সম্পত্তির মূল্য ঋণের পরিমাণের চেয়ে কম হয়, তবে ঋণের পরিমাণ থেকে তা বাদ দিয়ে বাকী ঋণের টাকা যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। বিলম্বে প্রদেয় বা পুনঃতপসিলিকৃত ঋণের বেলায় শুধুমাত্র ঋণের বার্ষিক অপরিশোধিত কিস্তি যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে।

পশুর যাকাত :
উটের সর্বনিম্ন নিসাব পাঁচটি, গরু-মহিষের ত্রিশটি এবং ছাগল-ভেড়ার চল্লিশটি। তবে এ ধরনের পশু বৎসরের অর্ধেকের বেশি সময় মুক্তভাবে চারণভূমিতে খাদ্য গ্রহণ করলেই এসব পশুর উপর সংখ্যা ভিত্তিক যাকাত ধার্য হবে। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে যে কোনো পশুসম্পদ প্রতিপালন করা হলে সেগুলোকে ব্যবসায়িক পণ্য বলে গণ্য করা হবে এবং এদের উপর যাকাত সংখ্যার ভিত্তিতে নয়, মূল্যের ভিত্তিতে ধার্য হবে। ব্যবসার উদ্দেশ্যে খামারে পালিত মৎস্য, হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগল ইত্যাদি এবং খামারে উৎপাদিত দুধ, ডিম, ফুটানো বাচ্চা, মাছের রেণু, পোনা ইত্যাদি ব্যবসার সম্পদ হিসাবে যাকাত প্রদান করতে হবে।

প্রিয়নবী মুহম্মদ (সা.) পানিতে বাস করা অবস্থায় মাছ ক্রয়-বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন। মাছ যখন বিক্রির জন্য ধরা হবে তখনই এর যাকাত পরিশোধ করতে হবে।

শস্য ও ফলের যাকাত (উশর) :
শস্য ও ফলমূলের যাকাতকে উশর বলে। জমি থেকে উৎপন্ন সকল প্রকার শস্য, শাকশব্জি, তরি-তরকারি ও ফলের উপর যাকাত প্রযোজ্য। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করা হলে বনজ বৃক্ষ, ঘাস, নলখাগড়া, ওষুধি বৃক্ষ, চা বাগান, রাবার চাষ, তুলা, আগর, ফুল, অর্কিড, বীজ, চারা, কলম ইত্যাদি যাকাতের আওতাভুক্ত হবে। ফসল আসার সাথে সাথে উশর পরিশোধ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে বৎসর অতিক্রান্ত হওয়ার প্রয়োজন নাই।
 
বৎসরে একাধিকবার ফসল আসলে একাধিকবার উশর পরিশোধ করতে হবে। অনেক ধরনের ফল, ফসল ও শাকশব্জি একই সাথে কাটা বা উত্তোলন করা যায় না। যেমন- মরিচ, বেগুন, পেঁপে, লেবু, কাঁঠাল ইত্যাদির পরিপক্কতা বুঝে কিছু কিছু করে কয়েকদিন পর পর পুরো কৃষি মৌসুমে বার বার উত্তোলন করা হয়। ফসলের মালিক যদি ফসলের আনুমানিক পরিমাণ নিরূপণ করতে সমর্থ হন এবং তা যদি নিসাব পরিমাণ হয় তবে প্রথম থেকেই প্রতি উত্তোলনের সাথে সাথে উশর (যাকাত) পরিশোধ করবেন। যদি মালিকের পক্ষে ফসলের পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব না হয়, তবে তিনি প্রথম উত্তোলন থেকে ফসলের হিসাব রাখবেন এবং যখনি মোট উত্তোলিত ফসলের পরিমাণ নিসাব পরিমাণে পৌঁছবে তখনি ওইদিন পর্যন্ত মোট উত্তোলিত ফসলের যাকাত পরিশোধ করবেন এবং তৎপরবর্তী প্রতি উত্তোলনের সাথে সাথে যাকাত পরিশোধ করবেন।

জ্বালানি কাঠ, আসবাবপত্র ও গৃহনির্মাণে ব্যবহার উপযোগী বৃক্ষের ক্ষেত্রে, এরূপ বৃক্ষ যখন কাটা হবে তখন এগুলোর উপর যাকাত প্রযোজ্য হবে। তা যত দীর্ঘ সময় পর কাটা হউক না কেন। যে জমিতে সেচ প্রয়োজন হয় না, প্রাকৃতিকভাবে সিক্ত হয়, তার ফসলের যাকাত হবে দশ ভাগের একভাগ (১০%)। আর যে জমিতে সেচের প্রয়োজন হয়, তার ফসলের যাকাত হবে বিশ ভাগের একভাগ (৫%)। ফসল উৎপাদনের ব্যয় যেমন- চাষ, সার, কীটনাশক, বপন ও কর্তণ ইত্যাদি খরচ উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ থেকে বাদ যাবে। তবে এ সব খরচ মোট উৎপাদিত ফসলের এক তৃতীয়াংশের বেশি বাদ যাবে না। ফসলের নিসাবের পরিমাণ ৫ ওয়াস্ক বা ৬৫৩ কিলোগ্রাম।

অনেক কৃষি ফসল আছে যা মাপা বা ওজন করা হয় না। যেমন বিভিন্ন ধরনের ফল, ফসল, শাকশব্জি, ফুল, অর্কিড, চারা, বৃক্ষ ইত্যাদি। এগুলোর নিসাব নির্ধারণের ক্ষেত্রে দেশের সাধারণ ফসল চাল বা গমের ৬৫৩ কেজির মূল্য (স্থানীয় বাজারে গড় মূল্য) নিসাব হিসাবে গণ্য করা যাবে।-বাংলামেইল
২৯ জুন, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসপি/এমএন

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে