নিউজ ডেস্ক : মিয়ানমারের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক ফেরাতে চায় বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত হিসেবে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক আজ ইয়াঙ্গুন যাচ্ছেন। মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন ‘ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি’ (এনএলডি) নেত্রী নোবেল বিজয়ী অং সান সুচির কাছে প্রধানমন্ত্রীর চিঠি পৌঁছে দেবেন পররাষ্ট্র সচিব।
পাঁচ দিনের এই সফরে মিয়ানমারের প্রশাসনিক রাজধানী নে পি তো’তে উচ্চ পর্যায়ে একাধিক বৈঠক করবেন পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক। বৃহস্পতি ও শুক্রবার এসব বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সুচির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় শেখ হাসিনার চিঠি হস্তান্তর করবেন পররাষ্ট্র সচিব। চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এনএলডি সরকারকে শুভেচ্ছা জানিয়ে দুই দেশের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ বাড়ানোর অনুরোধ জানাতে পারেন বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে।
বর্তমানে প্রতিবেশী এই দুই দেশের মধ্যে অবিশ্বাসের পাহাড় জমে আছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মতবিরোধ প্রবল। এই পরিস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে আস্থা জোরদার করে নতুন সম্পর্কের দিক উন্মোচনের আহ্বান জানাতে পারেন শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রীর এ উদ্যোগ দেশ দুটিতে উচ্চমাত্রায় যোগাযোগের ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে বলে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। এতে বাণিজ্য, জ্বালানি, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদার করা সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে। জানতে চাইলে মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) অনুপ কুমার চাকমা মঙ্গলবার বলেন, ‘মিয়ানমারে নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে বিশেষ দূত পাঠাচ্ছেন এটা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জন্য ইতিবাচক গুরুত্ব বহন করে।
এর ফলাফল খুবই ভালো হবে বলে আমি মনে করি। ইচ্ছা করলেই বিশেষ দূত পাঠানো যায় না। মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে আগে তাকে গ্রহণ করতে হবে। এখন প্রধানমন্ত্রীর দূত যাচ্ছেন মানে মিয়ানমারের নেতারা তাকে গ্রহণ করেছেন। তারা বাংলাদেশের কথা শুনতে চাচ্ছে। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে যাওয়া-আসা বাড়বে। আমাদের দুই দেশের মধ্যে কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি হবে। কথা না বললে তো কিছুই হবে না।’
এক প্রশ্নের জবাবে অনুপ কুমার চাকমা বলেন, ‘আমি মিয়ানমারে রাষ্ট্রদূত থাকাকালে প্রধানমন্ত্রী দুইবার মিয়ানমার সফর করেছেন। এখন বিশেষ দূত সেখানে গিয়ে নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সুচিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানাবেন। উভয় পক্ষের সুবিধাজনক সময়ে নিশ্চয়ই অং সান সুচি বাংলাদেশ সফরে আসবেন।’
মিয়ানমারে পঞ্চাশ বছরের সামরিক শাসনের পর গণতান্ত্রিক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এরপরও সেখানে সামরিক বাহিনী সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ফলে সেনাবাহিনীর সঙ্গেও ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে বাংলাদেশ। তাই সুচির সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হেলিঙ্গের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবেন পররাষ্ট্র সচিব।
এছাড়াও, তিনি দেশটির স্থায়ী সচিব (পররাষ্ট্র সচিব মর্যাদার) অং লিনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। এদিকে, পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের সম্মানে স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে নৈশভোজের আয়োজন করবেন মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ সুফিউর রহমান।
রোহিঙ্গা ইস্যুটি মিয়ানমারের জন্য খুবই স্পর্শকাতর হওয়ায় বাংলাদেশ আপাতত এ বিষয়ে খুব বেশি উচ্চবাচ্য করবে না। মিয়ানমার সরকার এরই মধ্যে রোহিঙ্গা শব্দ নিষিদ্ধ করেছে। রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত সংখ্যালঘু এই মুসলমানদের রোহিঙ্গা নামে ডাকার কারণে ইয়াঙ্গুনে মার্কিন দূতাবাস একাধিকবার ঘেরাও করেছে মিয়ানমারের উগ্রপন্থী বিভিন্ন গ্রুপ। রোহিঙ্গা শব্দটির অর্থ হল আদিবাসী। মিয়ানমার এটা মানতে নারাজ। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব আগেই কেড়ে নিয়েছে মিয়ানমার।
এদিকে, মিয়ানমারের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে সীমান্তে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ। মিয়ানমার থেকে প্রচুর পরিমাণে ইয়াবা বাংলাদেশে পাচার হয় বলে বিভিন্ন সময়ে সীমান্তে উত্তেজনা দেখা দেয়। এটা বন্ধে ‘বর্ডার লিয়াজোঁ অফিস’ নামে এক ধরনের ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হচ্ছে। ফলে সীমান্তে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে উভয় দেশের মাঠপর্যায়ের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকর্তারা তা সুরাহা করবেন। এছাড়া, বাণিজ্য বৃদ্ধি, শিক্ষা, এনজিও, জলবায়ু পরিবর্তন, বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির চিন্তা রয়েছে।
মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের ভিত্তি রচনা করতে ইয়াঙ্গুনে বাংলাদেশ দূতাবাস বেশ কিছু পাবলিক ডিপ্লোম্যাসির উদ্যোগ নিয়েছে। তার অংশ হিসেবে এরই মধ্যে দুই দেশের মধ্যে গণমাধ্যম পর্যায়ে সফর বিনিময় হয়েছে। সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচিও গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যে বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা দেয়ার প্রস্তাবও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে করা হয়েছে।
১৯৬২ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক বাহিনী মিয়ানমারে ক্ষমতা দখল করে। এরপর থেকে পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় সেনাবাহিনী দেশটি শাসন করে। কিন্তু বহির্বিশ্বের ব্যাপক অবরোধ আরোপের ফলে সামরিক সরকার ২০১০ সালে খোলানীতি গ্রহণ করে। ২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সুচির দল এনএলডি নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
চলতি বছরে এনএলডি সরকার গঠন করে। কিন্তু মিয়ানমারের সংবিধান মোতাবেক, ৬৬০ আসনের পার্লামেন্টে ২৫ শতাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত। এছাড়া, সীমান্তসহ বেশ কিছু ইস্যুতে সেনাবাহিনীর প্রভাব রয়েছে। এ কারণে গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেও সেনা কর্তৃত্ব বহাল রয়েছে। তবে সুচির প্রতি প্রবল জনসমর্থন এবং পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন থাকায় তাকে উপেক্ষা করতে পারছে না সেনাবাহিনী। -যুগান্তর
০১ জুলাই, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সৈকত/এমএম