সোমবার, ০৪ জুলাই, ২০১৬, ০১:৪৮:৫৪

‘সেনা অভিযানের আগেই আমরা ৫ জন দরজা ভেঙে পালিয়ে যাই’

‘সেনা অভিযানের আগেই আমরা ৫ জন দরজা ভেঙে পালিয়ে যাই’

আমানুর রহমান রনি ও চৌধুরী আকবর হোসেন : ‘রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকেই এলোপাতাড়ি গুলি করছিল জঙ্গিরা। এ সময় রেস্টুরেন্টের ভেতরে সবাই টেবিলের নিচে মাথা লুকিয়ে প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করছিলেন। আর আমরা ৯ জন একসঙ্গে টয়লেটে লুকাই। সারারাত সেখানেই ছিলাম। রাত ৩টার দিকে হামলাকারীরা আমাদের টয়লেট খুলে বের করে। তারা আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিল, আমাদের ভেতরে কেউ বিদেশি আছে কিনা। কোনও বিদেশি না থাকায় তারা আবার আমাদের টয়লেটের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয়।’  

গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলার বর্ণনা দিয়ে শেফ শিশির বৈরাগী এসব কথা বলেন। রবিবার বিকালে গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কে তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, বরিশালের আগৈলঝড়া উপজেলায় তার গ্রামের বাড়ি।  

শিশির জানান, দেড় বছর ধরে তিনি ওই রেস্টুরেন্টে বাবুর্চির কাজ করছেন। শুক্রবার সন্ধ্যায় তিনি রান্নাঘরে প্রতিদিনের মতো ব্যস্ত ছিলেন। হঠাৎ রাত সাড়ে ৮টার দিকে প্রধান বাবুর্চি দৌড়ে রান্না ঘরে যান। এ সময় শিশির মনে করেছিলেন, খাবার তৈরিতে কোনও সমস্যা হয়েছে। এরপরই গুলির শব্দ পান তারা। সঙ্গে শেফ ও শেফের সহকারীরা দৌড়ে টয়লেটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন। তারা এক সঙ্গে ওই টয়লেটে ৯ জন ছিলেন। তিনি বলেন, ‘হামলাকারীরা ঢুকেই হামলা চালায়। আমরা টয়লেটে বসে শুধু গুলির শব্দ পেয়েছি। আর কী হয়েছে, তা আমরা বলতে পারব না। আমাদের শুধু জিজ্ঞাসা করেছিল বিদেশি আছে কি না? এ ছাড়া আর কোনও কিছু করেনি।’

কিভাবে বের হলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে শিশির বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৭টার দিকে টয়লেটের ভেতরে আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এ সময় টয়লেটের শাওয়ারের ইস্পাতের পাইপ ভেঙে আমরা দরজা ভেঙে ফেলি। চিৎকার করি। আমরা গরিব, পেটের দায়ে এখানে এসেছি। আমাদের ছেড়ে দাও। তখন হামলাকারীরা রেস্টুরেন্টের এক স্টাফকে আমাদের কাছে পাঠায়। তিনি গিয়ে আমাদের বলেন, তোমাদের সবাইকে যেতে বলছে। তখন চারজন ওর সঙ্গে সামনে যায়। আমরা পাঁচজন দৌড়ে বাউন্ডারি ওয়াল ডিঙিয়ে বের হয়ে আসি। আমরা সেনাবাহিনীর অভিযানের আগেই বের হই। এরপর পুলিশ আমাদের নিয়ে আসে। জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়।’

জঙ্গিদের মধ্যে কী ধরনের কথোপকথন হয়েছিল? এর উত্তরে শিশির বলেন, ‘রেস্টুরেন্টের টয়লেটটি অনেক দূরে। আমরা গুলির শব্দ ছাড়া আর কোনও কিছু শুনতে পাইনি।’

রবিবার সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, ৭৯ নম্বর সড়কটির যে মাথায় রেস্টুরেন্টটি, সেই অংশে পুলিশের ব্যারিকেড। কড়া পাহারায় ১৬ জন পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। ভেতরে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। ব্যারিকেডের দুই পাশে কয়েকটি বাড়ি থাকলেও তার ভেতরে লোকজনের আসা-যাওয়া করতে তেমন দেখা যায়নি। যারা যেতে চেয়েছেন, তাদেরও কড়া তল্লাশি করে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়েছে।

দুপুর ১২টার দিকে সিআইডির ক্রাইম সিন একটি গাড়িতে প্রবেশ করে। তারা আলামত সংগ্রহ করে বিকেল ৪টা ১৭ মিনিটে বের হন। তবে কোনও কথা বলতে রাজি হননি তারা। দ্রুত তারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। দুপুর সাড়ে ১২টায় পুলিশের বোম্ব ডিস্পোজাল টিম প্রবেশ করে। তারা দেড়টার দিকে বের হয়ে যায়। এছাড়া দুপুর পৌনে ১টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন জাপানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও কর্মকর্তারা।

বিকেল ৫টার দিকে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, আইজিপি একেএম শহীদুল হক ও ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াসহ পুলিশ কর্মকর্তারা। পরে হাসপাতালের সামনে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘হামলাকারীরা সব দেশি জঙ্গি। দেশের কারও পরামর্শেই এই হামলা হয়েছে। আমরা তদন্ত করছি। তদন্ত শেষে জানা যাবে এর সঙ্গে আর কেউ জড়িত আছে কিনা।’

আইজিপি একেএম শহীদুল হক বলেন, ‘এই ঘটনায় মামলা হবে। মামলা কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) তদন্ত করবে।’

রবিবার সাড়ে ৫ টার দিকে ৭৯ নম্বর সড়কে মাসুদা বেগম নামে এক মধ্যবয়সী নারী তার ছেলে  শাওনকে (২৪) খুঁজতে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘গত এক বছর ধরে বড়ছেলে শাওন ওই রেস্টুরেন্টে কাজ করত। শুক্রবার রাত ৮টার সময় শাওনের সঙ্গে কথা হয়।’ তিনি বলেন, ‘শাওন আমাকে জানিয়েছিল, সে বোনাস পেয়েছে। বেতন পেলে রবিবার বাড়িতে চলে যাবে। তার কাছে সুবিধার মনে হচ্ছে না। এরপর আমরা টিভিতে এই ঘটনা দেখে এখানে ছুটে আসি। কিন্তু তারপর আর শাওনের নম্বর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’

তার সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে হাজির হন শিশির বৈরাগী। তিনি জানান, ‘শাওন রেস্টুরেন্টে বাসনকোসন ধোয়ার কাজ করত। শুনেছি সে আহত অবস্থায় মেডিক্যালে ভর্তি আছে। তার কথা শুনে শাওনের মা ইউনাইটেড হাসপাতালে ছেলের সন্ধানে দ্রুত ছুটে যান।’ -বাংলা ট্রিবিউন

৪ জুলাই ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে