সোমবার, ০৪ জুলাই, ২০১৬, ০৪:২৫:৫৩

জিম্মিমুক্তির অভিযান নিয়ে নানা প্রশ্ন?

জিম্মিমুক্তির অভিযান নিয়ে নানা প্রশ্ন?

নিউজ ডেস্ক: গত শুক্রবার হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলা এবং জিম্মি সংকটের সমাধান আরও দ্রুত করা কি সম্ভব ছিল? সেখানে কমান্ডোরা কি আরও আগে অভিযান চালাতে পারতেন? ঝটিকা অভিযান আরও আগে চালালে হতাহতের সংখ্যা কি কমানো যেত? এসব প্রশ্নই এখন ঘুরেফিরে সবার মনে আসছে। গত শনিবার সকালে ঘটনাস্থলে পুলিশপ্রধানের (আইজি) গাড়ির গতি রোধ করে একজন বাবা তাঁর মেয়ের খবর জানতে চেয়েছিলেন। জিম্মি হয়ে ছিলেন এ রকম আরও অনেকের স্বজনেরা বেদনাভরা বুক নিয়ে যখন ঘরে ফিরেছেন, তাঁদের মনে ওই প্রশ্নগুলো বারবার ফিরে এসেছে। এখনো তাঁরা এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন।

জিম্মি সংকটের বিস্তারিত, হতাহতদের সংখ্যা ও পরিচয় এবং হামলাকারীদের বিষয়ে আমরা প্রথম ও একমাত্র যে সরকারি ভাষ্য পাই, সেটি হচ্ছে আন্তবাহিনী গণসংযোগ অধিদপ্তর আয়োজিত শনিবার দুপুরের সংবাদ সম্মেলন। কোনো প্রশ্নের সুযোগ না থাকায় একটি লিখিত বিবৃতির বাইরে আর কোনো তথ্য এখনো সরকারিভাবে প্রকাশ করা হয়নি।

কর্তৃপক্ষীয় ভাষ্য বলছে, ‘১ জুলাই রাত প্রায় পৌণে নয়টায় রাজধানীর গুলশান-২ এর রোড নং ৭৯স্থ হলি আর্টিজান বেকারী নামক একটি রেষ্টুরেন্টে দুষ্কৃতিকারীরা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে প্রবেশ করে এবং রেষ্টুরেন্টের সকলকে জিম্মি করে।’ ওই বিবরণ অনুযায়ী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোর নেতৃত্বে কমান্ডো অভিযানের মাধ্যমে শনিবার সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে অপারেশন শুরু হয় এবং ৮টা ৩০ মিনিটে তার সফল সমাপ্তি ঘটে। জিম্মি পরিস্থিতি নিরসনের অভিযান পরিচালনার আগের প্রায় ১২ ঘণ্টায় কী কী ঘটেছে, তার একটা ধারণা অবশ্য বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সম্প্রচার ও প্রকাশিত সংবাদ থেকে পাওয়া যায়।

হামলার গোড়ার দিকে সেখানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ একটি উদ্যোগ নেয় এবং ঘটনার গুরুত্ব বুঝে ওঠার আগেই তাঁদের দুজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা—রবিউল করিম ও সালাউদ্দিন নিহত হন। আহত হন আরও ৩৫ সদস্য। পুলিশের এই প্রাথমিক সাড়ায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নও (র‌্যাব) শরিক ছিল এবং তাদেরও কয়েকজন আহত হন। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ঘটনাস্থল থেকে এগুলো সরাসরি সম্প্রচার করতে থাকার একপর্যায়ে র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ওই এলাকায় নিরাপত্তাবেষ্টনী মেনে চলার এবং সরাসরি সম্প্রচার বন্ধের আহ্বান জানান। তবে সম্প্রচারগুলোতে পুলিশ ও র‌্যাবের কোনো কোনো সদস্যের আচরণে স্পষ্টতই পেশাদারত্বের অভাব দেখা গেছে। ফ্ল্যাপজ্যাকেট ও হেলমেট না পরে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে যাওয়া জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোন ধরনের প্রস্তুতির চিত্র তুলে ধরে কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই তা ভেবে দেখবে।

বেনজীর আহমেদ একই সময়ে শান্তির্পূণভাবে সংকট নিরসনের লক্ষ্যে হামলাকারীদের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করেন। জিম্মিদের মুক্ত করার লক্ষ্যে জঙ্গিদের সঙ্গে আলোচনা শুরু এবং নানা ধরনের শর্তের বিষয়ে নানান গুজব রটলেও কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে নিশ্চিত করা হয় যে কোনো ধরনের যোগাযোগ স্থাপিত হয়নি। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, যেখানে আলোচনা শুরুই হয়নি, সেখানে কেন জিম্মিমুক্তির অভিযানে প্রায় ১২ ঘণ্টা অপেক্ষা করা হলো? আলোচনার মাধ্যমে জিম্মিদের মুক্ত করার কোনো দৃষ্টান্ত বা অভিজ্ঞতা কি আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর বর্তমান নেতৃত্বের আছে? তাহলে সময় অপচয়ের ব্যাখ্যা কী?

এ ধরনের অভিযানে প্রাণহানি, বিশেষ করে জিম্মিদের জন্য ঝুঁকিটা অনেক বেশি। আবার জিম্মিদের মধ্যে বিদেশিদের সংখ্যাধিক্য থাকার কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, সেই সিদ্ধান্ত নিতেই কি কালক্ষেপণ হলো? জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় আমলাতান্ত্রিকতা অথবা দীর্ঘসূত্রতা অথবা এই দুইয়ের যোগফল আরও বড় বিপদের কারণ হতে পারে।

সরকারি ভাষ্যে আমরা জেনেছি যে উদ্ধার অভিযানের আগেই ২০ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং হত্যার ধরন ছিল ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে খুন। অন্য কথায়, কুপিয়ে বা জবাই করে হত্যা। ওই ভাষ্যে আমরা আরও জেনেছি যে নিহতদের মধ্যে ১৭ জন বিদেশি এবং ৩ জন বাংলাদেশি (বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক মার্কিন নাগরিক)। অভিযান পরিচালনাকারীরা এসব হত্যার কথা কখন জানতে পেরেছেন অভিযানের আগে, নাকি পরে? এতজনকে কুপিয়ে বা জবাই করে হত্যার ব্যাপারটি মুহূর্তের বা কয়েক মিনিটের বিষয় নয় যেমনটি ঘটে আগ্নেয়াস্ত্রে। তাহলে দীর্ঘ সময় ধরে এই হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার সুযোগ তাদের কেন দেওয়া হলো?

আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে বলে বলা হয়। মুঠোফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারে সিমের বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন অপরাধ দমনে সহায়ক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বৈশ্বিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের কথিত সংবাদ সংস্থা আমাক রাতেই জানিয়েছে, তারা ২৪ জনকে হত্যা করেছে। ওই হত্যার দাবি প্রকাশের দুই ঘণ্টা পর নিহতদের ছবি প্রকাশ করে তারা। বহুল সমালোচিত সাইট ইন্টেলিজেন্সের টুইটের সময় মিলিয়ে দেখা যায়, আমাদের উদ্ধার অভিযানটি চালানো হয়েছে ওই সব ছবি প্রকাশের প্রায় দেড় ঘণ্টা পর। তাহলে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী বা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কথিত মিডিয়া মনিটরিং ইউনিটগুলো কী কাজ করল?

সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ইউনিট, স্পেশালাইজড উইপন্স অ্যান্ড ট্যাকটিকস (সোয়াট) টিম, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা শাখার মধ্যে কোথাও কি সমন্বয়ের ঘাটতি ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর আত্মানুসন্ধানের জন্য যেমন প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন আমাদের সবার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য। সন্তানহারা অভিভাবক কিংবা যেসব বিদেশি মারা গেলেন, তাঁদের স্বজনদেরও সান্ত্বনার জন্য এসব প্রশ্নের জবাব প্রয়োজন।-প্রথম আলো

৪ জুলাই ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে