মঙ্গলবার, ০৫ জুলাই, ২০১৬, ০৬:২১:৪৫

জঙ্গি তৈরি হচ্ছে নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও

জঙ্গি তৈরি হচ্ছে নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও

শরীফুল আলম সুমন : নামিদামি অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও যুক্ত হচ্ছে ভয়াবহ জঙ্গি তৎপরতায়। বিশেষ করে ইংলিশ মিডিয়াম (ইংরেজি মাধ্যম) স্কুল ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী বিপথে যাচ্ছে বেশি। এত দিন শুধু জঙ্গি কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার অভিযোগ ছিল মূলত সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে। তবে গত শুক্রবার রাতে গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্টুরেন্টে সশস্ত্র হামলা ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে জড়িত বেশির ভাগ জঙ্গিই নামিদামি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বলে জানা যাচ্ছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ আগে থেকেই থাকলেও তা ঠেকাতে কার্যকর উদ্যোগ নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেখভালকারী একমাত্র সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) শুধু কোর্স অনুমোদন করেই তাদের দায়িত্ব শেষ করছে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের দিকেও তেমন গুরুত্ব নেই। এমনকি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো এখনো সরকারের নজরদারির বাইরে। ফলে সহজেই বিপথে যাচ্ছে অনেক শিক্ষার্থী।

২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নাশকতা পরিকল্পনার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া বাংলাদেশি তরুণ কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিস দেশে থাকার সময় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেন। গত বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি ব্লগার রাজীব হায়দারকে হত্যার সঙ্গেও জড়িত ছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই পাঁচ শিক্ষার্থী, যাদের সে সময়েই বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। নাফিসসহ এই ছয়জন ইলেকট্রনিক অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং (ইটিই) এবং ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের ছাত্র ছিল। গত শুক্রবার গুলশানে নিহত পাঁচ হামলাকারীর মধ্যেও একজন নর্থ সাউথের এবং একজন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। অন্যরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কলাসটিকা, টার্কিশ হোপসহ আরো একটি স্কুলের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী।

জানা যায়, জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের দায়ে এখন পর্যন্ত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বহিষ্কৃত হয়েছেন পাঁচজন শিক্ষক ও ১৪ জন শিক্ষার্থী। তবে অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও শিক্ষার্থীরা জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত থাকার অভিযোগে বহিষ্কার হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার ভয়ে তা প্রকাশ করা হয় না। পরীক্ষা না দেওয়া, অনিয়মিত থাকা, খারাপ ফলসহ নানা কারণ দেখিয়ে ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়। ফলে ঠিক কতজন জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার কারণে বহিষ্কৃত হলো তা আড়ালেই থেকে যায়। পূর্ণাঙ্গ তথ্যসহকারে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ডাটাবেইস করার কথা থাকলেও তা এখনো করেনি কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।

গুলশানে নিহত জঙ্গি নিবরাস ইসলামও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস ফ্যাকাল্টির শিক্ষার্থী ছিল। ২০১১ সালের সামার সেমিস্টারে সে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও ২০১২ সালের স্প্রিং সেমিস্টার পর্যন্ত শেষ করে। এর পর থেকে বিনা নোটিশেই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকে। পর পর দুই সেমিস্টারে অনুপস্থিত থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার ছাত্রত্ব বাতিল করে। এ ছাড়া গত শুক্রবার গুলশানের হোটেলে জিম্মিদশা থেকে ছাড় পাওয়া প্রকৌশলী আবুল হাসনাত রেজা করিমও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস ফ্যাকাল্টির সাবেক শিক্ষক। তিনিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সন্দেহের তালিকায় রয়েছেন।

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের পরিচালক ড. ইমদাদুল হক বলেন, ‘হাইকোর্টের এক রুলের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের একটি তদন্ত কমিটি হয়েছিল। আমরা কোর্টে সেই রিপোর্ট জমা দিয়েছি। তবে রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০০ সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। শিক্ষার্থীদের সব কাজই এখন আমাদের নখদর্পণে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থী। এর মধ্যে প্রায় ছয় হাজারের প্রয়োজনীয় স্ট্যান্ডার্ড নেই। আমাদের কাজ শিক্ষা প্রদান করা। বাউন্ডারির বাইরে গোয়েন্দাবৃত্তি করা আমাদের দায়িত্ব নয়। একজন শিক্ষার্থী সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা থাকে। ফলে পরিবারেরই উচিত তার সন্তান কী করছে সেদিকে নজর রাখা। তবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০টি ক্লাব রয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের এসব ক্লাবের কার্যক্রমে প্রতিনিয়ত অন্তর্ভুক্ত করি।’

অভিযোগ রয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক খণ্ডকালীন শিক্ষক ও ভিজিটিং প্রফেসরের বিরুদ্ধে। ওই শিক্ষকরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই ঢোকেন। এরপর শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করেন জঙ্গি কার্যক্রমে। বিশেষ করে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরাই তাদের টার্গেট হয়। মধ্যপ্রাচের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা কোনো কোনো শিক্ষকও এখন ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কাজ করছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁরাই শিক্ষার্থীদের জঙ্গি কার্যক্রমে যুক্ত করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু ইউজিসির কাছে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা শিক্ষকতা করছেন এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য নেই। ফলে দেশি-বিদেশি অনেক ভিজিটিং প্রফেসরই এখনো সরকারের নজরদারির বাইরে রয়েছে বলে জানা যায়।

ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির উপাচার্য প্রফেসর ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী বলেন, ‘অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ই পার্ট টাইম শিক্ষক ব্যবহার করে। এসব শিক্ষকের কেউ কেউ এই জঙ্গি কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের দীক্ষা দিয়ে থাকে। এমনকি তারা ছাত্রদের নিয়ে গোপনে বৈঠকও করে। প্রথমে বোঝানো হয়, এরপর সরাসরি জঙ্গি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা হয়। যেসব বিশ্ববিদ্যালয় অধিক পার্ট টাইমার ব্যবহার করে ও ধর্মীয় উদ্দেশ্য নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে তাদের ওখানেই মূলত জঙ্গি তৈরি হচ্ছে।’

শিক্ষার্থীদের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বের ব্যাপারে অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, ‘প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ওপর নজর রাখা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। একজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে যদি কিছু শিক্ষার্থীকে দেওয়া হয়। তাহলে তাঁরই দায়িত্ব ওই শিক্ষার্থীর খবর রাখা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনিই দায়িত্ব পালন করবেন। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ও এই পদ্ধতিতে চলছে। এতে একজন শিক্ষকে ২০ থেকে ৩০ জন শিক্ষার্থীর খবর রাখতে হবে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চালু রাখতে হবে। একজন শিক্ষার্থী যাতে পড়ালেখার বাইরের সব সময়টুকুই সাংস্কৃতিক চর্চা ও সমাজের সেবায় ব্যয় করেন।’

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও ফারইস্ট ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন বলেন, ‘খণ্ডকালীন বা ভিজিটিং শিক্ষকদের জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমার কাছেই ধরা পড়েছেন একজন শিক্ষক, যিনি আগে উচ্চপদে ছিলেন এখন নিম্নপদেও কাজ করতে আগ্রহী। তাহলে তার নিশ্চয়ই অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে? তবে শিক্ষার্থীদের প্রতি সবচেয়ে বড় দায়িত্ব অভিভাবকদের। তারা যদি সব সময় খোঁজখবর রাখেন তাহলে সন্তানরা বিপথে যেতে পারবে না। অনেক অভিভাবকই সন্তানদের খোঁজ রাখেন না। তারা অনেক টাকা দেন ও ফুলটাইম গাড়ি দেন। এতে বেশির ভাগই অন্যরকম হয়ে যায়।’

দেশে শিক্ষা বোর্ড অনুমোদিত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সংখ্যা প্রায় দুই শ। এর বাইরেও আরো কিছু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আছে। অনুমোদন নেওয়া ছাড়া সরকারের সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো যোগাযোগ নেই। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর কোনো তথ্যই সরকারকে দেয় না তারা। ইচ্ছামতো বেতন ও ফি আদায় করে এসব ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। এমনকি বাংলাদেশে এসব স্কুল হলেও এই দেশের কোনো ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিষয়ও যুক্ত নেই তাদের কোর্স-কারিকুলামে। অভিভাবকদের সঙ্গে স্কুল কর্তৃপক্ষ রূঢ় আচরণ করে। এ ছাড়া সরকারের কোনো নির্দেশনাও মানে না এসব স্কুল।

দেশে বর্তমানে ৯৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসবের অধিকাংশই গড়ে উঠেছে স্বল্প পরিসরে। একটি ভবনের দু-একটি ফ্লোর নিয়েও চলছে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়। পড়ালেখাও তেমন হয় না বললেই চলে। আর সাংস্কৃতিক কার্যক্রম তো দূরের কথা। খেলাধুলারও কোনো আয়োজন নেই এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফলে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার বাইরে অন্য কোনো কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার সুযোগ নেই। এতে অনেকেই প্রথমে জড়িয়ে পড়ে মাদক সেবনে। মাদকের টাকা জোগাড় করতেও কেউ কেউ ভিড়ছে বিভিন্ন জঙ্গি দলে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, ‘সব শিক্ষকই একসময় ছাত্র ছিলেন। ছাত্রাবস্থায় তাঁর পারিবারিক মূল্যবোধ কেমন ছিল সেটাই বড় বিষয়। শিক্ষক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যে তাঁর আগের জীবন মুছে যাবে তা কিন্তু নয়। এখন একজন স্কুলের ছাত্রের হাতেও বাবা-মা স্মার্ট ফোন দিচ্ছেন। কিন্তু সেই ফোন দিয়ে সে কী করছে সে খেয়াল রাখছেন না। আর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকেও আমরা বাক্সবন্দি করে ফেলেছি। যে অ্যাকাউন্টিং পড়ে সে ইতিহাস জানে না। ফলে শিক্ষার্থীরা সহজেই অন্য পথে যাচ্ছে। তবে সম্প্রতি আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস পড়াতে হবে। বাংলা বিভাগ খুলতে হবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ তথ্যও আমরা চেয়েছি। তাঁদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, বেতন কত—সব হিসাবই আমরা চেয়েছি। তবে অনেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অস্বচ্ছতার আশ্রয় নেয়। আমরা বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরির সময়ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য চাই। কিন্তু সব ক্ষেত্রে তা পাওয়া যায় না। ১৯৭৩ সালে যখন ইউজিসি গঠিত হয় তখন বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ছয়টি আর এখন ১৩৮টি। অথচ ইউজিসির জনবল বাড়েনি। ফলে আমাদের সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়েও বাধার সৃষ্টি হচ্ছে।’ কালেরকণ্ঠ

৫ জুলাই ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে