শুক্রবার, ০৮ জুলাই, ২০১৬, ০৩:৪৫:৫৯

গুলশানে যেভাবে ৭ জাপানিকে খুন করে জঙ্গিরা, শোনালেন এক জিম্মি

গুলশানে যেভাবে ৭ জাপানিকে খুন করে জঙ্গিরা, শোনালেন এক জিম্মি

ঢাকা : রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্টেরেন্টে যেভাবে ৭ জাপানিকে খুন করে জঙ্গিরা তা শোনালেন সেখানের এক জিম্মি।  জিম্মি জাপানি নাগরিকদের সেদিন হামলা শুরুর অল্প সময়ের মধ্যেই খুন করা হয়।

রেস্টুরেন্টটিতে চাকরি করা একজন বাংলাদেশি ওইদিন প্রাণে বেঁচে ফিরেছিলেন।  খুব কাছে থেকে তিনি দেখেছিলেন ৭ জাপানি নাগরিকের মৃত্যু।

ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকা ব্যক্তিটি জাপানের গণমাধ্যম দ্য জাপান টাইমসে একটি বিশেষ সাক্ষাৎকারে সেদিনের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দেন।  সাক্ষাৎকারের অংশটুকু দেয়া হলো-

রেস্টুরেন্টটিতে সেদিন ২০বিদেশি অতিথির মধ্যে ৭ জাপানি নাগরিক ছিলেন, যাদের নৃশংসভাবে খুন করে হামলাকারীরা।

সাক্ষাৎকারে ওই বাংলাদেশি জানান, ঘটনার দিন যখন বুঝতে পারলেন রেস্টুরেন্টটিতে হামলাকারীরা প্রবেশ করেছে ওইদিন তিনি প্রাণ বাঁচাতে রেস্টুরেন্টটির শীতল কক্ষে আশ্রয় নেন।  

তার সাথে একজন জাপানি নাগরিকও প্রাণ বাঁচাতে সেখানে ঢুকেছিলেন, যিনি পরে হামলাকারীদের গুলিতে নিহত হন।

ঘটনার বর্ণনাকারী ব্যক্তিটি কাজ করতেন গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টটির উপরের তলায়।  বলেন, সেদিন তিনি পাস্তার উপকরণ আনতে ভেতরে শীতল কক্ষে গেলে হঠাৎ বাইরে থেকে জোরে জোরে ‘আল্লাহু আকবার’ বলতে শোনেন, আর সাথে ছিল গুলির শব্দ।

তিনি শীতল কক্ষটির বাইরে তাকালে দেখেন, অতিথিদের বেশ কয়েকজন মাটিতে পড়ে আছে, যাদের কিছুক্ষণ আগেই খাবার পরিবেশন করা হয়েছিল।  

ওই সময়ই একজন জাপানি নাগরিক তার কাছে ওই শীতল কক্ষে আসতে হাতজোড় করে মিনতি করতে থাকে।  

তবে ওই কক্ষটি ভেতর থেকে আটকানোর কোনো ব্যবস্থা ছিল না।  ব্যক্তিটি দেখেন, হামলাকারীরা হালকা ব্যায়াম করছিল, দেখে মনে হচ্ছিল তারা একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

হামলার পরপরই রাত সাড়ে আটটা থেকে সাড়ে দশটা হবে হামলাকারীরা হঠাৎ সবাই চুপচাপ হয়ে যায়।  একজন বলে- ‘আর কেউ বাকি আছে কি-না দেখো।’

প্রথমে একজন ভেতরে প্রবেশ করে আর দুজন রেস্টুরেন্টটির দরজায় দাঁড়িয়ে অবস্থান নেয়।
তারা শীতল কক্ষের ভেতর আশ্রয় নেয়া জাপানি নাগরিকটিকে বের করে নিয়ে যায়।

এ সময় সাক্ষাৎকার প্রদানকারী হামলাকারীদের কাছে প্রাণভিক্ষা চান।  সে সময় দরজার সামনে একজন এসে থামে, পরে ব্যক্তিটি জানতে পেরেছিলেন, ছেলেটি ছিল ২০ বছর বয়সী রোহান ইমতিয়াজ, যে একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতার সন্তান।  সে বলছিল- ‘চিন্তা করো না।  বেরিয়ে যাও।’

সেখান থেকে বেরিয়ে তিনি দেখেন, রেস্টুরেন্টটির রক্তাক্ত ডাইনিংয়ে সব জাপানি নাগরিককে একত্রে জড়ো করা হয়েছে।  লোকটি জানান, ‘আমি চার থেকে পাঁচজন জাপানি নাগরিককে দেখেছিলাম।’

যখন তিনি দেখার চেষ্টা করেন জাপানের নাগরিকটি কোথায় গেল, দেখলেন, একজন হামলাকারী জাপানের নাগরিকটির দিকে বন্দুক তাক করে আছে, এর কিছুক্ষণ পরই তিনি দুটো গুলির আওয়াজ পান।

তবে সামনে দেয়াল থাকায় কিছুই দেখতে পাননি তিনি।  বলেন, ‘সে তরুণ ছিল, আমরা একটা শীতল কক্ষের ভেতর লুকিয়েছিলাম, আমি তাকে তার নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু এখন তার নাম মনে পড়ছে না।’

ওই সময় তিনি রেস্টুরেন্টটির বিভিন্ন টেবিলের নিচে এবং বাইরে ছড়িয়ে থাকা বিদেশিদের লাশ দেখতে পান।

‘এক ভারতীয় মহিলা যে হামলাকারীদের গুলিতে খারাপভাবে আহত ছিল, তাকেও বড় একটা ছুরি দিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয়, কোনো প্রকার দয়া ছাড়া’।

তিনি বলেন, তারা নিজেদের আইএস পরিচয় দিচ্ছিল।  জিন্স আর টি-শার্ট পরা ছেলেগুলোকে অনেক শান্ত দেখাচ্ছিল।  তারা ইংরেজি আর আরবিতে অনর্গল কথা বলছিল এবং অনবরত তাদের সেলফোনে কথা বলছিল।

২২ বছর বয়সী নিব্রাস ইসলাম, যাকে তাদের নেতা বলে মনে হচ্ছিল, বলছিল- ‘বাংলাদেশিদের চিন্তার কিছু নেই।’ আরো ৭ সন্দেহভাজনের মধ্যে আরেকজন ১৮ বছর বয়সী মীর সমিহ মুবাশ্বির, প্রত্যেকের এবং সবার সাথে কুশল বিনিময় করছিল। লোকটির ভাষায়, ‘তার আচরণ অদ্ভুত ছিল।’

পরদিন সকালে বাংলাদেশিদের ছেড়ে দেয়ার পর হামলাকারীদের একজন রোহান ইমতিয়াজ কোরআন থেকে কিছু তেলাওয়াত করে এবং বলে, ‘এখন আমরাও মৃত্যুর জন্য তৈরি।’

তিনি জানান, এরপর কমান্ডোদের দেখেছিলেন যারা অস্ত্রসহ হামলাস্থল আর্টিজানে প্রবেশ করে।  যখন তারা দ্বিতীয় তলায় পালানোর চেষ্টা করে, তখনই প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যায়।

এর কিছুক্ষণ পরই হামলার বর্ণনা দেয়া লোকটিকে কর্তৃপক্ষ তাদের হেফাজতে নেয়।

‘নিহত জাপানিদের জন্য আমার গভীর আবেগ ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না, এটা খুবই দুঃখজনক - জানায় বেঁচে যাওয়া লোকটি।

উল্লেখ্য, শুক্রবার গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা।  গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের ওই রেস্টুরেন্টে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পুলিশের গোলাগুলির ঘটনায় ডিবির সহকারী (এসি) রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিন নিহত হন।

হামলাকারীরা রাতেই দেশি-বিদেশিসহ ২০ জনকে গলা কেটে হত্যা করে।  এদের একজন ইশরাত আখন্দ।  শনিবার সকালে রেস্টুরেন্টটিতে কমান্ডো অভিযান চালানো হয়।  অভিযানে ৬ হামলাকারী নিহত হয় বলে আইএসপিআইআরের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

আর্টিজানের মালিকের দাবি, ৬ জনের একজন সাইফুল চৌধুরী।  তিনি আর্টিজানের কুক ছিলেন। এরই মধ্যে বাকি ৫ হামলাকারীর পরিচয় প্রকাশিত হয়েছে।

তারা হলেন নিব্রাস ইসলাম, রোহান ইমতিয়াজ, মীর সামিহ মোবাশ্বির, খায়রুল ইসলাম পায়েল এবং শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল।  আত্মীয় ও পরিচিতজনরা তাদের ছবি দেখে শনাক্ত করেন।  ৫ হামলাকারীর প্রত্যেকেই বেশ কিছুদিন আগে বাসা ছেড়ে হঠাৎ উধাও হয়ে যায়।  এদের তিনজন রাজধানীর বিভিন্ন নামিদামি স্কুল-কলেজে পড়েছে বলে তাদেরই বন্ধুরা দাবি করেছে।  এদের মধ্যে দুজন মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতো।  
৮ জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে