মোশতাক আহমদ : ঈদের নামাজের আগে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার ঈদ-ময়দানের কাছে যে জঙ্গি হামলা হয়েছে তা জামায়াত-শিবির ঘটিয়ে থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন সেখানকার প্রধান ইমাম মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদবিরোধী লাখো আলেমের ফতোয়ার কারণে ক্ষুব্ধ জামায়াত-শিবির। তাদের লোকেরা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে এ হামলা চালিয়ে থাকতে পারে। তারা আর কোনো উপায় না পেয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে ফায়দা নিতে চাচ্ছে।
তিনি বলেন, ইরাকে আইএস বা ইসলামিক স্টেট নামে পরিচিত যে জঙ্গি সংগঠনের আবির্ভাব তার সঙ্গে বাংলাদেশের জামায়াত-শিবিরের আদর্শিক সম্পর্ক ও যোগসূত্র রয়েছে। তারা একই ধরনের চিন্তা-চেতনার ধারক। জামায়াতের ধর্মগুরু আবুল আলা মওদুদী ও মিসরের নিষিদ্ধ সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমিনের (মুসলিম ব্রাদারহুড) সর্বোচ্চ নেতার সরাসরি যোগাযোগ ছিল। মওদুদীর লেখা বইয়ের মুখবন্ধ লিখে দিয়েছিলেন মিসরের সেই নেতা, যাঁর নাম সৈয়দ কুতব। তাকফির ওয়াল-হিজরারও নেতা ছিলেন তিনি। মওদুদীর আদর্শে গড়া জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে আইএসের প্রক্সি দিচ্ছে বলেও জানান মাওলানা মাসউদ।
তিনি বলেন, শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার সঙ্গে জড়িত একজন দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের যে এলাকার বাসিন্দা, সেই এলাকা জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত।
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ, কারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মদদ দিচ্ছে, এ বিষয়ে সরকার, জনগণ বা আলেমসমাজের কী করণীয় প্রভৃতি বিষয়ে গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠকে সবিস্তারে বলেন দেশের বিশিষ্ট এই আলেম।
মাওলানা মাসউদ বলেন, ‘জঙ্গিবাদবিরোধী লক্ষাধিক আলেমের স্বাক্ষর সংগ্রহের সময় জামায়াত-শিবির বাধা দিয়েছিল। তারা ইসলাম, দেশ ও মানবতার শত্রু। তাদের কর্মকাণ্ডের নিন্দা করার ভাষা আমাদের নেই। আমরা এক লক্ষ উলামায়ে কেরাম জঙ্গিবাদী হামলার নিন্দা জানাচ্ছি। সাহাবায়ে কেরাম জিহাদ করেছেন বিশৃঙ্খলা দমনের জন্য। আর তারা জিহাদের নামে ফেতনা সৃষ্টি করছে।’
তিনি বলেন, শোলাকিয়ার ইতিহাসে এমন হামলা আগে কখনো হয়নি। এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড ইসলাম সমর্থন করে না। নৃশংস হত্যায় আল্লাহর নাম ব্যবহার করা আরো জঘন্য অপরাধ। এই জঙ্গিদের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করতে হবে। দেশের আলেমসমাজের প্রতি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান তিনি।
ফরীদ উদ্দীন মাসউদ বলেন, হামলাকারীরা বলছে তারা ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু ইসলাম কি বলেছে যে পবিত্র ঈদের নামাজ বাদ দিয়ে নিরীহ মানুষকে হত্যা করো; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা করো?
তিনি বলেন, সন্ত্রাসীরা জানে যে তারা ছোটখাটো হামলা করে দেশের বা সরকারের তেমন ক্ষতি করতে পারবে না। তার পরও তারা এসব করে দেশে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চায়, এসব করে তারা কোনো ফায়দা নিতে চায়।
মাওলানা মাসউদ জানান, শোলাকিয়া ময়দানে তিনি হেলিকপ্টারে করে গিয়েছিলেন, ঈদের নামাজের প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা আগে। সেখানে নেমেই তিনি গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান। প্রথমে ভেবেছিলেন, এ আওয়াজ হয়তো নামাজের আগে প্রতিবছর রেওয়াজ অনুযায়ী পুলিশ যে তিন রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে তার। পরে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, জামাত শুরু হতে পৌনে এক ঘণ্টা বাকি। তখন তাঁর মনে হলো, এটা জঙ্গি হামলা সম্ভবত। কিছু পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে জানতে পারলেন, জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পুলিশের গোলাগুলি হচ্ছে।
মাওলানা মাসউদ বলেন, এত কিছুর পরও শোলাকিয়ায় ঈদগাহে গিয়ে নামাজের ইমামতি করতে চেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু আইনশৃঙখলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁকে যেতে দেয়নি। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘আমার ইমামতি করাই উচিত ছিল। এখন জঙ্গিরা বলতে থাকবে যে আমাকে তারা ইমামতি করতে দেয়নি।’
ওই দিন জামাতের আগে প্রায় পাঁচ লাখ মুসল্লিকে জঙ্গিবাদের কুফল ও ধর্মের সঙ্গে এর যে কোনো সম্পর্ক নেই সেসব বিষয়ে বলার ইচ্ছা ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পীড়াপীড়িতে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন।
জঙ্গিবাদবিরোধী লাখো আলেমের ফতোয়ার উদ্যোক্তা মাওলানা মাসউদ বলেন, দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নিয়ে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে ও জাতীয় ঈদগাহে কোনো বক্তব্য দেননি ইমামরা। এতে তিনি আহত হয়েছেন, হতাশ হয়েছেন। কারণ জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এসব মজলিসে যদি জঙ্গিবাদবিরোধী বয়ান না হয় তাহলে মানুষ জঙ্গিবাদের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে কিভাবে জানবে।
তিনি বলেন, জঙ্গিবাদবিরোধী ফতোয়া দেশের মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারলে উঠতি বয়সের যুবকদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া অনেকাংশে বন্ধ হবে। প্রত্যেক সংসদ সদস্যকে এই ফতোয়ার এক লাখ কপি বিতরণের জন্য অনুরোধ জানাবেন তিনি।
প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেল যাতে জঙ্গিবাদবিরোধী বক্তব্য প্রচারের জন্য আলেমদের বয়ান কমপক্ষে আধাঘণ্টা প্রচার করে সেই অনুরোধও জানাবেন তিনি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সব ইমাম প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এ ফতোয়ার বিষয়ে অবহিত করা বাধ্যতামূলক করার সুপারিশও করবেন। প্রাইমারি স্কুল থেকে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়—সব পর্যায়ের সিলেবাসে এ ফতোয়ার বিষয়ে পড়ানোর ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ জানাবেন সরকারের কাছে।
তিনি বলেন, দেশের সব আলেম, মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জিনের জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া জরুরি। না হয় একে একে সব মসজিদ ও মাদ্রাসা আক্রান্ত হবে, অস্তিত্বের সংকটে পড়বে সবাই।
মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ বলেন, জঙ্গিবাদের কারণে তিনি আতঙ্কিত নন। তাঁর বিশ্বাস, সরকার ও জনগণ সতর্ক থাকলে জঙ্গিরা বুদবুদের মতো উবে যাবে। পবিত্র কোরআন শরিফে বলা আছে, বাতিলের জন্মই হলো নিশ্চিহ্ন হওয়ার জন্য। তাই জঙ্গিরাও বেশি দিন বাংলার জমিনে টিকতে পারবে না। তারা এ দেশের মাটি স্পর্শ করতে পারবে না। আর মাটি না পেলে তাদের টিকে থাকার কোনো সুযোগ নেই। এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাক-হানাদারদের হটিয়েছে, জঙ্গিদেরও দেশ থেকে বিতাড়িত করবে। সে সময় বেশি দূরে নয়। -কালের কণ্ঠ
১০ জুলাই, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সৈকত/এমএম