বাহাউদ্দিন ইমরান : ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! স্বদেশের মুক্তির জন্য যে যুবক রাইফেল কাধে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেরিয়েছেন শত্রুদের বিনাশ করতে, আজ তাকেই কিনা দু’মুটো ভাতের জন্য দেশত্যাগী হতে হলো। সেই যুবক আজ বয়সের ভারে ন্যুব্জ।পেট চালাতে স্বদেশের এক বীর আজ ভিক্ষুকের বেশে পরদেশের পথে পথে ঘুরছে।
মুক্তিযোদ্ধা মীরন শেখ (৬৯)। যশোরের কেশবপুর মহাদেবপুর থানার বাসিন্দা। মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও বছরের পর বছর সরকারি ভাতা থেকে বঞ্চিত। মুক্তিযুদ্ধে শত্রুদের গুলিতে পঙ্গু ও বাম হাতের দুটি আঙ্গুল হারানোয় কাজ করেও জীবিকা নির্বাহ করতে অপারগ। দেশে ভিক্ষে করলে যদি মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান হয়, এই ভেবে লোকলজ্জার ভয়ে নিজ এলাকা ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে গিয়ে ভিক্ষা করে পেট চালাচ্ছেন মীরন শেখ।
মঙ্গলবার যশোরের সাবেক সাংসদ এম সাখাওয়াত হোসেনসহ ৯ আসামির বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থাপনকালে এ তথ্য জানা যায়। এ সময় প্রসিকিউটর রেজিয়া সুলতানা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম আনোয়ারুল হকের নেতেৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে মামলার অন্যতম এই সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা মীরন শেখের বিষয়ে তার বক্তব্য পেশ করছিলেন।
মামলার যুক্তি উপস্থাপন শেষে মুক্তিযোদ্ধা মীরন শেখের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রসিকিউটর রেজিয়া সুলতানা বাংলামেইলকে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা মীরন শেখ এ মামলার ষষ্ঠ সাক্ষী ও আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের মধ্যে ৫ম অভিযোগের ভিকটিম। তিনি বর্তমানে ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে পঙ্গু হয়ে যান এবং তার হাতের দুটি আঙ্গুলও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শরীর থেকে কেটে বিচ্ছিন্ন করা হয়।
তাই শারীরিকভাবে উপার্জন করে সংসার চালানোয় পুরোপুরি অক্ষম তিনি। লোকলজ্জার ভয়ে বাংলাদেশের এই মুক্তিযোদ্ধা এখন ভারতের ভিক্ষুক।’
তিনি আরো বলেন, ‘মীরন শেখ নিঃসন্তান। স্ত্রীকে নিয়েই তার বসবাস। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে কাজ করতে পারেন না। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে যে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দেয়া হয় তা থেকেও বঞ্চিত তিনি।’
‘মুক্তিযোদ্ধা মীরন শেখের বাড়ি যশোরে (বাংলাদেশ-ভারত বর্ডারের পাশাপাশি) হওয়ায় বাঁচার আকুতি নিয়ে হেঁটে হেঁটে তিনি বর্ডার পার হয়ে ভারতে যান। সেখানে গিয়ে তিনি ভিক্ষা করে কয়েকমাস পরপর দেশে ফিরে আসেন। আর এভাবেই তাকে সংসার চালাতে হয়। অভাবের সংসারে পায়ে ভর দিয়ে হাঁটার মত একটি স্ক্র্যাচ কেনার মত সামর্থ্যও নেই তার’- বলেন রেজিয়া সুলতানা।
ভিক্ষা করতে অন্য দেশে (ভারতে) কেন? জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা মীরন শেখ এর আগে ট্রাইব্যুনালকে জানিয়েছিলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও ভাতা পাই না। আবার অক্ষম। তাই চলাফেরা বা কাজ করে উপার্জন করতে পারি না। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে নিজ এলাকায় ভিক্ষা করলে মুক্তিযোদ্ধাদের মান-সম্মান যাবে। তাই লোকলজ্জার ভয়ে ভারতে গিয়ে ভিক্ষা করি’।
প্রসিকিউটর রেজিয়া সুলতানা বলেন, ‘সাক্ষী হিসেবে আমরা মুক্তিযোদ্ধা মীরন শেখকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করেছিলাম। তিনি স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। তাই তার দুরাবস্থা দেখে আমরা প্রসিকিউশন থেকে নিজেরা তাকে এককালীন কিছু আর্থিক সাহায্য করেছিলাম। কিন্তু সেই সাহায্য তার জন্য যথেষ্ট নয়!’
উল্লেখ্য, এর আগে গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর সাবেক সাংসদ এম সাখাওয়াত হোসেনসহ ৯ আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। মোট ১২ আসামির মধ্যে বাকি তিনজনের সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় তাদেরকে অব্যাহতি দেন আদালত।
চলতি বছরের ১৬ জুন সাখাওয়াতসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়। এর আগে আদালত ৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আত্মসমর্পণের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন।
২০১২ সালের ১ এপ্রিল থেকে এ মামলায় তদন্ত শুরু করে গত ১৪ জুন শেষ করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক খান। মুক্তিযোদ্ধাসহ ৩২ জনকে এ মামলার সাক্ষী করা হয়েছে।
১৯৯১ সালে জামায়াতের পক্ষে নির্বাচনে অংশ নিয়ে যশোর-৬ আসন থেকে সাখাওয়াত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু মেয়াদপূর্তির আগেই জামায়াত ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দেন। মাওলানা সাখাওয়াত গত সংসদ নির্বাচনে যশোর-৬ আসনে জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন।
আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ৫টি হলো:
অভিযোগ ১: যশোরের কেশবপুর উপজেলার বোগা গ্রামে এক নারীকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন এবং ধর্ষণ।
অভিযোগ ২: একই উপজেলার চিংড়া গ্রামের চাঁদতুল্য গাজী ও তার ছেলে আতিয়ারকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যা।
অভিযোগ ৩: কেশবপুরের চিংড়া গ্রামের মো. নুরুদ্দিন মোড়লকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন।
অভিযোগ ৪: কেশবপুরের হিজলডাঙার আ. মালেক সরদারকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও খুন।
অভিযোগ ৫: কেশবপুরের মহাদেবপুর গ্রামের মীরন শেখকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন এবং ওই গ্রামে অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন। -বাংলামেইল
১২ জুলাই, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম