উদিসা ইসলাম : ১ জুলাইয়ের গুলশান হলি আর্টিজান বেকারির হামলার ঘটনায় সারারাত অন্য সহকর্মীদের সাথে বাথরুমে লুকিয়ে কাটানো এবং জিম্মি শিশির বৈরাগী চার সহকর্মীর সাথে পালিয়ে বেঁচেছিলেন।
মাত্র একরাতের ভয়াবহ ঘটনা তার জীবনকে রাস্তায় টেনে নামাবে, তা তিনি ভাবতে পারেন না আজও। মাসে ২০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি থেকে একদিনে নামতে বাধ্য হয়েছেন ফুটপাতে। তবুও স্বপ্ন দেখেন, প্রিয় প্রতিষ্ঠানটি আবারও চালু হবে আর তিনি জানেন মালিক তাদের সবাইকেই একদিন কাজে ফিরিয়ে নেবেন।
‘আজ চারদিন গুলশানের ফুটপাতে ব্রাশ বিক্রি করি। ধুলাবালির মধ্যে বসে থাকা আর মাঝেমধ্যেই পুলিশের ধাওয়া খাওয়া। এ জীবনের কথা স্বপ্নেও ভাবিনি। জঙ্গিরা আমাদের জীবন বদলে দিয়ে গেছে’ কথাগুলো বলছিলেন আর্টিজানের পাচক শিশির।
তিনি বলেন, চাকরি হয়ত একটা পেয়ে যাবো কিন্তু এত ভালো প্রতিষ্ঠান পাবো না। আমাদের সবমিলিয়ে সারা মাসের যে বেতন, অষ্টম শ্রেণি পাস আমার মাথার ওপর সারাদিনরাত এসি ঘুরতো, আমরা তিন মাসে একবার পোশাক ও বাটার জুতা পেতাম। সে কাপড়, জুতা নষ্ট হোক বা না-হোক। এত গোছানো জীবন একদিনে তছনছ হয়ে গেল!
সে ভয়াবহ রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আমি ভেতরের কিচেনে ছিলাম। বাইরে যে শেফ খাবার ওয়েটারদের হাতে তুলে দেন, তাদের একজন হুট করে দৌড় দেওয়ায় আমাদের সন্দেহ হয় এবং আমি সামনের দিকে দৌড়ে দিতে গিয়ে দেখি, কেউ কেউ যারা আমার আগে ওদিকে দৌড় দিয়েছিলেন তারা পিছিয়ে আসছেন।
তখনই আমার মনে হয়, সন্ত্রাসীদের কারণেই সামনে যাওয়া যাচ্ছে না হয়ত। ওমনি আমরা কয়েকজন পেছনের দিকে দৌড় দেই এবং একটি টয়লেটে গিয়ে লুকিয়ে পড়ি। তারপরের ভয়াবহ সময়ে একমাত্র ভরসা ছিল আর্টিজানের মালিক সাদাত।
শিশির বলেন, আমি মালিককে ফোন করে ঘটনা বলি। আর কিছু বলতে পারিনি আমি। এরপর থেকে সারারাত আমরা নয়জন ওই টয়লেটে আটকা ছিলাম।
নিশ্বাস নেওয়ার জায়গা নেই। দম বন্ধ হয়ে আসছে যখন, তখন মালিককে ফোন দেই- আমরা আর পারছি না। আমাদের নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সেসময় তিনি আমাদের পরামর্শ দেন আমাদের শরীর যেন আমরা যেকোনও উপায়ে ভিজিয়ে রাখি।
আমরা যেন চেষ্টা করি, কোনোরকমে বেঁচে থাকতে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই অভিযান শুরু হবে। শুরু থেকেই তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই অভিযান শুরু হবে বলে আমাদের আশ্বস্ত করতে থাকেন। আর আমরা বাঁচার আশায় নিজেদের টিকিয়ে রাখি।
`এর মধ্যে জঙ্গিরা কেউ আসেননি আপনাদের ওদিকে?' প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ওরা রাত ১২টার পর থেকে আমাদের এদিকে আসা-যাওয়া শুরু করে। পরে রাত আড়াইটার দিকে এসে আমাদের একে একে হাত তুলে বের হয়ে আসতে বলে। আমরা চিৎকার করে বলতে থাকি, আল্লাহর ওয়াস্তে আমাদের বাঁচান। আমি হিন্দু মানুষ, সামনে যেতে ভয় পাচ্ছিলাম।
চোখেমুখে চাপা আতঙ্ক আর কান্নাভেজা গলায় শিশির বলেন, বেঁচে গেছি, আপা! একদম প্রাণটা যেন কীভাবে ভিক্ষায় পেয়েছি! এরপর জঙ্গিরা আমাদের আবারও সেইখানে বন্ধ করে দিয়ে যায়।
ভোররাতের দিকে আমাদেরই স্টাফ আরেক শিশিরকে দিয়ে আমাদের ডেকে পাঠানো হয়। এসময় আমি আমার এক ভাগ্নে ছিল তাকে নিয়ে পরিকল্পনা করি, যা থাকে কপালে দুজনে একসাথে পালানোর শেষ চেষ্টা করবো।
শিশির দরজা খুলে। আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য দরজা খোলার সাথে সাথে আমরা চারজন পালাই। বাকি দুজন কোনদিক দিয়ে গেছেন জানি না। কিন্তু আমরা দুইজন পাশের বাড়ির দিকে তারকাঁটার ফাঁকা দেখে ওখানে ঢুকে পড়তেই পুলিশ র্যাব-আর্মির (ঠিক বলতে পারেন না) সামনে পড়ি।
এটা শেষ না করেই বরিশালের ছেলে শিশির বৈরাগী কান্না চেপে বলেন, আশেপাশে যে তারা ওঁৎ পেতে ছিল তা তো আর আমরা জানি না। কোথা থেকে বের হয়ে আমাদের পেটানো শুরু করলো!
আমরা যতই বলি, আমরা স্টাফ, আমাদের আটকে রাখা হয়েছিল, এই দেখেন আমাদের পরিচয়পত্র। কে শোনে কার কথা! প্রায় জঙ্গিই বানিয়ে ফেলেছিল আমাদের!
এই কথা বলেই একটা আলাদা ঝলক দেখা দিলো এতক্ষণ বিমর্ষ শিশিরের চোখে।
তিনি বলেন, আমাদের মালিক তো পাশের বাসাতেই ছিলেন সারারাত। আমাদের সেখানে নিতেই তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘এ আমার বাচ্চা, আমার সন্তান, ওদের ছেড়ে দিন’।
আমরা সারারাত তাকে ফোন করেছি, একবারের জন্যও ফোন মিস করেননি তিনি। বারবারই মনে হয়েছে, উনিই আমাদের বাঁচাতে পারবেন। হাসতে হাসতে শিশির বলেন, এতক্ষণ যারা আমাদের সন্দেহ করছিলেন, তারা কোথায় যে চলে গেছে, আর দেখিনি।
এরপর আমাদের ডিবি অফিসে নেওয়া হয় এবং ততক্ষণে আমরা ভেঙে পড়েছি। সারারাতের সেই অক্সিজেন ছাড়া ঘরে বন্দি অবস্থায় মৃত্যুর সাথে বাস করে, সকালে আমাদের আর কিছু ভাবার শক্তি ছিল না। সামনে কী দুর্দিন আসতে চলেছে, তখনও বুঝিনি!-বাংলা ট্রিবিউন
২৫ জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম