বুধবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৬, ০৭:০৮:৪৭

সাকিব আল হাসান মানুষটা পুরোটা বাংলাদেশের : সাকিব

সাকিব আল হাসান মানুষটা পুরোটা বাংলাদেশের : সাকিব

সাকিব আল হাসান : ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ, সিপিএল-এ খেলতে এসেছি, জামাইকা-র হয়ে। দেশ থেকে এত দূরে, কিন্তু সময় কাটছে ভালই। একা লাগছে না। এখানে তো সব আমার পরিচিত ক্রিকেটার। সবাই মিলে মজা করছি। বিশেষ করে রাসেল আছে তো। মানে আন্দ্রে রাসেল— আমাদের কেকেআর-এর, আমার কলকাতার টিমমেট।

আজকের এই বিভাজনের যুগে, যখন কাঁটাতারের চেয়েও শক্ত হয়ে উঠেছে মনের বেড়া, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে মনে হতে পারে এই ‘আমাদের কলকাতা’ উচ্চারণ করাটা একটু কঠিন। বিশেষ করে আমার পক্ষে, যে কিনা বাংলাদেশের নাগরিক, বাংলাদেশের খেলোয়াড়। আমি কিন্তু পারি। বাংলাদেশের এক গর্বিত সন্তান, বাংলাদেশ-অন্তপ্রাণ মানুষ হয়েও পারি— কলকাতাকে ‘নিজের’ বলে উচ্চারণ করতে। বিশ্বাস করি, সাকিব আল হাসান মানুষটা পুরোটা বাংলাদেশের, আর অনেকটাই এই কলকাতারও।

কলকাতার নাম উঠলেই আমি একটু নস্টালজিক হয়ে পড়ি। কলকাতা আমার সেকেন্ড হোম। বাংলাদেশ জাতীয় দলের পরেই সবচেয়ে বেশি সময় খেলেছি কেকেআরের হয়ে। আজ পাঁচ-ছয় বছর ধরে খেলছি। এখন আর কলকাতাকে আমার বিদেশি কোনও শহর বলে মনে হয় না। মনে হয়, আমি ঢাকাতেও যেমন থাকি, কলকাতাতেও তেমনই থাকি। বরং এটা বলা ভাল, কলকাতার জীবনটা বাংলাদেশের বাইরে যে কোনও শহরের চেয়ে বেশিই পছন্দ করি। আর ইডেন নিয়ে বরাবরই আমার মধ্যে একটা আবেগ কাজ করে। কেকেআরের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার অনেক আগে, সেই ২০০১ সালে, যুব দলের হয়ে এই ইডেনে খেলতে এসেছিলাম। সেটাই ছিল দেশের বাইরে আমার প্রথম সফর। কলকাতা তথা ভারতের সঙ্গে আমার কি আর আজকের সম্পর্ক! ইডেন গার্ডেন্স, কলকাতা— আমার শৈশবের ভালবাসা।

আর এই ভালবাসার মাঝখানে যে কাঁটাতারের বেড়া, সেটাকে আমি সে রকম অনুভবই করি না। তার কারণ, এ-পাশে, ও-পাশে একই ভাষা। সংস্কৃতিতেও খুব ফারাক নেই। মাঝখানে কেবল একটা রাজনৈতিক, ভৌগোলিক সীমান্ত। অবশ্য এই কাঁটাতারের বেড়ার চেয়েও শক্ত একটা দেওয়াল মাঝেমধ্যে মাথা উঁচোয় বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে। ২০১৫ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সময় থেকেই ক্রিকেট নিয়ে দু’দেশের ফ্যানদের মধ্যে একটা তিক্ততা মাথাচাড়া দিয়েছে। তবে ক্রিকেটাররা এসবকে পাত্তা দেয় না।

আমি নিজে ফেসবুক, টুইটার খুব একটা দেখি না। এসব তিক্ততা বা যাই হোক, মনে হয় সোশাল মিডিয়াতেই বেশি। ফলে আমার চোখে খুব একটা পড়ে না। কানে অবশ্য আসে। কিন্তু সে সব কথা শুনলেও, পাত্তা দিই না। আমরা ক্রিকেট খেলি। ক্রিকেট তো তিক্ততা ছড়ানোর জায়গা নয়। ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচে, আমি বাংলাদেশের হয়ে, ওরা ভারতের হয়ে লড়াই করবে। এ তো স্বাভাবিক। কিন্তু লড়াইটা শুধু মাঠেই। দিনশেষে আমরা একসঙ্গে আড্ডা দেব, ডিনার করব। এটাই আমাদের মধ্যেকার স্বাভাবিক সম্পর্ক।

এই কয়েক বছরে একটা ব্যাপার বুঝেছি, কলকাতার মানুষ আমাকে ঘরের ছেলের চেয়েও বেশি ভালবাসেন। বুক ভরা আদর পেয়েছি এখানে। কিন্তু এই কলকাতাই আবার প্রকাশ্যে আমার বিপক্ষে চিৎকার করেছে, যখন ম্যাচটা ভারতের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের হয়ে। এই তো গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময়, বাংলাদেশ যখন ভারতে, এক কেকেআর-কর্মকর্তা আমাকে ফোন করে বলছিলেন, ‘এই পাঁচ-ছয় বছর তোমার হয়ে চিৎকার করেছি, এ বার তোমার দ্রুত আউট হওয়ার জন্য প্রার্থনা করব।’ একটুও রাগ করিনি। এটাই তো স্বাভাবিক।

আমার কাছে ‘স্পোর্টিং স্পিরিট’ হল— নিজের পরিচয় ধরে রেখে বন্ধু তৈরি করে চলা। আমি যেখানেই যাই, মনে রাখি, আমি বাংলাদেশের প্রতিনিধি। এই যে সিপিএলে খেলছি, আমি গর্ব করে বলি: আমি এখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধি। কেকেআরেও তাই। কলকাতায় এত বছর ধরে খেলছি, ওটা আমার সেকেন্ড হোম; কিন্তু আমার মাথায় থাকে যে, আমি সেখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধি। এটাই আমার গর্ব। এ ভাবে বাকিরাও যে যার দেশের প্রতিনিধি হয়েও সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে তোলে। এটাই স্পোর্টস।

সঙ্গে এ-ও বলব, ক্রিকেট আসলে সীমান্ত তৈরিও করে না, মুছেও দিতে পারে না। ক্রিকেটাররা বড়জোর যোগাযোগটা শক্ত, মজবুত করতে পারে। আমি কলকাতায় খেলছি, মুস্তাফিজুর খেলা শুরু করেছে হায়দরাবাদে। আবার এ বার ঢাকা লিগে ইউসুফ খেলে গেল, অনেক ভারতীয় ক্রিকেটারও খেলেছে। এতে আমাদের ক্রিকেটীয় যোগাযোগ বাড়ে, পরস্পরের সঙ্গে বোঝাপড়া বাড়ে। কিন্তু মানচিত্রের ভেদাভেদ, সম্পর্কের তিক্ততা বদলানোটা ক্রিকেটারদের কাজ নয়। ওটা রাজনীতিক, কূটনীতিকদের কাজ।

আমাদের ক্রিকেটারদের মধ্যে তো কোনও তিক্ততা নেই! আমি অন্তত জানি না, দেখিনি কোনও দিন। তেতো কিছু থেকে থাকলে সেটা কিছু কিছু মানুষের মনে। মন তো অনেক কারণেই তিক্ত হয়। সেই স্বাদটা বদলাতে গেলে অন্য অনেক কিছু নিয়ে কাজ করতে হবে। - আনন্দবাজার

১৭ আগস্ট ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস‌‌‌‌

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে