সোমবার, ২২ আগস্ট, ২০১৬, ০২:৪৮:১১

মার্গারিতা ভালোভাবে বাংলাটা শিখবেন

মার্গারিতা ভালোভাবে বাংলাটা শিখবেন

মাহফুজ রহমান : মার্গারিতার বাবা আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হচ্ছিল গতকাল রবিবার দুপুর থেকে। টেলিফোনে দুবার কথা হলেও তেমন কিছুই বোঝা গেল না। তবে এতটুকু স্পষ্ট, অলিম্পিকে রিদমিক জিমন্যাস্টিকসে মেয়ের স্বর্ণজয় নিয়ে তিনি উচ্ছ্বসিত। মস্কো থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বরে কান্নার আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছিল। আসলেই তিনি কাঁদছিলেন?

বিষয়টা পরিষ্কার হলো সন্ধ্যায়। ভাইবারে আবার কথা বলার চেষ্টা করলে ওপাশ থেকে শোনা গেল এক নারীকণ্ঠ, ‘হ্যালো...হ্যালো।’ আমরা বাংলায় জানালাম, ‘মামুন ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’ উত্তরে রুশ ভাষায় কিছু একটা বললেন সেই নারী। আমরা এবার ইংরেজিতে বললাম, ‘মামুন ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’ এবারের উত্তর তিনি দিলেন পরিষ্কার বাংলায়, ‘বুঝি বুঝি!’

ততক্ষণে ফোন চলে গেছে আবদুল্লাহ আল মামুনের হাতে। এবারও জড়ানো কণ্ঠ, কান্নার আওয়াজ! আমরা জানতে চাই, ‘মামুন ভাই, কেমন লাগছে? আপনার মেয়ে তো বিশ্বজয় করল!’ মার্গারিতার গর্বিত বাবা আবারও আর্দ্র গলায় বললেন, ‘খুব ভালো লাগছে! এটা আমার জন্য, বাংলাদেশের মানুষের জন্যও গর্বের বিষয়।’

ব্যস, এতটুকুই! আবার ভেসে এল কান্নার আওয়াজ। ফোনে যে নারীকণ্ঠটি শুনলাম, তিনি কে? প্রশ্নের উত্তরে মামুন জানালেন, ‘ও মার্গারিতার মা আন্না।’

মার্গারিতা মামুনের বাবা আবদুল্লাহ আল মামুন বাংলাদেশের ছেলে। বাড়ি রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলা থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের কাশিপুরে। প্রথম আলোর রাজশাহী প্রতিনিধি মাহবুব আলম গতকাল সেই গ্রাম থেকে ঘুরে এসেছেন। কথা বলেছেন মার্গারিতার বড় ফুফু দিনা জহুরার সঙ্গে।

দিনা জহুরা জানালেন, আবদুল্লাহ আল মামুন অসুস্থ, ফোনে ঠিকভাবে কথা বলতে পারেননি। অলিম্পিক শুরু হওয়ার পর রাশিয়া থেকে ফোন করেছিলেন মামুন। বোনকে বলেছিলেন, ‘মার্গারিতার খেলা আছে ১৯-২০ তারিখে। গ্রামের সবাইকে বোলো দোয়া করতে।’

গ্রামবাসী ঠিকই প্রার্থনা করেছে মার্গারিতার জন্য। করবে না-ই বা কেন! এক হিসেবে সে তো এই গ্রামেরই মেয়ে। দেশের মেয়ে। ২০০০ সালে পাঁচ বছর বয়সী মার্গারিতা মা-বাবার সঙ্গে এসেছিলেন কাশিপুর। সারা দিন ছুটে বেড়িয়েছেন বাড়ির চারপাশে। গ্রামের মেয়ের খেলা দেখতে কাশিপুর গ্রামের অনেকেই রাত জেগে বসে ছিলেন, ভোরে ঘুমিয়েছেন একবুক আনন্দ নিয়ে।

তাদেরই একজন ৫০ বছর বয়সী মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মার্গারিতা কোন দেশের হয়ে খেলতেছে সেটা ব্যাপার না। ও যে এই গ্রামেরই সন্তান, এতেই আমরা গর্বিত।’

মার্গারিতার ফুফু বলছিলেন ২০০০ সালের কথা, ‘মার্গারিতাকে নিয়ে আমার ভাই বাড়ির পাশের পুকুরে বড়শি ফেলে মাছ ধরেছিল। মেয়েটা তখন ওর বাবার কাঁধে উঠে বসে ছিল—দৃশ্যটা এখনো চোখে ভাসে! মার্গারিতা যখন মায়ের পেটে, তখন কিন্তু ওর মা আমাদের এখানেই ছিল। ও জন্মানোর আগে আগে চলে গিয়েছিল রাশিয়ায়। মার্গারিতা দেখতে হয়েছে ঠিক আমাদের মা মেহেরুন নেছার মতো। চুল, নাক ঠিক একই রকম।’

বাংলা কি বলতে পারতেন মার্গারিতা? জবাবে দিনা জহুরা বললেন, ‘খুব ভালো পারত না, ভাঙা ভাঙা।’ মার্গারিতা ভাঙা ভাঙা বাংলা যে বলতে পারেন, সেটা বোঝা যায় ২০১৩ সালে প্রথম আলোর মস্কো (রাশিয়া) প্রতিনিধি জামিল খানের নেওয়া এক সাক্ষাৎকারের ভিডিও দেখে।

সেখানে একপর্যায়ে মার্গারিতা বাংলায় ১ থেকে ১০ পর্যন্ত উচ্চারণ করেছিলেন আর রুশ ভাষায় বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষা আমাকে টানে। আমি আরও ভালোভাবে বাংলা শিখতে চাই।’

ওই সময়ই আবদুল্লাহ আল মামুন জানিয়েছিলেন, মার্গারিতাই তাকে তাগাদা দিত বাংলাদেশে যাওয়ার ব্যাপারে। তাই মাঝেমধ্যেই মেয়েকে নিয়ে দেশে আসতেন তারা। আর দিনা জহুরার কাছ থেকে জানা গেল, মার্গারিতা শেষবারের মতো বাংলাদেশে এসেছিলেন ২০০৯ সালে।

এই টান থেকেই হয়তো বাংলাদেশের হয়ে জিমন্যাস্টিকসে অংশ নিতে চেয়েছিলেন মার্গারিতা। শেষমেশ সেটা আর হয়ে ওঠেনি। তবে তার নামের সঙ্গে বাংলাদেশ কিন্তু সেঁটেই আছে। এখন ‘বেঙ্গল টাইগার’ নামেই তাকে বিশ্বজুড়ে ডাকা হয়।

অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ের পর মার্গারিতার ফেসবুক পেজে ঢুঁ মেরে পাওয়া গেল সেটারই প্রমাণ। অনেকেই তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে ‘বেঙ্গল টাইগার’ সম্বোধন করে। এই উপাধিটা মার্গারিতা পেয়েছেন রাশিয়ার জাতীয় রিদমিক জিমন্যাস্টিকস দলের কোচ স্বয়ং ইরিনা ভিনের কাছ থেকে।

ভাইঝি মার্গারিতাকে নিয়ে ফুফু দিনা জহুরা সবশেষে যা বললেন, তা যেন বাংলাদেশের মানুষের মনের কথা, ‘আমাদের যে কী আনন্দ, কী খুশি, তা বলে বোঝাতে পারব না! মার্গারিতার এই অর্জন আমাদেরও গর্বিত করেছে।-প্রথম আলো
২২ আগস্ট ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/এমকেএইচ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে