বৃহস্পতিবার, ০১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১১:৩৬:৫৭

মুস্তাফিজ নামের গরীবের বৌ

মুস্তাফিজ নামের গরীবের বৌ

দেবব্রত মুখোপাধ্যয়: আমি অমঙ্গল আশা করছি না। ‘কু ডাক’ ডাকতে চাই না।

তারপরও বারবার মনে পড়ে সেই ২০০১ সালের কথা।

কৈশোর পার না করা একটা ছেলের ক’দিন আগে বাংলাদেশ দলে অভিষেক হয়েছে। অভিষেকে ঝড় তুলে দুনিয়াকে চমকে দিয়ে দেখিয়েছেন - বাংলাদেশ থেকেও ফাস্ট বোলার হওয়া সম্ভব।

বাংলাদেশ তখন গতির স্বপ্নে, সাফল্যের স্বপ্নে অন্ধ। ছেলেটাকে একটার পর একটা ম্যাচ খেলানো হচ্ছে। প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট না খেলা ছেলেটাকে টেস্ট খেলতে হচ্ছে, ‘এ’ দল, জাতীয় দল, এমনকি অনুর্ধ্ব-১৯ দলেও খেলতে বলা হচ্ছে তাকে। কেউ খেয়ালই করছে না, ‘এ’ দলের হয়ে ভারত সফরে পাওয়া চোটটা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।

জোর করে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো নিউজিল্যান্ড সফরে। কারো অনুরোধ, উপদেশ না শুনে কোচ ট্রেভর চ্যাপেল জোর করে তাকে মাঠে নামালেন। একদিকে সিনিয়র পেসার মঞ্জুরুল ইসলাম আগে থেকে ইনজুরিতে। টানা বল করে গেলো সেই কিশোর ছেলেটি।

তারপর? তারপর ভেঙে পড়লো তার শরীর।

সেই যে ভেঙে পড়লো, পরের ১৫টা বছর ধরে সেই ভাঙন সাথে নিয়েই পথ চলতে হয়েছে ছেলেটিকে। ক্যারিয়ারের অর্ধেকেরও বেশী সময় তাকে মাঠের বাইরে ইনজুরির সাথে লড়ে সময় কাটাতে হয়েছে। শুধুমাত্র কর্মকর্তাদের অবহেলা, নির্বুদ্ধিতা আর কোচের গোয়ার্তুমির ফলে সেই ছেলেটি চিরকাল সম্ভাবনমায় থেকেই ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে চলে এলো।

হ্যা, মাশরাফি বিন মুর্তজার কথা বলছিলাম।

শুধু মাশরাফি কেনো? মাশরাফির দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু তালহা জুবায়ের, মোহাম্মদ শরীফ আর সৈয়দ রাসেলের কথা মনে করুন। কিংবা বাংলাদেশের বেশীরভাগ ওই প্রজন্মের ফাস্ট বোলারের কথা ভাবুন। ব্যাটসম্যানরা নন, এইসব ফাস্ট বোলারের বেশীরভাগের ক্যারিয়ার শেষ হয়েছে মিস ম্যানেজমেন্টের কাছে।

ইনজুরির ভুল ম্যানেজমেন্ট, ম্যাচ ফিট হওয়ার আগে মাঠে নামানো, পর্যাপ্ত বিশ্রাম না দেওয়া এবং অবৈজ্ঞানিক অনুশীলন একটার পর একটা ফাস্ট বোলারের ক্যারিয়ার শেষ করে দিয়েছে।

তবে যুগ বদলেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এখন অনেক স্মার্ট। এখন বোর্ডের আস্ত একটা মেডিকেল টিম আছে, দেশী-বিদেশী ফিজিও-ট্রেনার আছে। তারা অত্যাধুনিক ইনজুরি ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়েন, বোঝেন, সেমিনারে যান। ফলে এই সময়ে এসে মাশরাফি বা তালহা কান্ড ঘটাটা একটু কঠিন।

তারপরও মুস্তাফিজ এই যে ইংল্যান্ডে ইনজুরিতে পড়লেন, তাতে একটা শঙ্কা তৈরী হলো, তার ইনজুরি ম্যানেজমেন্ট কী ঠিকঠাক চলছে?

ব্যাপারটা আসলে এতো সরল করে দেখার সুযোগ নেই। মুস্তাফিজের এই ইনজুরির জন্য বিসিবির দায় খোঁজাটা অতিসরলীকরণ দোষে দুষ্ট। আবার এটাও সত্যি যে, এক বছরের ক্যারিয়ারে পাচ বার একই কাঁধের ইনজুরিতে পড়া, বারবার ক্লান্তিজনিত চোটে আক্রান্ত হওয়াটাকে ঠিক প্রাকৃতিক ঘটনা বলে মেনে নেওয়াও যায় না।

তাহলে ঘটনা কোথায়?

ঘটনাটাকে সোজা কথায় বলা যায়, অর্থের সাথে স্বার্থের টানাপোড়েন।

প্রথমেই মেনে নিতে হবে, মুস্তাফিজ এখই কাউন্টির টি-টোয়েন্টি, এমনকি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পরই আইপিএল খেলার মতো ফিট ছিলেন না। ইংল্যান্ডে উড়ে গিয়ে ২৪ ঘন্টার ভেতর প্রথম ম্যাচ খেলা বা পাঁচ দিনের মধ্যে তিনটি ম্যাচ খেলার মতো ফিট তিনি ছিলেন না। এমনকি বিসিবির একজন দায়িত্বশীল মানুষই বলেছেন, মুস্তাফিজ দিনে ৪ ওভার বোলিংয়ের মতো ফিট ছিলেন; তার বেশী নয়। অথচ ইনজুরিতে না পড়লে ওয়ানডে কাপে সেদিনই মুস্তাফিজকে ১০ ওভার বোলিং করতে হতো।

কথা হলো, এসব জেনেও বিসিবি কেনো তাকে আইপিএল বা কাউন্টি টি-টোয়েন্টি খেলতে যেতে দিলো?

বিসিবির উপায়টা কী? তারা কতোক্ষন এভাবে আটকে রাখবে?

মুস্তাফিজের সামনে যখন প্রথম এরকম হাতছানি এলো, সেটা ছিলো পাকিস্তান সুপার লিগ। তখনও একইরকম অবস্থা তার-হাফ ফিট। বিসিবি তাকে আটকালো। বিনিময়ে তাকে একটা ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দিলো; যদিও সেই ২০ লাখ টাকা মুস্তাফিজ সম্ভবত এখনও পাননি।

কিন্তু বিসিবি এভাবে কতোক্ষন টাকা দেবে? আইপিএল ও কাউন্টির এই টূর্নামেন্টে মুস্তাফিজের প্রাপ্তি কোটি টাকার উপরে। এখন তাকে বিশ্রাম দেওয়ার স্বার্থে বিসিবি কি নিয়মিত বছরে কয়েক কোটি টাকা তাকে বাড়তি দেবে?

কতো জনকে দেবে? সাকিবও তো একই ধরণের ‘স্ট্রেস ইনজুরি’ নিয়ে খেলছেন। তাকেও তাহলে টাকা দিতে হবে। আগামী মৌসুমে এই কাউন্টি যখন রিয়াদ, তামিম, তাসকিনকে চাইবে; তাদেরও টাকা দিতে হবে।

সমস্যা হলো, এই ধরণের ক্লান্তি বা স্ট্রেস বা ধকল থেকে যে ইনজুরি তৈরী হয়, তা দৃশ্যমান নয়। মানে, এটা নিয়েও আপনি খেলে যেতে পারবেন। হাত-পা ভেঙে গেলে, লিগামেন্ট ছিড়ে গেলে খেলোয়াড় নিজেই বুঝতে পারে, তার আইপিএল খেলা হবে না। কিন্তু প্রশ্ন যখন স্ট্রেসজনিত ইনজুরির, তখন খেলোয়াড়েরও এই টাকার হাতছানি এড়ানো কঠিন।

কারণ, বোর্ড যদি তাকে আটকায় এ অবস্থায়, সেটা হবে প্রিকশান বা পূর্বসতর্কতা। এখন নিজেকে মুস্তাফিজদের জায়গায় রেখে দেখুন। আপনার পরিষ্কার কোনো ইনজুরি নেই; আপনি বল করতে পারছেন। কিন্তু মেডিকেল টিম বলছে, তার খেলা উচিত না; বিশ্রাম নেওয়া উচিত।

এই ‘উচিত’-এর কারণে কী আপনি কোটি টাকার হাতছানি এড়াবেন?

হয়তো কেউ কেউ সেই হাতছানিটা এড়াতে পারবে। যারা অতিরিক্ত দেশপ্রেমিক। যারা তা নয়, তারা তো বেশীক্ষন এই খবরদারি মানবে না।

সম্প্রতি ক্রিকেটারদের আর্ন্তজাতিক সংগঠন ফিকার এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বের ৪৯.১ শতাংশ ক্রিকেটার বিভিন্ন এই ফ্রাঞ্চাইজি লিগের টাকার কারণে দেশের ক্রিকেট ছাড়তে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন। শঙ্কার কথা হলো, এই দেশ ছাড়তে রাজী হওয়া ক্রিকেটারদের ৫৮.৬ শতাংশই বাংলাদেশসহ ৫টি দেশের ক্রিকেটার!

ফলে বিসিবি যদি এই একটা তথ্যের কারণেই ভয় পেয়ে হাফ ফিট খেলোয়াড়দের ‘ফিট’ বলে দিতে থাকে, দোষ দেওয়া চলবে না। ইতিমধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট এই টাকার টানে ধ্বংস হতে বসেছে। টাকার অভাবে থাকা পাকিস্তানের অনেক ক্রিকেটারও ব্রিটিশ পাসপোর্টের ব্যবহার শুরু করেছেন।

ফলে সমস্যাটা বৈশ্বিক। বলা ভালো, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার বাইরে কোনো দেশই এই সমস্যা থেকে মুক্ত নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দেশ; যাদের ক্রিকেটারদের দেশের ক্রিকেট থেকে আয় আইপিএলের তুলনায় নিতান্তই তুচ্ছ; তাদের জন্য এটা মহাসংকট।

এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে বিপিএল, পিএসএল, সিপিএল, কিছুদিনের জন্য এসএলপিএলও চালু হয়েছে। তাতে টাকার পরিমান বাড়েনি। ফলে সংকটও কমেনি।

এখন করনীয় কী?

আমরা সাধারণত যখন কোনো সমস্যা নিয়ে কথা বলি, সমাধাণ দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু এই সমস্যাটা ক্রিকেটের বৈশ্বিক চরিত্রের অংশ হয়ে গেছে। যতক্ষন না ক্রিকেটে ফুটবলের ইউরোপিয়ান লিগের মতো সব দেশের খেলোয়াড়দের জন্য অনেক আয়ের সম্ভাবনা ক্ষেত্রে তৈরী না হয়, ততোক্ষন এই সমস্যা মেটার নয়।

ততক্ষন আমাদের মুস্তাফিজদের এই গরীবের বৌ হয়েই থাকতে হবে। যখন-তখন লুট হওয়ার ভয়।

আমরা এখন কিছুই করতে পারি না। কপাল চাপড়াতে পারি। আরও সব ক্ষেত্রের মতো ভাগ্যবিড়ম্বিত বলে নিজেদের মেনে নিতে পারি। নাকি রুখেও দাড়াতে পারি?-প্রিয়
১ আগস্ট, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে