অমিত রায়/আবুল হাশেম : ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার কিশোরী ফুটবলারদের মাঝে ভর করছে ভয় আর হতাশা। বাফুফে-আতংক যেন কাটছে না। ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফিরেও স্বস্তিতে নেই কিশোরীরা। একদিকে লক্কড়ঝক্কড় বাসে ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরা নিয়ে মিডিয়ায় তোলপাড়, অন্যদিকে গ্রীষ্মকালীন খেলা নিয়ে স্কুল শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিরোধকে কেন্দ্র করে হামলা-মামলাসহ নানা কারণে ওরা চিন্তিত।
এদিকে কলসিন্দুরবাসী ও ফুটবলপ্রেমীদের প্রত্যাশা, বাফুফে যেন ওদের প্রতি সুদৃষ্টি রাখে। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে আসা মেয়েরা অনুশীলনে মগ্ন। কলসিন্দুর মাঠে প্র্যাকটিস করেছে তারা কালও। লক্কড়ঝক্কড় বাসে ঢাকা থেকে ধোবাউড়ার কৃতী মেয়েদের বাড়ি ফেরা নিয়ে দু’দিন ধরে গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও বাফুফেতে ঝড় বইছে।
সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে গ্রীষ্মকালীন খেলা নিয়ে স্কুল শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিরোধকে কেন্দ্র করে তাসলিমার বাবা সবুজ মিয়ার ওপর শরীরচর্চা শিক্ষক জবেদ তালুকদারের হামলা ও প্রাণনাশের হুমকি। বিষয়টি মামলায় গড়িয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্কুল অ্যান্ড কলেজ গভর্নিংবডি জরুরি সভা করে হুমকিদানকারী শিক্ষক জবেদ তালুকদারকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। ঘটনা তদন্তে স্কুলের সহকারী শিক্ষক রতন মিয়াকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
সরেজমিন শুক্রবার কলসিন্দুর ঘুরে দেখা গেছে, ফুটবলকন্যারা আতঙ্কিত। ভীত তারা। মিডিয়ার সামনে কথা বলতে নারাজ। লক্কড়ঝক্কড় বাসে ফেরা আর ইভটিজিংয়ের শিকার নিয়ে শোনা গেছে এলোমেলো কথা। কেউ কেউ বলে, ইভটিজিংয়ের কোনো ঘটনা ঘটেনি। আবার কেউ বলছে, এভাবে বাড়ি ফেরা আমাদেরই সিদ্ধান্ত। বাফুফে দায়ী নয়। সবাই বাফুফেকে বাঁচাতে মরিয়া।
সানজিদা, মার্জিয়া, তহুরা আর মাহমুদাসহ ফুটবলকন্যারা জানায়, ‘ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে সেদিন মিডিয়ায় হয়তো এলোমেলো বলেছি। এনিয়ে মিডিয়ায় ঝড় উঠবে, তা আমরা চিন্তাও করিনি।’ একই সুরে কথা বলেন তাদের অভিভাবকরাও। তারা তাদের সন্তানদের আরও এগিয়ে নিতে বাফুফেসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা কামনা করেন। তবে কলসিন্দুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক ও গভর্নিংবডির সদস্যরা ক্ষুব্ধ।
গভর্নিংবডির সভাপতি প্রিয়তোষ বিশ্বাস বাবুল মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে ফেরা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘বাফুফেসহ সংশ্লিষ্টরা দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন।’ দৃষ্টি রেখে কিশোরী ফুটবলারদের প্রতি আরও যত্নবান হওয়ার অনুরোধ জানান তিনি। কলসিন্দুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ জালাল উদ্দিন বলেন, ‘মিডিয়ার সামনে কথা বলায় মেয়েরা বাফুফে নিয়ে কিছুটা আতঙ্কে।’
আগামীতে ওরা চেইন অব কমান্ড মেনে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি। জানান, কৃতী ফুটবলার তাসলিমার বাবাকে মারধর ও প্রাণনাশের হুমকিদানকারী শিক্ষক জবেদ তালুকদারকে কলসিন্দুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে স্কুলের সহকারী শিক্ষক রতন মিয়াকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি সাত দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেবে।
যেভাবে ঘটনা ঘটে : মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৬ দলের ৯ ফুটবলার ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা কলসিন্দুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী। বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করে মঙ্গলবার কলসিন্দুরের উদ্দেশে রওনা দেয় ধোবাউড়ার সোনার মেয়েরা। সকাল ৮টায় নিলয় এন্টারপ্রাইজ নামে একটি লোকাল বাসে উঠে ধোবাউড়ার উদ্দেশে রওনা দেয় মার্জিয়ারা।
রাস্তায় ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ডে নাজমা আক্তার তার মামার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে বাসে থাকা কয়েকজন যাত্রী মেয়েদের বকাঝকা করে। এ নিয়ে মিডিয়ায় তোলপাড় হলে নড়েচড়ে বসেন বাফুফের কর্মকর্তারা। কেন সোনার মেয়েদের লোকাল বাসে বাফুফের কোনো কর্মকর্তা বা অভিভাবক ছাড়া পাঠানো হয়েছে, তা নিয়ে সারা দেশে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় ওঠে।
এ ব্যাপারে কলসিন্দুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ জালাল উদ্দিন বলেন, ‘আমি দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনকে বারবার ফোন করলেও তিনি মেয়েদের কীভাবে পাঠাবেন বা আমরা যাব কিনা, তার কোনো সমাধান দেননি। মিডিয়ায় তা আসার পর মেয়েদের বাফুফের কয়েকজন কর্মকর্তা ফোন করেন। তাতে চাপে পড়ে যায় মেয়েরা। তারা ভয় পায়।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলসিন্দুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক ফুটবলকন্যা বলে, ‘আমরা সংবর্ধনায় গেলে ম্যাডাম-স্যার কী জানি বলে- এ নিয়ে ভয় পাচ্ছি।’
এদিকে এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই শুরু হয় নতুন আরেকটি বিষয়। গোলকিপার তাসলিমার বাবা সবুজ মিয়াকে মারধর করেন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শরীরচর্চা শিক্ষক জবেদ তালুকদার। স্থানীয়রা জানান, বুধবার সকালে কলেজের অধ্যক্ষ জালাল উদ্দিন মেয়েদের মিষ্টি খাওয়ানোর জন্য ডাকেন। সেখানে ছিলেন তাসলিমার অভিভাবক সবুজ মিয়া। অধ্যক্ষ মেয়েদের ১৮ সেপ্টেম্বর কুমিল্লায় গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আঞ্চলিক পর্যায়ের খেলায় অংশ নিতে বলেন। খেলায় সানজিদা, মারিয়াদের খেলতে প্রস্তাব দেন শরীরচর্চা শিক্ষক জবেদ তালুকদার।
কিন্তু মেয়েরা বলে, ১৭ সেপ্টেম্বর তাদের সংবর্ধনা রয়েছে। ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে প্রশিক্ষণ শুরু হবে। তাহলে আমরা কীভাবে স্কুলের পক্ষে খেলব। এ সময় শরীরচর্চা শিক্ষক জবেদ তালুকদার ক্ষুব্ধ হন। পরে মেয়েরা চলে যায়। ওই দিন সন্ধ্যায় সকালের ঘটনার জেরে কলসিন্দুর বাজারে ফুটবলার তাসলিমার বাবাকে মারধর করেন শিক্ষক জবেদ তালুকদার। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার দুপুরে ধোবাউড়া থানায় একটি মামলা করেন তাসলিমার বাবা। একই দিন সন্ধ্যায় বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির জরুরি সভা ডেকে অভিযুক্ত শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
কলসিন্দুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে কোন্দল চলে আসছে। এ নিয়ে আতঙ্কে রয়েছে মেয়েরা। ভয় পাচ্ছে তাদের ফুটবল ক্যারিয়ার নিয়ে। এ ব্যাপারে মার্জিয়ার বাবা আ. মোতালেব বলেন, ‘আমাদের মেয়েরা বাংলাদেশের জন্য সুনাম বয়ে আনছে। বিনিময়ে আমরা তেমন কিছু পাইনি, কিছু চাইও না। তবে এখন মেয়েদের নিয়ে যে নোংরা রাজনীতি শুরু হয়েছে আমরা তার অবসান চাই। আমাদের মেয়েদের যেন ক্ষতি না হয় সেজন্য বাফুফে কর্মকর্তাদের সুদৃষ্টি কামনা করছি।’
এলাকাবাসীর দাবি, কলসিন্দুরের মেয়েদের যেন বাফুফে কর্তারা সুনজরে দেখেন। পাশাপাশি সরকার যেন এদের যত্ন নেয়। সানজিদা এরই মধ্যে খবর পেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে প্রত্যেক মেয়েকে ১ লাখ টাকা দেয়া হবে। এ ব্যাপারে সে যুগান্তরকে বলে, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। তিনি যদি আমাদের স্কুলে আসেন তাহলে আমরা আরও খুশি হব।’
ময়মনসিংহে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ : অনূর্ধ্ব-১৬ টুর্নামেন্ট শেষে বাড়ি ফেরা ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার কলসিন্দুরের নারী ফুটবলারদের প্রতি কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা ও অবহেলার প্রতিবাদে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে জনউদ্যোগ নামে একটি সংগঠন।
শুক্রবার বিকালে শহরের ফিরোহ-জাহাঙ্গীর চত্বরে আয়োজিত মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন পৌর মেয়র ইকরামুল হক টিটু, সিপিবি সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমদাদুল হক মিল্লাত, অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল, অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম চুন্নু, জেলা ক্রীড়া সংস্থার সেক্রেটারি সাজ্জাদ জাহান চৌধুরী শাহীন, অ্যাডভোকেট আবদুল মোতালেব লাল ও ইয়াজদানী কোরায়শী কাজল।
বক্তারা নারী ফুটবল তারকাদের উপযুক্ত নিরাপত্তা প্রদানের দাবি জানান। পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতার সমালোচনা করেন। -যুগান্তর
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি