সোমবার, ০৩ অক্টোবর, ২০১৬, ০৮:৩১:৫১

একটি দৌড় এবং অনেক প্রশ্ন

একটি দৌড় এবং অনেক প্রশ্ন

তারেক মাহমুদ: মেহেদী হাসান বিরাট ভুল করেছেন। গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড গ্যালারি থেকে মাঠের দিকে দৌড়ে যাওয়া তাঁর ঠিক হয়নি। তিনি নিশ্চয়ই পত্রিকা পড়েন, টেলিভিশনে খবর দেখেন, অনলাইনেও জগতের খোঁজখবর রাখেন। তাঁর জানার কথা ইংল্যান্ড সিরিজ সামনে রেখে কতটা স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। পিপীলিকার ঢুকতে কষ্ট হয়, এমন নিরাপত্তায় ঢেকে ফেলা হচ্ছে স্টেডিয়াম, খেলোয়াড়দের হোটেল ও যাওয়া-আসার পথ। বাংলাদেশে ক্রিকেটকে নিরাপদ রাখতেই এত চেষ্টা। তাহলে আস্ত একজন মানুষ হয়ে মেহেদী কেন মাঠের মধ্যে ঢুকে পড়বেন? কেন স্পর্শকাতর সময় এবং স্পর্শকাতর পরিবেশে স্পর্শ করতে চাইবেন মাশরাফি বিন মুর্তজাকে? এ তাঁর বিরাট অন্যায়।

ক্রিকেট, ফুটবল সব খেলাতেই মেহেদীরা থাকেন। সব সময়, সব দেশে। কখনো মাতাল হয়ে, কখনো ... হয়ে, কখনো স্বাভাবিকভাবেই দৌড়ে মাঠে ঢুকে যান। খেলোয়াড়দের ভালোবাসা জানান। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন। পরে তাঁদের মাঠের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। মেহেদীর ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। তাঁর বরং সৌভাগ্য, মাশরাফি চেষ্টা করেছেন তাঁকে বুকে আগলে নিরাপদে মাঠের বাইরে পাঠাতে।
সমর্থকদের আবেগ বাংলাদেশের ক্রিকেটের শক্তি। কিন্তু সেই আবেগে বিবেচনাবোধ হারিয়ে ফেললে খেলারই ক্ষতি। আবার এটাও হতে পারে, মেহেদী মোটেও আবেগের বশে এ কাজ করেননি। তিনি এটা করেছেন ভেবেচিন্তে। বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে অথবা বিখ্যাত হতে। সেটা আরও বড় অন্যায়। কারও খেয়ালের শিকার বাংলাদেশের ক্রিকেট হতে পারে না। এখানে টেলিভিশন সম্প্রচারকারীদেরও একটু দায়িত্ব থাকে। বিদেশের মাঠে এ রকম ঘটনার সময় শুরুটা ক্যামেরায় ধরা পড়ে গেলেও মাঠে ঢুকে পড়া ব্যক্তির কর্মকাণ্ড এরপর যতটা সম্ভব কম দেখানো হয়। যাতে তাকে দেখে অন্যরা সে রকম কিছু করতে অনুপ্রাণিত না হন।

মেহেদীর মতো মানুষ অথবা তার চেয়েও ভয়ংকরদের আটকানোর জন্যই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সময় স্টেডিয়াম এলাকায় নিরাপত্তার এত কড়াকড়ি থাকে। ওয়াকিটকি হাতে মাঠের ভেতরে-বাইরে অসংখ্য নিরাপত্তাকর্মীর ছড়াছড়ি। পরিষ্কার করে দেওয়া ভালো, পুলিশ-র্যা বসহ সরকারি অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথা এখানে বলা হচ্ছে না। তারা তাঁদের নিয়ম এবং জবাবদিহির মাধ্যমে পরিচালিত হন। কিছুদিন আগে যে ছয় সাবেক সেনাসদস্যকে বিসিবির নিরাপত্তা বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হলো, তাঁরা এই আলোচনার বাইরে। কারণ এই ছয়জনের দায়িত্ব বিদেশি কোচদের নিরাপত্তা দেখা পর্যন্ত সীমিত।

বিসিবির বহুল আলোচিত অপ্রশিক্ষিত ওয়াকিটকি-সর্বস্ব নিরাপত্তা দলটির কথাই বলা হচ্ছে এখানে। কিছু বোর্ড পরিচালকের স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক দল ও স্থানীয় প্রভাব খাটিয়েই এঁরা ‘সিকিউরিটির লোক’ হয়ে গেছেন। বিসিবিতে ঢোকার আগে নিরাপত্তার কাজে এঁদের কারও কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। এ দলটির গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন আবার একজন সাবেক ক্রিকেটার। এটাও বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। খেলা ছাড়ার পর ক্রিকেটারদের অনেক কিছু হওয়ার নজির থাকলেও ক্রিকেট বোর্ডের নিরাপত্তা কর্মকর্তা হওয়ার রেকর্ড বোধ হয় বাংলাদেশেই আছে।

যোগ্যতা থাকলে সেটা হতেও বাধা ছিল না। কিন্তু যাঁরা একজন নিরস্ত্র দর্শকের মাঠে ঢুকে পড়া ঠেকাতে পারেন না, তাঁর সঙ্গে এমনকি দৌড়েও জিততে পারেন না; তাঁরা আরও সাংঘাতিক অনুপ্রবেশকারীকে কীভাবে ঠেকাবে? উল্টো স্টেডিয়ামের গেটে তথাকথিত এই নিরাপত্তাকর্মীদেরই দেখা যায় বিনা টিকিটের, বিনা অ্যাক্রেডিটেশন কার্ডের লোক ঢোকাতে। দর্শকদের সন্দেহজনক আচরণের দিকে লক্ষ রাখতে সারা বিশ্বেই নিরাপত্তারক্ষীরা খেলা চলাকালে মাঠ পেছনে রেখে গ্যালারির দিকে তাকিয়ে দাঁড়ান। আর বাংলাদেশে তাঁরা নিজেরাই ব্যস্ত থাকেন খেলা দেখা ও সেলফি তোলায়।

পরশুর ঘটনার পর বিসিবির উচিত ছিল গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডের ওই এলাকার দায়িত্বে থাকা ‘শোপিস’ নিরাপত্তাকর্মীদের দায়িত্বে অবহেলার দায়ে বরখাস্ত করা। পারলে অপেশাদার ও মৌসুমি নিরাপত্তা দলটিকে চিরতরেই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া। অবশ্য সে রকম সাহসী সিদ্ধান্ত বিসিবির নেওয়ার কথা নয়। এঁদের প্রতি তারা বরাবরই উদার। এর আগে এ রকমই কয়েক নিরাপত্তাকর্মী ক্রিকেট বোর্ডের মোটা অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করেও পার পেয়ে গেছে। তখনই বোর্ড কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়নি, আর এ তো দায়িত্ব পালনে ‘সামান্য’ ব্যর্থতা!

বৈশ্বিক নানা কারণে এই সময়টাতেই বাংলাদেশে ক্রিকেটের নিরাপত্তা নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। সে জন্যই বাংলাদেশের ইতিহাসে এখনই খেলাটির আশপাশে সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা। সরকারও এ ব্যাপারে বিসিবিকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করছে এবং তারই ফল ইংল্যান্ড দলের বাংলাদেশে আসা। ক্রিকেটের নিরাপত্তার স্বার্থে সাধারণ মানুষও কম ত্যাগ স্বীকার করছেন না। খেলোয়াড়দের পথ মসৃণ করতে তাঁরা যানজটে নাকাল হচ্ছেন। স্টেডিয়ামের আশপাশের বাসিন্দাদের তো বাসার সামনের রাস্তায় নামতেও ঝক্কি। দর্শক থেকে শুরু করে সাংবাদিক, এমনকি অনেক সময় বোর্ড কর্মকর্তাদের চলাফেরাও নিরাপত্তার জালে আড়ষ্ট হয়ে যায়। তারপরও সবাই কষ্টটুকু মেনে নিচ্ছেন খেলার স্বার্থে। কিন্তু এত বজ্র আঁটুনির পরও একেবারে আসল জায়গায় ফোসকা গেরো চরম হতাশার ও লজ্জার। এমনও নয় যে, এর আগে ‘দুষ্ট’ দর্শকদের এ রকম কয়েকটি উদ্যোগ ওয়াকিটকিওয়ালারা ভেস্তে দিতে পেরেছেন। এবারই কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে গেছে। আদতে এই প্রথম কোনো দর্শক এই চেষ্টা করলেন এবং তাতে সফলও হয়ে গেলেন।

বিসিবির ভান্ডার থেকে এত ‘ডিএ’ খরচ করে অপেশাদার নিরাপত্তাকর্মী পোষার বিষয়টি অনেক দিন ধরেই আলোচনায়। এঁদের কেউ কেউ অ্যাক্রেডিটেশন কার্ডে লেখা নাম-পরিচয়ও ঠিকমতো পড়তে পারেন না, অনেকের আচরণও থাকে অসংযত। সংখ্যায় তাঁরা এক শরও বেশি। এই অদক্ষ ও অপ্রশিক্ষিত লোকদের বিসিবিতে আনাটা যদি শুধু তাঁদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যেই হয়ে থাকে, তাহলে তো আরও উপায় আছে! নিরাপত্তা রক্ষার মতো স্পর্শকাতর দায়িত্বটাই কেন ছেড়ে দিতে হবে তাঁদের হাতে? কেন ক্রিকেটকেই জিম্মি বানিয়ে খালি করা হচ্ছে ক্রিকেট বোর্ডের ভান্ডার?

বিসিবির কর্মকর্তারাই বলেন, ‘বাংলাদেশে ক্রিকেটকে অনিরাপদ প্রমাণের চক্রান্ত হচ্ছে। সতর্ক থাকতে হবে।’ অথচ তাঁরাই অপ্রশিক্ষিত ও অপেশাদার কিছু মানুষের হাতে নিয়মিত দেশি-বিদেশি ক্রিকেটার ও আন্তর্জাতিক সিরিজের নিরাপত্তার দায়িত্ব তুলে দেওয়ার অসতর্ক কাজটি করে যাচ্ছেন। এই জায়গায় যে প্রশিক্ষিত, পেশাদার ও দক্ষ কর্মীদেরই প্রয়োজন, সেটা বুঝতে সমস্যা কোথায়? নাকি বাংলাদেশে এমন সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠানের অভাব আছে?-প্রথম আলো
৩ অক্টোবর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে