বুধবার, ০৫ অক্টোবর, ২০১৬, ০১:৩৫:৩৭

সন্তানদের জন্য অনেক বছর বাঁচতে ইচ্ছে করে: মাশরাফি

সন্তানদের জন্য অনেক বছর বাঁচতে ইচ্ছে করে: মাশরাফি

আরিফুল ইসলাম রনি : বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ওয়ানডে অধিনায়ক; তবে ক্রিকেটের সীমানা ছাড়িয়েছেন তিনি অনেক আগেই। জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই কোটি কোটি মানুষের অনুপ্রেরণার নিরন্তর উৎস মাশরাফি বিন মুর্তজা। জীবনের পথচলায় তার ৩৩ পূর্ণ হলো ৫ অক্টোবর। দুই বছর আগে একই দিনে পৃথিবীর আলোয় এসেছে তার দ্বিতীয় সন্তান। দীর্ঘ আড্ডায় মাঠের ক্রিকেট থাকল কমই। উঠে এল মাশরাফির জীবনবোধ, মূল্যবোধ, পরিবার-সমাজ ও চারপাশের নানা বাস্তবতা নিয়ে তার ভাবনা।

জনপ্রিয়তাকে কিভাবে দেখেন?

মাশরাফি: কোনো ভাবেই দেখি না। কারণ আমি এসব নিয়ে ভাবিই না। আমি অতটা শিক্ষিত নই, তবে একটা ব্যাপার সব সময় মানার চেষ্টা করি। ছেলেবেলায় একবার এক শিক্ষকের সঙ্গে অন্যায় করে ফেলেছিলাম। স্যার তখন বলেছিলেন, ‘আমি তোমাকে ভালো জানি, আমার কাছে খারাপ হয়ো না। ভালো হতে সময় লাগে, খারাপ হতে সময় লাগে না।” এটা আজীবনের জন্য আমার মাথায় গেঁথে গেছে। যাদের কাছে আমি ভালো, তাদের কাছে অন্তত খারাপ হতে চাই না।

তবু কি মনে হয়, নিজেকে, সবাইকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন?

মাশরাফি: আমি কখনোই সেভাবে অনুভব করি না। বিশ্বাস করেন, আমার কাছে সাকিবের উচ্চতা আমার চেয়ে অনেক বেশি। তামিম, মুশফিক, রিয়াদের উচ্চতা বেশি। এমন নয় যে বলার জন্য বলছি, সত্যিই অনুভব করি। ওদেরকে সব সময় আমি অন্য জায়গায় রাখি।

কিন্তু এই যে লোকে আপনাকে অতিমানব, মহামানব বলে… সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অনেক সময় এই যুগের মুক্তিযোদ্ধা বলে ফেলে, এসব কিভাবে নেন?

মাশরাফি: এসব বলা আসলে বোকামি এবং ভীষণ বাড়াবাড়ি। আমি প্রচণ্ড লজ্জা পাই, তার চেয়ে বেশি বিব্রত হই। টিমমেটদের কাছে সবচেয়ে বেশি বিব্রত হই। ওরাও তো আমার মতোই দেশের জন্য নিজেকে উজার করে দিচ্ছে।

বিশেষ করে, ক্রিকেটারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা টানলেই খুব খারাপ লাগে। আগেও অসংখ্যবার বলেছি, আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধ সব কিছুর আগে। মুক্তিযোদ্ধাদের স্থান সব কিছুর ওপরে। সামান্য ক্রিকেট খেলা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা বাতুলতা ছাড়া আর কিছু নয়।

হ্যাঁ, আমাকে যে ভালোবাসে, তাকে আমি মূল্যায়ন করি। কিন্তু ভালোবাসার প্রকাশ বা ভাষা ব্যবহারে পরিমিত হওয়া প্রয়োজন সবার।

আপনার ভেতর কতজন মানুষ বাস করে?

মাশরাফি: আমি সব জায়গায় একই রকম। নরম্যালি আমি খুব বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাই না। কেউ চড় দিলেও আমি কিছু করব না। কিন্তু কেবল দু্ই জায়গায় আমি একটু ভিন্ন। আমার মা ও আমার বউ। ওদের সঙ্গে আমি যা কিছু করতে পারি। হয়ত অন্য রাগ ওদের ওপর দিয়ে প্রকাশ করে ফেলি অনেক সময়। ওরা আমার জন্য সেই নির্ভরতার জায়গা।

আপনি বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে, আড্ডা দিতে পছন্দ করেন। আবার প্রচণ্ড ঘরকুনো!

মাশরাফি: বাচ্চা হওয়ার পর বাসা আমাকে বেশি টানে। প্র্যাকটিস শেষেই বাসায় ফিরতে মন চায়। ওদের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালো লাগে। এখন বন্ধুদেরই অনেক সময় বাসায় টেনে আনি।  

আরও কিছু ব্যাপার আছে। আপনি অনেক প্রাণখোলা, আবার কিছু ব্যাপারে একদম এক রোখা। অনেক ছাড় দেন, আবার অনেক ব্যাপারে নাছোড়বান্দা। ভীষণ আধুনিক, আবার কিছু জায়গায় কুসংস্কারাচ্ছন্ন!

মাশরাফি: কিছু জায়গায় গোঁড়ামি আছে, কখনোই ছাড় দিতে পারি না। হয়ত বুঝতে পারছি আমার ক্ষতি হচ্ছে, তবু গোঁয়ার থাকি। আবার কিছু জায়গায় ছাড় দিয়েই যাচ্ছি। পরিস্থিতি, অবস্থার ওপর নির্ভর করে।

কিছু কুসংস্কার তবু অবাক করে। যেমন, আফগানিস্তান সিরিজের শেষ ম্যাচের পর বললেন, ম্যাচের আগে থেকেই মনে হচ্ছিলো ইনজুরিতে পড়বেন। মুমিনুলকে আপনি বলেন দলের লক্ষ্মী, ও স্কোয়াডে থাকলেই নাকি দল জেতে। কোন হোটেল দলের জন্য বেশি পয়া, এসব ভাবেন। মাঠে আচমকা কাউকে হুট করে বোলিংয়ে আনা বা হুটহাট অস্বাভাবিক কোনো সিদ্ধান্ত …

মাশরাফি: এটা আমার হুটহটাই চলে আসে। এবারের ইনজুরিরটা যেমন, আগের রাতে নামাজ পড়ে বের হয়েছি। হুট করেই মনে হলো, “আজকে প্র্যাকটিসে ওই জিনিসটা ঠিকঠাক করতে পারিনি, ইনজুরিতে পড়ব না তো!” রাতে ঘুমানোর আগে আবার মনে হয়েছে। সকালে আবার মনে হয়েছে। কোনো কারণ ছাড়াই। ম্যাচে গিয়ে ঠিকই হয়ে গেল!

মাঠের সিদ্ধান্তে ক্রিকেটীয় ভাবনাই বেশি থাকে। তার পরও হুটহাট কিছু মনে আসলে করে ফেলি, মনে হয় কাজে দেবে। অনেক সময় হয়ে যায়।

এই ব্যাপারটা আমার মায়েরও আছে। আমার সব ইনজুরির সময় আগে থেকেই আমাকে সাবধান করেছিলেন আম্মা। সকালেই বলতেন, ‘আজকে সাবধানে খেলো’। আমি সতর্ক থাকি। তবু হয়ে যায়।

ড্রেসিং রুমেও আমি হুটহাট অনেক সময় পাশের জনকে বলেছি, এবার মনে হয় আউট হয়ে যাবে। দেখা যায় হয়ে গেছে। এসব আমার হুট করে চলে আসে। জানি না ঠিক কিভাবে, কোত্থেকে আসে।

আমার অবসরটাও হবে হুট করে। একদিন ইচ্ছে হবে, ছেড়ে দেব। বয়ে কয়ে কিছু হবে না, নিশ্চিত থাকতে পারেন।

এখন আপনার হোম সিরিজেও হোটেলে উঠতে ভালো লাগে না…

মাশরাফি: এটা হয়েছে মেয়েটার জন্য। মেয়েটা অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে রেখেছে। হোটেলে যাব, মেয়েটা গলা জড়িয়ে বলে, ‘আমাকে ছেড়ে যেও না। আমাকে স্কুলে নিয়ে যাও’, বা এরকম কথা, এটার সঙ্গে পেরে উঠিনা। সিরিজের সময় হোটেলে উঠেছি, মেয়েটা স্কুল থেকে সরাসরি হোটেলে চলে আসবে। সুইমিং করবে, আমার সঙ্গে গোসল করবে। কিসের ক্রিকেট, রান বা উইকেট, মেয়ের কাছে জীবনের সবকিছু তুচ্ছ।

সমাজ, রাষ্ট্র, জাতি, দেশ এসব নিয়ে ভাবেন?

মাশরাফি: আলাদা করে গভীরভাবে নয়। তবে অনেক ভাবনা আসে। আজ থেকে ১০-১৫ বছর আগেও যা ছিল, আমাদের জীবনটা এখন তার চেয়ে অনেক যান্ত্রিক, কৃত্রিম ও জটিল হয়ে গেছে। চারপাশে মানুষ ভীষণ অসহিষ্ণু। এত দ্রুত চারপাশ বদলে যাচ্ছে, এসব আমাকে পীড়া দেয়, অস্থির লাগে।

আমরা এখনও অনেক বেশি আন্তরিক একটা জাতি। অতিথিপরায়ণ। কিন্তু নিজেদের জন্যই নিজেরা কেমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছি। হৃদ্যতার চেয়ে শত্রুতা বাড়ছে দ্রুত। হানাহানি বাড়ছে। মানুষগুলো কেমন বদলে যাচ্ছে।

সিম্পল একটা কথা বলি। এখন লোকে রাস্তাঘাটে দেখা হলেই শুধু সেলফি তুলতে চায়। তুলেই চম্পট, কথাবার্তা নেই। আগে এমনও হয়েছে, রাস্তাঘাট আমি অনেকের সঙ্গে ৫ মিনিট, ১০ মিনিট, ১৫ মিনিট কথা বলেছি দাঁড়িয়ে। আমি কখনোই বিরক্ত হতাম না। এখন ৫ সেকেন্ডে সেলফি তুলে হাওয়া। আমার খুশি হওয়ার কথা, সময় বেঁচে যাচ্ছে। কিন্তু আমার খারাপ লাগে। কারণ আন্তরিকতাটা নাই। আমি তো কথা বলতেই চাই! কুশলাদি জিজ্ঞেস করা, হাসিমুখে কিছু বলা, বুকে জড়িয়ে ধরা, এসব ভালো লাগে। অটোগ্রাফের একটা অন্যরকম আবেদন ছিল। এখন সব কিছু কেমন কৃত্রিম হয়ে গেছে। দ্যাটস নট লাভ, এটা কৃত্রিমতা। আগের সেই আন্তরিকতা আমি খুব মিস করি।

দেশের বাইরে যেতে বরাবরই বিতৃষ্ণা আপনার!

মাশরাফি: উপভোগ করি না। দেশ ছাড়ার কথা ভাবলেই দম বন্ধ হয়ে আসে। এই যে নিউ জিল্যান্ড সফর সামনে, তার আগে অস্ট্রেলিয়ায় ক্যাম্প, এখন থেকেই আমার মন খারাপ। ভাবলে অস্থির লাগে। ওখানে সব গোছানো, আধুনিক জীবন। তবু স্বস্তি পাই না।

দেশের মানুষ, চারপাশের সবকিছু আমাকে স্বস্তির আবহ দেয়। বরাবরই আমার হোমসিকনেস বেশি। আগে নড়াইয়ের বাইরে থাকতে পারতাম না। এখন দেশের বাইরে থাকতে পারি না। আমার দেশের হাজারটা সমস্যা আছে, তবু শ্বাস নিয়ে শান্তি পাই। বাইরে থেকে দেশে ফিরে প্রথম পা দেওয়া মাত্রই মনে হয় শান্তিতে ভরে যায় ভেতরটা। এখানে সব কিছু আমার নিজের!

অনেক দিন বাঁচতে ইচ্ছে করে?

মাশরাফি: করে, অবশ্যই করে। সবারই ইচ্ছা করে বাঁচতে। আমারও করে খুব। আমার লাইফস্টাইল দেখে অনেকের এটা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কারণ জীবনভর দুরন্তপনা করেছি, ঝুঁকির সঙ্গে বসবাস। কিন্তু এখন ছেলেমেয়ের দিকে তাকালে মনে হয়, চলতেই থাকুক, অনেক বছর বেঁচে থাকি! বিডি নিউজ

৪ অক্টোবর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে