শুক্রবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৬, ১১:৪৬:২৫

কোথায় হারালো আমাদের খেলাটা?

কোথায় হারালো আমাদের খেলাটা?

এম আর এফ সোহান: ছোট বেলার অনেক কথা আজো স্পষ্ট মনে আছে। কিছু কিছু ব্যাপার থাকে যা সারাজীবন মনে থাকে। আব্বু মাথার তালুতে, হাত পায়ের তালুতে তেল ডলে দিয়ে বলত যা নদী থেকে গোসল করে আয়। আমি একা যেতাম না। আমাকে আশেপাশের চাচাদের সাথে পাঠান হত। নদীর পাড়ে যাওয়ার পর আমাকে কলার পাতা মাথার উপরে দিয়ে বসিয়ে রাখা হত। চাচারা তাদের এবং সমবয়সি বড় ভাইদের তোয়ালে, গামছা, সাবান ইত্যাদি জমা রাখা হত আমার কাছে।

নদীর পারে দাগ কাটা হত, দুই ভাগে তারা ভাগা ভাগি হত। এর পর শুরু হত যুদ্ধ-কাবাডি কাবাডি কাবাডি।

কত স্মৃতি। তাদের দম ছাড়া নিয়ে ঝগড়া হত, দাগ পার হওয়া নিয়ে ঝগড়া হত, ছুয়ে দেওয়া নিয়ে ঝগড়া হত। গ্রাম্য ভাষায় এটাকে বলে ঠ্যাটামি। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঠ্যাটা বলত। একজন আরেকজনকে ঠ্যাটা বলত। মাঝে মাঝে ঝগড়া থেকে তা মারামারিতে পরিণত হত।

খেলা শেষে জয়ী পক্ষ হেরে যাওয়া পক্ষকে দেখিয়ে বিজয় মিছিল করত। কত রকম তর্ক বিতর্ক হত। এরপর সবাই একসাথে গোসলে নেমে ডুবডুবি, সাতার প্রতিযোগিতা, ঝিনুক খেলা আরো কত কি! এ মানুষগুলোর হাতেই আমার সাঁতার শেখা। হাতের উপর ধরে ধরে সাঁতার শিখিয়েছেন। গোসল শেষে বাড়িতে যাওয়ার পর আম্মু ক্রিম, পাউডার, কপালের এক পাশে নজর তিলক দিয়ে দিত। এরপর আব্বু, আম্মু, দাদু আর অমি একসাথে খেতে বসতাম। খেতে খেতে কাবাডি খেলার গল্প হত। কে কিভাবে পড়ে গেছিল, কার দম শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ছুট দিয়ে দাগের মধ্যে ছিল, কে কে মারামারি করেছিল, কারা জিতেছে ইত্যাদি নিয়ে গল্প হত। গল্প বলতে বলতে কখনো কখনো হেসে একাকার হয়ে যেতাম। দাদু একটার পর একটা প্রশ্ন করত আর আমি উত্তর দিয়ে যেতাম।

সবাই আমার এই গল্পগুলো মনযোগ দিয়ে শুনত। এর কারন হতেপারে আমার চোখে তারা এর মাঝে আনন্দ দেখতে পেত। কিন্তু এর চেয়ে বড় ব্যাপারটা হল কাবাডি খেলাটা ঐতিহ্যে পরিনত হয়ে গেছিল। দৈনন্দিনকার ঐতিহ্য। তাদের দৈনিক ঝগড়া হত কিন্তু পরের দিন আবার নতুনকরে শুরু হত খেলা। তারা গতকালের সব ঝগড়া ভুলে যেত। যেন কিছু হয়নি। এখনো সেদিন গুলো মনে পড়লে বুকের ভেতর সুখ অনুভুত হয়। হাজার বছর বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে।

আমাদের গ্রামের সাথে অন্য গ্রমের কাবাডি খেলা হত। জয়ী দলের পুরস্কার হত একুশ ইঞ্চি টিভি। আমাদের গ্রাম জিতলে পুরো হৈ-হুল্লোড় লেগে যেত। পুরো গ্রাম উৎসব মুখর হয়ে যেত। আনন্দে মুরব্বিদের চোখও জ্বল জ্বল করত।


অথচ কই হারিয়ে গেল এই কাবাডি? কিভাবে হারিয়ে গেল এই ঐতিহ্য? এর কারনই বা কি? ফিরিয়েই আনা কি সম্ভব?

কাবাডি হারিয়ে যাওয়ার প্রধান কারন হচ্ছে গ্রাম পর্যায়ে এখন আর কেউ কাবাডি খেলে না। বাংলাদেশে বড় বড় কাবাডি টুর্নামেন্ট হয়। কিন্তু কজনইবা এর খোঁজ জানে?

এইযে গত ১১ তারিখে ভারত বনাম বাংলাদেশ খেলা হয়ে গেল। যেখানে ভারতের স্কোর ৫৭ আর বাংলাদেশের মাত্র ২০ পয়েন্ট। এরকমকি হওয়ার কথা ছিল আমাদের জাতীয় খেলার? কজনই জানেন? কজন দেখেছেন টিভিতে? তবে বুঝতেই পারছেন যে প্রচারনার কত অভাব। এই কাবাডি খেলার উৎস হওয়া উচিৎ ছিল বাংলাদেশের, অথচ উইকিপিডিয়ায় খোজ নিলে দেখা যায় এর অরজিন লেখা ভারত। এ ক্ষতি কি পূরনীয়।

এবার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে অনেক ছোট ভাইকে জিজ্ঞাসা করেছি যে আমাদের জাতীয় খেলা কি? বেশীর ভাগই বলেছে ক্রিকেট। এর আরো বেশ কিছু বলেছে ফুটবল। কিন্তু কষ্টের বেপার হল খুবই অল্প সংখ্যক জানে যে আমাদের জাতীয় খেলা কাবাডি। এ অজ্ঞতা কার?

বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশান নামে বাংলাদেশের কাবাডি পরিচালন সংস্থা। কিন্তু কে জানে কোথায় এর কার্যালয়? কাবাডি দলে ঢোকার নিয়ম কি? পচানব্বই ভাগ মানুষ জানেনা। তবে তো অবশ্যই এর ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে। আর এটা গ্রাম পর্যায়ের ঐতিহ্যবাহি খেলা অথচ গ্রামেই আর এর প্রচলন নেই।

স্কুলে স্কুলে ক্রিকেট খেলা হয়, ফুটবল হয়, ভলিবল হয় কিন্তু জাতীয় খেলা কাবাডি হয় না। কোন চর্চা হয় না কাবাডি নিয়ে?

যদি বাংলাদেশকে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ করতে হয় তবে সকল স্কুলে স্কুলে এর চর্চার প্রচলন বাড়াতে হবে। প্রচারনা বাড়াতে হবে যাতে করে মানুষ জানতে পারে যে বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশান নামে বাংলাদেশে একটি কাবাডি সংস্থা আছে। প্রচার করতে হবে কিভাবে কাবাডি টিমে খেলার সুযোগ পাওয়া যায়। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলা গ্রামের ছেলেদের কাছে সহজ করে তুলতে হবে কাবাডি টিমে ঢোকার পদ্ধতি। প্রত্যেক বছর কাবাডি ডিভিশান লিগ খেলা চালু করতে হবে, কাবাডি প্রিমিয়ার লিগ চালু করতে হবে। এবং এগুলো ঢাক ঢোল পিটিয়ে চালু করতে হবে। যাতে করে দেশের এবং দেশের বাইরের মানুষের কানে পৌছতে পারে। টিভিতে প্রচারণা হতে হবে জমজমাট। তবেই যদি এর উন্নতি হয়।

ছোট সময় যে চাচাদের কাবাডি খেলা দেখেছে সে চাচাদের বয়স হয়েছে। তারা বিয়ে সাদী করে সংসার, সন্তান নিয়ে ব্যাস্ত। আমরা বড় হয়ে গেছি। কেউ ঢাকায়, কেউ জেলা শহরে, কেউ অন্য কোথাও পড়া ও জীবিকার টানে চলে এসেছে। যারা এখন গ্রামে আছে তাদের কাবাডি নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই।

এখনকার ছেলেরা আর কাবাডি খেলে না। তাদের প্রিয় খেলা ক্লাস অফ ক্লান। এখনকার ছেলেদের গায়ে কাদা মাখতে চায়না। মোবাইলে মোবাইলে চলে খেলা। সেইই ভাল। বসে বসে খেলা যায় আবার শুয়ে শুয়েও খেলা যায়।-খেলাধুলা
১৪ অক্টোবর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে