নাজমুল হক তপন: গতকাল রাতের মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় স্টেডিয়াম। ৫৪ বল হাতে রেখেই ম্যাচ তথা সিরিজ জিতল বাংলাদেশ। সাব্বির রহমান উইনিং স্ট্রোকটা নিতেই আমরা আমরা খোশ মেজাজে গল্প করতে করতে ঢুকে পড়লাম মাঠে। এরই মধ্যে শেষ হল পুরস্কার বিতরণী পর্ব। আমরা মাঠের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে আড্ডা দিলাম বেশ একটা সময়। ভারতীয় সাংবাদিকদের বক্তব্য- ‘এই বাংলাদেশ আগামী বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হবে।’
আমরা যতই বলি এখনও অনেক জায়গায় অনেক দুর্বলতা আছে। বিশ্বকাপ জেতার মত লিজেন্ডারি প্লেয়ার, অবকাঠামো আমাদের নাই। বড় জোর আমরা একটা ক্রমউন্নতির পথে থাকা দল, এর বেশি না। কিন্তু ভারতীয় সাংবাদিকরা এটা মানবেই না। লিজেন্ডারি প্লেয়ার তো তোমরা পেয়ে গেছ? অবাক চোখে তাকালাম ভদ্রলোকের দিকে। বললেন- দেখ তোমাদের মুস্তাফিজের দিকে। কি ন্যাচারাল সুইং? কি নিখুঁত লেংথে বল করে। স্লোয়ার আর কাটারগুলো তো ভয়ঙ্কর! যোগ করলেন- একটা বাচ্চা ছেলে। এখন বোলিং করছে ১২৫/১৩০ কিমি গতিতে। একবার ভাবো তো যদি আরও ৭/৮ কি.মি. বেশি গতিতে বোলিং করে তাহলে তোমাদের মুস্তাফিজ তো আনপ্লেইয়েবল হয়ে উঠবে।
এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেল প্রেস কনফারেন্স। প্রথমে পরাজিত দলের অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি। বাংলাদেশের কাছে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে সিরিজে হার, স্বভাবতই ভারতীয় সাংবাদিকরা প্রশ্নবানে জর্জরিত করতে লাগলেন ধোনিকে। একটা সময় উঠল বাঁহাতি পেসার মুস্তাফিজুর রহমানের কথা। বেশ কিছুটা সময় ধরে বাংলাদেশের এই তরুণ পেসারকে নিয়ে কথা বললেন ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের এই সফলতম অধিনায়ক। প্রথম ম্যাচের পর মুস্তাফিজকে নিয়ে যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করেই মাঠে নেমেছিলেন, বললেন ধোনি। স্বীকার করে নিলেন, মুস্তাফিজকে তাদের ব্যাটাসম্যানেরা স্বাভাবিকভাবে খেলতে পারেননি। এই বাঁহাতির কাটারে নিজেও বিভ্রান্ত হয়েছেন, এটা মেনে নিলেন ভারত কাণ্ডারি।
মুস্তাফিজের বোলিং কেন ভয়াবহ তার ব্যাখ্যাও দিলেন ধোনি। তার ভাষায়- মুস্তাফিজের স্লোয়ারগুলো ঠিক ট্র্যাডিশনাল স্লোয়ারের মতো না। বেশ দ্রুত আর অনেক বেশি বল ক্যারি করে। উইকেটরক্ষকের হাতে পর্যন্ত যায়। এতে এজ (ব্যাটের কোনায় লাগা) হওয়ার সম্ভাবনা থাকে প্রবল। বল দুদিকেই কাট করে। আর কাট করে বল দ্রত বেরিয়ে যায়। যোগ করলেন, এই বাঁহাতির বিপক্ষে তার দলের দুয়েকজন হয়ত ভুল শটে আউট হয়েছেন। কিন্তু বাঁহাতিকে খেলতে তাদের সমস্যায় পড়তে হয়েছে।
ভারত অধিনায়কের পর সংবাদ সম্মেলনে আসলেন সিরিজ-জয়ী অধিনায়ক মাশরাফি মর্তুজা। আর তার সঙ্গী টানা দ্বিতীয় খেলায় ম্যান অব দ্য ম্যাচ পুরস্কার পাওয়া মুস্তাফিজুর রহমান। ইংরেজি তো অনেক দূরের কথা, বাংলায় করা প্রশ্নগুলোরও ঠিকমতো জবাব দিতে পারছিলেন না এই মাঠের নায়ক। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় তাকাচ্ছিলেন মাশরাফির দিকে। আগের ম্যাচে ধোনির সঙ্গে ধাক্কা ধাক্কি হল, সেই ধোনির উইকেট নেওয়া প্রসঙ্গে মুস্তাফিজ বললেন- উইকেট উইকেটই। ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা খুব ভাল খেলে। তাই সবার উইকেট পাওয়াতেই ভাল লাগছে।
প্রথম ম্যাচে রানিং জোনে ঢুকে পড়ে ব্যাটসম্যনের সামনে দাঁড়ানোর ঘটনা গতকালের খেলায় একবারের জন্যও করেননি মুস্তাফিজ। এ প্রসঙ্গে মুস্তাফিজের ভাষ্য- আগের দিন হিথ স্ট্রিক (বোলিং কোচ) এটা শুধরে দিয়েছেন। তার হয়ে বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তর দিলেন মাশরাফি। তার উপর কেন আস্থা রেখেছেন, দ্বিতীয় স্পেলে তাকে ফেরানো- সব কিছুই বললেন মাশরাফি। হিথ স্ট্রিক- মাশরাফি যে তাকে বুক-পিঠ দিয়ে আগলে রেখেছেন সুস্পস্ট হয়ে গেল এটাও। ভারতের বিপক্ষে প্রথম সিরিজ জয়, বাড়তি প্রাপ্তি হিসাবে এমন একজন জিনিয়াসকে পাওয়া- সব মিলিয়ে পুরোপুরি ঈদের আনন্দ নিয়ে মধ্যরাতে প্রস্তুতি নিলাম বাসায় ফেরার।
সিএনজি চালককে বললাম, কত নিবা? বেশ অবাক ব্যাপার। কম বয়েসী (২২/২৩ বছর) এই ড্রাইভার বলল- ভাই যা ইচ্ছা দিয়েন। বাংলাদেশ জিতেছে এমন দিনে কি আর ভাড়া চাব?
সিএনজি স্টার্ট করার আগে ওই চালক জিজ্ঞাসা করল- ভাই মুস্তাফিজের বোলিং নিয়ে অন্য কোনো ভেজাল লাগবে না তো? বাংলাদেশের তো আর ক্ষমতা নাই। কোনো এক প্যাঁচে ফেলাই দিয়্যা খেলা বন্ধ করে দেবে? আমি আর আমার কলিগ বললাম- কোনো ভয় নাই। মুস্তাফিজের বোলিংয়ে কোনো খুঁতই নাই। বেশ খুশি হয়ে বলল- একটা ভাল কাজ হইছে। বিশ্বকাপে যেভাবে হারাইছে উচিৎ শিক্ষা হইছে ভারতের।
কথায় কথায় ওই চালক জানালো- সে আশরাফুলের ভীষণ ভক্ত। আশরাফুলকে দলে ফেরানোর মানববন্ধনে অংশ নিতেই স্টেডিয়ামে আসে। যেদিনই এমন কর্মসূচি থাকে সেদিনই সে মাঠে আসে এবং মানব বন্ধনে অংশ নেয়। ওই চালকের কথায়- ভাই এই দলে যদি আশরাফুল থাকতো তাহলে দেখতেন বিশ্বকাপ জিততাম।
এই পর্যায়ে মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন দেখা দিলো। যে আনন্দে মন পরিপুর্ণ হয়ে উঠেছিল সে জায়গাটিতে ভর করল শঙ্কা।
একে একে চোখের সামনে ভেসে উঠলো বাংলাদেশ ক্রিকেটে হারিয়ে যাওয়া একটা একটা কক্ষচ্যুত নক্ষত্রের চেহারা। অনেক প্রতিভা পেয়েছি আমরা। কিন্তু কয়জনকে রক্ষা করতে পেরেছি? আল শাহরিয়ার রোকনের কথা নিশ্চয়ই অনেকেরই মনে আছে। এরপর মেহরাব হোসেন অপি,পরবর্তী সময়ে অলক কাপালি, আফতাব আহমেদ, শাহরিয়ার নাফিস কিংবা মোহাম্মদ আশরাফুল। চারিদিকে হাজারো প্রলোভনের ফাঁদ। তারকা খ্যাতি, মিডিয়ার মাতামাতি সঙ্গে টাকার বান্ডিল নিয়ে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাড়াকাড়ি। ফিক্সিং- বেটিং কিংবা হ্যাপিদের মত আধুনিক উর্বশীদের ঝাঁপিয়ে পড়া। এসব প্রলোভন জয় করে মাঠের খেলায় মুস্তাফিজরা কতটা নিষ্ঠাবান থাকতে পারবে?
মনে পড়ে গেল শচীন টেন্ডুলকার আর বিনোদ কাম্বলির কথা। ক্রিকেট এক্সপার্টদের অনেকেই মনে করেন- প্রতিভায় শচীনের থেকেও এগিয়ে ছিলেন কাম্বলি। কিন্তু কাম্বলি একটা বিস্মৃতপ্রায় নাম। আর আকাশাছোঁয়া উচ্চতায় উঠে আছেন শচীন। কাম্বলি প্রায়ই দুঃখ করে বলেন- আমি আর শচীন একদম সমান সমান। পার্থক্য শুধু শচীনের অজিতের মতো দাদা আছে, আমার কোনো দাদা নাই।
শচীনের সবটুকু জুড়েই আছেন অজিত। শচীনের ছাতা তার পরিবার। পারিবারিক মূল্যবোধ শচীনকে আজকের শচীন করেছে। ক্রিকেটের শুদ্ধপুত্র শচীনের পরিবার নিয়ে একটি ছোট্ট ঘটনা উল্লেখ করাটাকে প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করছি। বাসায় কোনো অতিথি এলে শচীনের মা বলেন- টেন্ডু দরজাটা খোল তো বাবা?
মুস্তাফিজের বয়স মোটে ১৭। বুদ্ধি বিবেচনার জায়গা থেকে বিচার করলে এখনও কৈশোরের সেই লাজুক ছেলেটিই আছে সে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলেটির গায়ে কাদা মাটির গন্ধ। কাদামাটির এ রত্নটিকে কে অজিতের মত দাদার ভূমিকায় সব প্রলোভন থেকে আগলে রাখবেন? একা মাশরাফি কতদিন পারবেন?
আমাদের কক্ষচ্যুত নক্ষত্রের সংখ্যাটা যে অনেক, তাই ভয়টাও বেশি।-জাগো নিউজ
৩১ অক্টোবর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস