বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৬, ০১:৩২:২৮

কোথায় হারিয়ে গেলেন সৈয়দ রাসেল, এখন কি করছেন?

কোথায় হারিয়ে গেলেন সৈয়দ রাসেল, এখন কি করছেন?

দেবব্রত মুখোপাধ্যায়, ঢাকা: ফোনে কণ্ঠটা শুনেই বুঝলাম, কিছু একটা সমস্যা। কথা তো তার সাথে মাঝে মাঝে হয়। জীবনে যতই জটিলতা থাক না কেনো, ফোন পেলেই ‘দাদা’ বলে একটা হাক দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, সব ঠিক আছে।

আজও কণ্ঠে সেই ডাকটা ছিলো, কিন্তু কোথায় যেনো প্রাণ খুজে পাচ্ছিলাম না। একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোনো সমস্যা?’ খানিকটা সময় চেপে যাওয়ার চেষ্টা করার পর বললো, ‘দাদা, বিসিবি মনে হয় অপারেশনটা করাবে না। তাহলে আমার আর ক্রিকেট খেলা হবে না।’

হ্যা, বাংলাদেশের বহু জয়ের নেপথ্য নায়ক সৈয়দ রাসেল এখন এই সংকটের দুয়ারে দাড়িয়ে আছেন। শুনতেও কষ্ট লাগে যে, বোর্ডের একটু সম্মতির অভাব আমাদের এক জাতীয় তারকার জীবনটাকেই আজ প্রশ্নের সামনে দাড় করিয়ে ফেলেছে!

যখন বাংলাদেশ দুই ইনিংস বল করতে পারতো না, সেই সময়ে ৬ টেস্টে তার ১২টি উইকেট। ৫২ ওয়ানডেতে ৬১ ও ৮ টি-টোয়েন্টিতে ৪ উইকেট।

সৈয়দ রাসেল জাতীয় দলের জার্সি গায়ে ঠিক কী করেছেন, সেটা পরিসংখ্যান দিয়ে আপনি বুঝতে পারবেন না। ম্যান অব দ্য ম্যাচের হিসেব খুলে বুঝতে পারবেন না, অস্ট্রেলিয়ায়, ভারত বা শ্রীলঙ্কাকে সেই যুগে হারানোয় রাসেলের ভূমিকাটা কী। সেটা বুঝতে আমরা ক্রিকেট দর্শক হতে হবে।

এক প্রান্ত থেকে ভয়ানক কৃপণ বোলিং, ছোট ছোট সুইংয়ে অপ্রস্তুত করে ফেলা ব্যাটসম্যানদের এবং শুরুতে একটা বা দুটো উইকেট নিয়ে এলোমেলো করে ফেলা প্রতিপক্ষের ব্যাটিং লাইনআপ। রাসেলের এই ১০ ওভারে ৩০ রানের কমের অনেক স্পেলের ওপর দাড়িয়ে কখনো মাশরাফি, কখনো সাকিব, কখনো রফিক বাংলাদেশকে গড়ে দিয়েছেন বিজয়ের মঞ্চ। রাসেল আড়ালে পড়ে গেছেন।

ম্যাচশেষে রাসেলের ডাক পড়েনি পুরষ্কার বিতরণী মঞ্চে। পরদিন রাসেলকে নিয়ে পত্রিকায় বড় প্রতিবেদন হয়নি, টিভিতে তার কথা প্রচার হয়নি। রাসেলের এই খেলোয়াড়ি চরিত্রের মতোই জীবনটাও রয়ে গেলো ছায়ায় ছায়ায়।

জাতীয় দলে একেবারে বিনা কারণে, বিনা প্রতিবাদে জায়গা হারিয়েছিলেন। তিনি যেহেতু পত্রিকার শিরোনাম নন, তাই লোকেরা তার নামে কখনো ইভেন্টও খোলেনি। কখনো কেউ টেরই পায়নি যে, দিনের পর দিন এই বাংলাদেশের মরা উইকেটে পেস বোলিং করে ফল এনে দিতে থাকা রাসেল আর জাতীয় দলে নেই। তারপরও রাসেল খেলছিলেন। খেলাটাই যে তার একমাত্র কাজ।

রাসেল আসলে কাঁধের ইনজুরিটা নিয়েই খেলছিলেন। চিরকালের আলোর আড়ালে থাকা এই বীরের জন্য যে কিছু করার দরকার, তার চিকিৎসা করানো দরকার, সে কথা বোর্ডও হয়তো খেয়াল করেনি। ২০০৭ সাল থেকে এই ইনজুরি নিয়ে চলছিলেন রাসেল।  ২০১৫ সালের শুরুর দিকে এসে আর পারলেন না।

জাতীয় লিগে খুলনার হয়ে আরেকটা ম্যাচ খেলার পর একেবারেই আর বল করতে পারছিলেন না। সে দফায় অবশ্য বোর্ড তার পাশে দাড়িয়েছিলো। ভারতে অপারেশন করিয়ে এনেছে। কিন্তু সেই অপারেশনের পর থেকে আজ প্রায় দুই বছর পার হতে চললেও রাসেল আর বল করতে পারছেন না। স্থানীয় চিকিৎসকরা দেখে বলেছেন, অপারেশন সফল হয়নি; আবার অপারেশন করাতে হবে।

আর সে জন্যই বোর্ডের কাছে লিখিত আবেদন করেছিলেন বাহাতি এই পেসার। শুরুতে ধারনা পেয়েছিলেন যে, আবেদনে ইতিবাচক সাড়া পাবেন। কিন্তু এখন জানতে পারছেন, বোর্ড পাশে থাকছে না। তাহলে রাসেল কী করবেন?

রাসেলের প্রজন্মের অনেক ক্রিকেটার নিজের এরকম অপারেশন তো বটেই, অন্যের দু চারটে অপারেশনও মুখে কথায় করিয়ে ফেলতে পারেন। রাসেল মুখ ফুটে কখনো কিছু বলেন না। কিন্তু ঘনিষ্ঠ হিসেবে জানি, ওই প্রজন্মে ক্রিকেট নামের এই টাকার হোলিখেলায়ও সবচেয়ে বঞ্চিত মানুষদের একজন এই রাসেল।

আইপিএল, বিপিএলের টাকার ঝনঝনানি তো তার অবদি কোনোদিনই পৌছায়নি। জাতীয় দলে যতোদিন খেলেছেন, বোর্ডের বেতনই একমাত্র বলার মতো উপার্জন ছিলো। এমনিতেই বাংলাদেশের এই মরা উইকেটে পেসারদের কোনো দাম নেই ক্লাবগুলোর কাছে। শীর্ষ ব্যাটসম্যানরা যখন ৫০ লাখে বিক্রি হন, পেসারদের দাম ওঠে ৫ লাখ। তার মধ্যে আবার জাতীয় দলের পুলে থাকায় ক্যারিয়ারের সোনালী সময়ের পুরোটা সময় রাসেলকে প্রায় বিনামূল্যে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ খেলতে হয়েছে। দলবদলের সময় দল পেতেন না। দলবদল শেষ হয়ে যাওয়ার পর সিসিএস, কলাবাগানের মতো ছোট দলগুলো সৌজন্যমূলক কয়েকটা টাকা দিয়ে খেলতে বলতো।

রাসেল অবশ্যই কিছুতেই এই আর্থিক সংকটের প্রসঙ্গ সামনে আনতে চান না। আগ বাড়িয়ে এসব কথা বললে লজ্জাও পান। আবার বন্ধুদের উল্লেখ করলেও রাসেলের কণ্ঠ দৃঢ় হয়ে ওঠে, ‘দাদা, বোর্ডের সাহায্য চেয়েছি, কারণ আমি বোর্ডের চাকরি করতাম। আমি জাতীয় দলে খেলেছি, সেই অধিকারে সাহায্য চেয়েছি। আমি করুনা চাই না। শুধু ক্রিকেট খেলতে চাই।’

৩২ বছর বয়স। এই বয়সেও মানুষ নতুন করে শুরু করে। এই বয়সেও মানুষ স্বপ্ন দেখে। এই বয়সে আমাদের একজন নায়ক শুধু একটু ক্রিকেট খেলার দাবি জানাচ্ছেন। কারো কাছে করুনা চাচ্ছেন না, সাহায্য চাচ্ছেন না। শুধু খেলার দাবি জানাচ্ছেন।

আজ ক্রিকেট বোর্ড মুস্তাফিজকে চিনেছে। তাসকিন, আল আমিন, রুবেল হোসেনের মতো গতিতারকাকে চিনেছে। কিন্তু যারা এই ভিতটা গড়ে দিলো, তাদের দাবিটা শুনবে না?

বাংলাদেশের পেসারদের মরা উইকেটে বল করিয়ে করিয়ে শারীরিকভাবে তো অনেক আগেই শেষ করে দেওয়া হয়েছে। মাশরাফি, তালহা জুবায়ের, মোহাম্মদ শরীফ, সৈয়দ রাসেল; সব এই মরা উইকেটের শিকার। আজ সেই দায়টা অন্তত মেনে নিয়ে রাসেলকে খেলার সুযোগ করে দেওয়া মানবিক দায় বোর্ডের।

সবকিছুর পরও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড অত্যন্ত পেশাদার ও মানবিক একটা সংস্থা। তার প্রমাণ আমরা আগে অনেকবার পেয়েছি। আশা করি, আবারও বোর্ড সভাপতি সৈয়দ রাসেলের এই ন্যায্য অধিকারটা পুরণ করে সেই প্রমাণ আবারও দেবেন।  
১৭ অক্টোবর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/হাবিব/এইচআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে