রবিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৬, ০৩:৩২:২৮

সাব্বির, আল আমিনদের শাস্তি কেন ‘অবৈধ’ নয়?

সাব্বির, আল আমিনদের শাস্তি কেন ‘অবৈধ’ নয়?

তারেক মাহমুদ : একটা তালিকা পাওয়া যাবে? বাংলাদেশে কোন আইন ভাঙলে কত টাকা জরিমানা হয়, সেই শাস্তির তালিকা?
ট্রাফিক আইন ভাঙলে জরিমানা হয়। কর ফাঁকি, হোটেলে অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেশন, প্রকাশ্যে ধূমপান--এরকম আরও কত কিছুর জন্য তো জরিমানার বিধান আছে। সবগুলোর একটা তালিকা চাই। দেখব কোন অপরাধের জরিমানা সবচেয়ে বেশি। কিছু ভয়ংকর অপরাধ আছে যেসবের শাস্তি শুধু জরিমানা দিয়ে হয় না। জেল-ফাসি হয়। সে তালিকা লাগবে না।

হঠাৎ জরিমানার শাস্তির তালিকা দরকার হয়ে পড়ল সদ্য শেষ হওয়া বিপিএলের কারণে। বিপিএলে দুই ক্রিকেটারের অদ্ভুত রকমের বড় অঙ্কের জরিমানা হয়েছে। একজন রাজশাহী কিংসের সাব্বির রহমান, আরেকজন বরিশাল বুলসের আল আমিন হোসেন। দুজনের বিরুদ্ধেই ‘গুরুতর’ অভিযোগ। বিসিবি তা প্রকাশ্যে না বললেও তা আর গোপন নেই। কানাকানিতেই জানাজানি হয়েছে ‘নারী অতিথি’র বিষয়টি। বিপিএলের চট্টগ্রাম অংশে নিজ নিজ দলের হোটেলে জাতীয় দলের এই দুই ক্রিকেটার ‘নারী অতিথি’র সঙ্গ উপভোগ করেছেন। সাব্বির নাকি তার রুমে কাকে নিয়ে গেছেন। আর আল আমিন নিজেই চলে গেছেন ‘অতিথি’র রুমে।

সাব্বিরের রুমে কেউ ঢুকছেন এবং আল আমিন কারও রুমে ঢুকছেন, সিসি ক্যামেরার ফুটেজে শুধু এটুকু দেখেই নির্ধারণ করা হয়ে গেছে জরিমানার অঙ্ক। আল আমিনের জরিমানা চুক্তির অর্ধেক পরিমান অর্থ, অর্থাৎ প্রায় ১৩ লাখ টাকা। সাব্বিরের জরিমানা ৪০ লাখ টাকার চুক্তির ৩০ শতাংশ। সেটিও ১‌২ লাখ টাকা। জরিমানার অঙ্ক চোখ কপালে তুলে দেবেই তো।

এ দুজন ছাড়া চতুর্থ বিপিএলে আরও এক ক্রিকেটারেরও বড় শাস্তি হয়েছে। রংপুর রাইডার্সের জুপিটার ঘোষ। তিনিও রুমে ‘নারী অতিথি’ নিয়ে গিয়ে সিসি ক্যামেরার জালে আটকা পড়েছেন। এই অপরাধে জুপিটারকে দল থেকেই বহিষ্কার করে দিয়েছে রংপুর। তবে জুপিটারের দাবি, টিম ম্যানেজমেন্টের এক কর্মকর্তার দেওয়া ম্যাচ ফিক্সিংয়ের প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়াতেই নাকি এই পরিণতি।

দুটি ভিন্ন ঘটনায় বিসিবি ও রংপুর রাইডার্সের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য প্রায় এক। অভিযুক্তদের বিপক্ষে শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধ ‘প্রমাণিত’ হয়েছে। তাঁরা এমন কিছু করেছেন, যা বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে মানানসই নয়। বিসিবির পরিদর্শক দলের গোয়েন্দা দৃষ্টিতেই হোটেলে ক্রিকেটারদের এসব অপকাণ্ড ধরা পড়েছে বলে খবর।

অন্যায় করলে শাস্তি হবে এবং অন্যায়কারীকেও তা মাথা পেতে নিতে হবে। কোনো আসর চলাকালীন এসব আইনের প্রয়োগ স্বাভাবিকভাবেই আরও কঠোর। আলোচিত-সমালোচিত বিপিএলকে কলুষমুক্ত রাখতে আইনের বাস্তবায়ন অবশ্যই জরুরি। তাছাড়া সাব্বির, আল আমিনের বিপক্ষে আগেও একই ধরনের শৃঙ্খলাভাঙ্গার অভিযোগ উঠেছিল। সতর্কবার্তা দেওয়ার পরও বারবার একই ঘটনা ঘটিয়ে গেলে ক’বার আর ক্ষমা পাবেন! এ দুজনকে শাস্তি দিয়ে বিসিবি চেয়েছে একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে, যাতে ভবিষ্যতে অন্যরা সতর্ক হয়।

তবু প্রশ্ন ওঠে।। সাব্বির, আল আমিনের জরিমানার অংকটা কীসের ভিত্তিতে ঠিক করা? আচরণবিধির কোন ধারায় বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুটি অঙ্কের জরিমানা করা হলো তাঁদের? ৩০ শতাংশ বা ৫০ শতাংশ কেটে নেওয়া হবে, এমন কোনো অপরাধ কি আসলেই নির্দিষ্ট করা আছে বিপিএল, বিসিবি বা কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজির আচরণবিধিতে? থাকলেও বাংলাদেশে এ ধরনের আর কোন অপরাধে এত টাকা জরিমানা হয়?

আরও একটা ব্যাপার--সাব্বির, আল আমিন কি জানতেন তারা যে ‘অপরাধ’ করছেন, সেটার এত বড় শাস্তি হতে পারে? যে খুন করে, সেও কিন্তু জানে খুনের সম্ভাব্য সাজা ফাঁসি। কমপক্ষে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড তো বটেই। কিন্তু ‘নারী অতিথি’র সঙ্গ এতটা ‌'ব্যয়বহুল' হয়ে যাবে, সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই হয়তো ছিল না সাব্বির-আল আমিনের। জুপিটার তো সরাসরিই বলেছেন, তাঁর রুমে যেদিন ‘নারী অতিথি’ গেছেন, তখন পর্যন্ত বিসিবি বা ফ্র্যাঞ্চাইজির কাছ থেকে তিনি এমন কোনো আচরণবিধি পাননি, যেটার আলোকে সতর্ক হতে পারতেন বা জানতে পারতেন, তিনি যা করছেন তা দল থেকে বহিষ্কার হওয়ার মতো অপরাধ।

জুপিটারের বক্তব্য হয়তো সবদিক থেকে গ্রহণযোগ্য নয়। টুর্নামেন্ট চলাকালীন রুমে নারী অতিথি নিয়ে যাওয়াটা যে ঠিক নয়, সেটা কাণ্ডজ্ঞান ব্যবহার করেই বোঝা যায়। এর জন্য লিখিত আচরণবিধি লাগে না। আর আচরণবিধি যদি সত্যিই তখনো হাতে পেয়ে না থাকেন, আচরণবিধিতে কী থাকতে পারে সেটা বোঝার মতো বয়স নিশ্চয়ই জুপিটার এবং তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ারের হয়েছে।

কিন্ত তবু বিসিবি কি দায় এড়াতে পারে? জুপিটারের বক্তব্যকে অসার ধরে নিয়েও বিসিবি, বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিল এবং রংপুর রাইডার্সের দায় এড়ানো সম্ভব নয়। যে টুর্নামেন্টে প্রতিবারই শৃঙ্খলা বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়, সেখানে খেলোয়াড়দের আগে থেকে এসব নিয়ে সচেতন না করা হলে সেটাও অপরাধের পর্যায়েই পড়ে, দায়িত্বে অবহেলার অপরাধ।

সাব্বির ও আল আমিন জাতীয় দলের ক্রিকেটার। হয়তো সে কারণেই জুপিটারের মতো শাস্তি নিয়ে অতটা উচ্চবাচ্য করেননি। ১৫-২০ লাখ টাকার চেয়ে ক্যারিয়ারটা যে অনেক বড়! কিন্তু বুকের ভেতর ক্ষোভের উদগীরণ তাঁদেরও হচ্ছে। ফেসবুকে ভিডিও শেয়ার করে সাব্বির ক্ষোভের কথা সরাসরিই জানিয়েছেন। যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা ঠিক নয় বলে দাবি তাঁর। আল আমিনেরও একটা ব্যখ্যা পাওয়া যাচ্ছে তাঁর ঘনিষ্ট মহলের মাধ্যমে। চট্টগ্রামে জাতীয় দলের এই পেসার যার রুমে গিয়েছিলেন, সেটা নাকি ছিল তাঁর এক বান্ধবীর রুম। চট্টগ্রামে কি একটা কাজে গিয়ে স্বামীসহ উঠেছিলেন আল আমিনদের টিম হোটেলে। বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতেই ওই রুমে যাওয়া এবং ৫-৭ মিনিট অবস্থান করা। আল আমিনের দাবি, তাতে এমন কি মহাভারত অশুদ্ধ হলো।

বিপিএলে এরকম ঘটনা যে শুধু সাব্বির, আল আমিন, জুপিটারই ঘটিয়েছেন, তাও নয়। প্রতিটি টিম হোটেলের সিসি ক্যামেরাতেই এরকম অসংখ্য ফুটেজ আছে, যেগুলো তদন্তের আওতায় আনলে টুর্নামেন্টের বেশিরভাগ বিদেশি খেলোয়াড়কে টাকাই দিতে হবে না ফ্র্যাঞ্চাইজিদের। সবাইকে জরিমানা করে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া যেত।

অভিযোগ আছে, একটি ফ্র্যাঞ্চাইজি তাদের হোটেলে খেলোয়াড়দের জন্য আলাদা ‌'মদিরালয়'ই বানিয়ে দিয়েছিল। রাতভর পার্টিং সংস্কৃতিও কিছু ফ্র্যাঞ্চাইজিরই চালু করা। সেসব পার্টি কখনো কখনো পরিণত হতো গণ-পার্টিতে। খেলোয়াড়দের সঙ্গে পরিচিত-অপরিচিত অনেক ‌‌'নারী অতিথির' যাতায়াত ছিল সেখানে। তাদের অনেকেরই নৈশবিহার শেষ হতো খেলোয়াড়দের রুমে গিয়ে। সাব্বির-আল আমিনের কাহিনি ধরা পড়ে গেলেও এসব ঘটনা কীভাবে যেন বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের পরিদর্শক দলের চোখ এড়িয়ে গেছে। তখন বিপিএলের অভিভাবকদের এই কঠোরতা থাকল না কেন?

অবাস্তব অঙ্কের জরিমানার পেছনে কারও বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, সে আলোচনা ভালোভাবেই আছে। আল আমিনের দল বরিশাল বুলসের মালিক পক্ষে বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা আছে বলে শোনা যায়। আল আমিনকে ম্যাচ ফির অর্ধেক জরিমানা করার মূল কারণ নাকি ফ্র্যাঞ্চাইজির অর্থসাশ্রয়! সেটা হলে একটা দিক দিয়ে তাঁর ভাগ্যটা ভালোই বলতে হবে। শাস্তি পাওয়ার আগেই হাতে পেয়ে গিয়েছিলেন অর্ধেক টাকা। নইলে চুক্তির অর্থের একশ ভাগই জরিমানা হলে কী করার থাকত আল আমিনের!

বিপিএলে এবার কিছু ভালো দিক ছিল। মাঠের ক্রিকেট ততটা না জমলেও খেলোয়াড়দের পাওনা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো নেতিবাচক আলোচনা নেই। কিছু বিষয় সন্দেহের বাতাবরণ ছড়িয়েছে। তবে ফিক্সিংয়ের অকাট্য প্রমাণ নিয়ে হাজির হতে পারেননি কেউ। সমালোচনার বড় বিষয় বরং হতে পারে একটি বিশেষ ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রতি বিসিবির দৃষ্টিকটু পক্ষপাতমূলক আচরণ। জাতীয় দলের একজন চলতি খেলোয়াড়কে ওই ফ্র্যাঞ্চাইজির শুভেচ্ছা দূত ঘোষণার মতো লজ্জাজনক কাজও করেছে বিসিবি। এসবও অবশ্য বিস্ময়কর কিছু ছিল না। বিপিএল টুর্নামেন্টটাই হলো স্বার্থের মালায় গাথা। এখানে স্বার্থের সংঘাত না থাকাটাই অস্বাভাবিক।

কিন্তু যাদের জন্য বিপিএল, যাদের ঘাম বিক্রি করে এত টাকার খেলা--সেই খেলোয়াড়দেরও স্বার্থের রাজনীতির চক্রে ফেলে দিতে হবে কেন? সাব্বির, আল আমিন, জুপিটাররা অন্যায় করলে শাস্তি প্রাপ্য। কিন্তু সেই শাস্তির মাত্রা কী, নির্ধারকই বা কি? আচরণবিধির কোনো ধারা, নাকি ব্যক্তি বিশেষ?

প্রথমটি হলেও এই ধারা অবশ্যই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। প্রশ্ন থেকে যায় তার মাত্রা আর প্রয়োগের ক্ষেত্রে একেক জনের বেলায় একেক নিয়ম করায়। আর যদি হয় দ্বিতীয়টি, হলে শাস্তিটাকেই বলতে হবে ‘অবৈধ।’-প্রথম আলো
১১ ডিসেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে