সোমবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬, ০১:৩১:০৬

বাংলাদেশ ফুটবল : গালভরা বুলি আর ব্যর্থতার ঝুলি

বাংলাদেশ ফুটবল : গালভরা বুলি আর ব্যর্থতার ঝুলি

সামন হোসেন : আর মাত্র কয়েক দিন। দেখতে দেখতে শেষ হয়ে এলো ২০১৬। খেলাধুলার জগতে কেমন গেল বছরটা? পেছনে ফিরে তাকালে উঠে আসবে  নানা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি! ধারাবাহিক বর্ষপরিক্রমায় আজ থাকছে বাংলাদেশের ফুটবল। ফুটবলে বছরটা ছিলো বেশ ঘটনাবহুল। বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে ব্যর্থতা দিয়েই বছরের শুরু। ব্যর্থতার তদন্তে উঠে আসে নানা ঘটনা।

নিষিদ্ধ করা হয় জাতীয় দলের পাঁচ ফুটবলারকে। এ বছরই তৃতীয় মেয়াদে বাফুফের সভাপতি হন কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে ধারাবাহিক ব্যর্থতার পর এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বেও ব্যর্থ মামুনুলরা। যার পরিসমাপ্তি ঘটে ভুটান লজ্জার মধ্যদিয়ে। এ বছর দেশি-বিদেশি মিলিয়ে পাঁচজন কোচের হাতে ছিলো জাতীয় দল। প্রথমবারের মতো ঢাকার বাইরে চার ভেন্যুতে পেশাদার লীগ মাঠে গড়ালেও আশানারূপ দর্শক মিলছে না। লীগটাকে কলঙ্কমুক্তও বলা যাচ্ছে না। তবে এতো হতাশার মাঝেও আশার আলো জ্বালিয়ে রেখেছে এদেশের নারী ফুটবল।

জাতীয় দলের ভুটান কলঙ্ক : সাফ ফুটবলে ব্যর্থতার রেশ কাটতে না কাটতে জানুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু গোলকাপেও হতাশ করে মামুনুলরা। পছন্দমতো দুর্বল দল এনেও ফাইনাল খেলতে পারেনি বাংলাদেশ। সাফের ব্যর্থতার পর বঙ্গবন্ধু কাপে ব্যর্থতায় চাকরি হারান মারুফুল হক। উপর্যুপরি ব্যর্থতার কারণে তদন্ত কমিটি করে বাফুফে। সাবেক ফুটবলার শেখ মোহাম্মদ আসলাম, ইলিয়াস হোসেন, আজমল হক তপনকে নিয়ে গড়া তদন্ত কমিটি চ্যাঞ্চলকর এক রিপোর্ট দেয়। মদ্যপানসহ রিপোর্টে উঠে আসে ফুটবলারদের উচ্ছৃঙ্খল জীবন।

ওই রিপোর্টের আলোকেই জাতীয় দলের অধিনায়কসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র ফুটবলারকে বিভিন্ন মেয়াদে নিষিদ্ধ করে বাফুফে। সিনিয়র ফুটবলারদের ছাড়া বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের শেষ ম্যাচে জর্ডানের কাছে ৮-০ গোলে হারে বাংলাদেশ। এশিয়ান কাপের প্রাক বাছাই পর্বের রাউন্ড-১ একই হাল। তাজিকিস্তানের অ্যাওয়ে ম্যাচে ৫-০ গোলে হারার পরও ঢাকার হার ১-০ গোলের। রাউন্ড-২ সবচেয়ে বাজে ফল বাংলাদেশ। ভুটানের সঙ্গে আগে খেলা আট ম্যাচের মধ্যে সাতটিতেই জিতেছিলো বাংলাদেশ।

একটি ড্র হয়েছিলো তাও ২০০৮ সালে। এই দলটির বিপক্ষেই এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বে বড় লজ্জায় পড়ে লাল সবুজের দল। ঢাকায় ভুটানের বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্রর পর, উপায়ন্তর না দেখে নিষেধাজ্ঞা তুলে মামুনুল, ইয়াসিনদের দলে ফেরায় বাফুফে। এতেও শেষ রক্ষা হয়নি, ১০ই অক্টোবর থিম্পুতে প্রথম বারের মতো ভুটানের কাছে ৩-১ গোলে জাতিকে লজ্জা দেয় বাংলাদেশ। এই হারে ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ের সর্বনিম্ন স্থান ১৮৬তে জায়গা করে নেয় মামুনুলরা।
 
কোচ নিয়ে নাটক : এ বছর দেশি-বিদেশি মিলিয়ে চারজন দায়িত্বে ছিলেন মামুনুলদের। শুরুটা হয়েছে দেশি মারুফুল হকের হাত ধরে। গত ডিসেম্বরে সাফের এক মাস আগে জাতীয় দলের দায়িত্ব তুলে দেয়া হয়েছিল মারুফুল হকের হাতে। ইউয়েফা ‘এ’ লাইসেন্সধারী এই কোচ সাফে বাংলাদেশকে সেমিফাইনালে ওঠাতেই ব্যর্থ হন। তার অধীনে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপেও সেমিফাইনালে বাহরাইনের একটি বয়সভিত্তিক দলের কাছে হারে বাংলাদেশ। টানা ব্যর্থতায় চাকরি হারান মারুফ।

তার জায়গায় স্ত্রীর চাকরি সূত্রে ঢাকায় বসবাস করা স্পেনের গঞ্জালো সানচেজ মরেনোর হাতে উঠে জাতীয় দলের দায়িত্ব। অনভিজ্ঞ গঞ্জালোর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জর্ডানের কাছে ৮-০ গোলে হারে মামুনুল বাহিনী। এক ম্যাচেই চাকরি হারান গঞ্জালো। আবারো ফিরিয়ে আনা হয় ডাচ কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফকে। তার অধীনে এশিয়ান কাপের প্রাক বাছাইয়ে তাজিকিস্তানের বিপক্ষে দুই রাউন্ডেই হারে বাংলাদেশ। আবারো কোচিংয়ে পরিবর্তন আনে বাফুফে।

এবার দায়িত্ব ওঠে  হাইপ্রোফাইল টম সেইন্টফিটের হাতে। সঙ্গে নিয়োগ দেয়া আফ্রিকান এক ফিটনেস ট্রেনার ও  গোলরক্ষক কোচ। একই সময়ে টেকনিক্যাল এন্ড স্ট্রাটেজি ডিরেক্টর নিয়োগ পান ইংল্যান্ডের পল স্মলি। বেলজিয়ামের টম সেইন্টফিট বাংলাদেশের দায়িত্ব নেয়ার আগে টোগোসহ ছয়টি দেশের জাতীয় দলের দায়িত্বে ছিলেন। অভিজ্ঞ এই কোচও সফলতা এনে দিতে পারেননি। তার সময়েই ভুটানের মতো দেশের কাছে হারতে হয়েছে বাংলাদেশকে।

বাফুফে নির্বাচনে ফের সালাউদ্দিন : সালাউদ্দিনকে কোনো ভাবেই বাফুফের সফল প্রেসিডেন্ট বলা যাবে না। তার পরেও নানা জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে তৃতীয় মেয়াদেও ক্ষমতার মসনদে বসেন কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। যদিও তৃতীয় মেয়াদে সভাপতি হতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাকে। সীমাহীন মিথ্যাচার, নানামুখী অশুভ তৎপরতা, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ভোটার ডেলিগেটদের প্রভাবিত করার চেষ্টা, সর্বোপরি নজিরবিহীন ‘নন স্পোর্টিং’ পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে গত এপ্রিলে র‌্যাডিসন হোটেলে অনুষ্ঠিত হয় এবারের নির্বাচন।

নরসিংদীর এমপি কামরুল আশরাফ পোটনকে পরাজিত করে সালাউদ্দিন টানা তৃতীয়বারের মতো বাফুফে সভাপতি নির্বাচিত হন। সিনিয়র সহ-সভাপতি পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয় সালাহউদ্দিন প্যানেলের সালাম মুর্শেদী। সহ-সভাপতি পদে নির্বাচিত হন কাজী নাবিল আহমেদ, বাদল রায়, মহিউদ্দিন আহমেদ মহি ও তাবিথ আউয়াল। এর মধ্যে একমাত্র তাবিথ আউয়াল স্বতন্ত্র প্রার্থী। বাকি তিনজন সালাহউদ্দিন প্যানেলের। এছাড়া, ১৫টি সদস্য পদের মধ্যে ১২টিতে জয়ী হয়ে ‘বাঁচাও ফুটবল প্যানেল’র বিপক্ষে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় সালাউদ্দিনের সম্মিলিত পরিষদ। দায়িত্ব নিয়ে পুরনো রীতিতেই বাফুফে চালাতে থাকেন সালাউদ্দিন।

মহিলা ফুটবলে আশার আলো : চরম হতাশার মাঝে আলো দেখিয়েছে দেশের মহিলা ফুটবল। মহিলা ফুটবলের সফলতার শুরুটা হয় এপ্রিল মাসে। তাজিকিস্তানে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে টানা দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জেতে বাংলাদেশের মেয়েরা। তারই ধারাবাহিকতায় ঢাকায় অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাই পর্বে চ্যাম্পিয়ন হয় কৃষ্ণা মার্জিয়ারা। এই চ্যাম্পিয়নশিপের সুবাদে এশিয়ার শেষ আটে জায়গা পায় বাংলাদেশ। আগামী বছর থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত চূড়ান্ত পর্বে বাংলাদেশ সেরা তিনে থাকতে পারলেই জায়গা পাবে ফিফা অনূর্ধ্ব-১৭ মহিলা বিশ্বকাপে। মেয়েদের ধারাবাহিক সাফল্যে আশা জেগেছে সাফ ফুটবলেও। যা শুরু হয়েছে ভারতের শিলিগুড়িতে।

ঘরোয়া ফুটবলেও উন্নতি নেই : বাফুফে নির্বাচনের কারণে এবারকার মৌসুম শুরু হয়েছে জুন মাসে। ফেডারেশন কাপ বাদ দিয়ে যা শুরু হয় স্বাধীনতা কাপের মধ্যদিয়ে। মৌসুম শুরুর ওই টুর্নামেন্টে শিরোপা জেতে চট্টগ্রাম আবাহনী। এরপর শুরু হয় ফেডারেশন কাপ। দুই দল থেকে পারিশ্রমিক নিয়ে জটিলতায় পড়া মামুনুল, নাসিরউদ্দিন চৌধুরীরা ফিরলেও ফেডারেশন কাপ আর জিততে পারেনি চট্টগ্রামের দলটি। তাদের হারিয়ে এই তিন বছরের শিরোপা খড়া কাটায় ঢাকা আবাহনী।

লীগ শিরোপারও দৌড় গোড়ায় চার বারের চ্যাম্পিয়নরা। এবারের লীগের বেশ কয়েকটি সমঝোতার ম্যাচ হয়েছে বলে দাবি করেছেন অনেকে। এর মধ্যে হবু চ্যাম্পিয়ন আবাহনী  ও শেখ জামালের ম্যাচটি অন্যতম। ওই ম্যাচে নির্ধারিত ৯০ মিনিট পর্যন্ত ২-১ গোলে পিছিয়ে ছিলো ঢাকা আবাহনী। কিন্তু শেষ মুহূর্তে পুরো মৌসুমে গোলহীন থাকা নবীব নেওয়াজ জীবনের জোড়া গোলে ৩-২এ জয় পায় আকাশী হলুদ শিবির। এর বাইরে মোহামেডান-রহমতগঞ্জ ম্যাচ নিয়েও সন্দেহ আছে। এরপরও ঐহিত্যবাহী দলটি আছে রেলিগেশন শঙ্কায়।

ঘটনা বহুল এ বছরে নতুন এক ঘটনার জন্ম দিয়েছে বাফুফে। চারিদিকে নানা সমালোচনার পরও বছরের শেষ দিকে এক ক্যালেন্ডার ঘোষণা করেছেন দেশের ফুটবলের শীর্ষ সংস্থাটি। নয়া টেকনিক্যাল এন্ড স্ট্রাটেজি ডিরেক্টর পল স্মলির প্রেসক্রিপসনে করা এই ক্যালেন্ডার আগামী জানুয়ারি থেকে বাস্তবায়ন করার কথা বলেছে বাফুফে। ওই ক্যালেন্ডার যদি বাস্তবায়নের স্বদিচ্ছা থাকে বাফুফে, তবে সত্যিই পাল্টে যাবে দেশের ফুটবল। নতুন বছরে সেই প্রত্যাশায় থাকলো দেশবাসী। এমজমিন

২৬ ডিসেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে