বুধবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০১৭, ১২:০৫:১০

দখল হচ্ছে অধিনায়ক মাশরাফির খেলার মাঠ

দখল হচ্ছে অধিনায়ক মাশরাফির খেলার মাঠ

তুহিন সাইফুল্লাহ ও মারুফ সামদানি: চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের জন্মস্থান নড়াইল। বাংলাদেশ ওয়ানডে ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার বাড়িও এখানে। তিনি খেলাধুলা করেছেন নড়াইল জেলা শহরের এক মাঠে, যেটি শহরবাসীর কাছে বেশি পরিচিত কুড়িরডোব মাঠ নামে। অনেকে চেনেন ওয়েলিংটন মাঠ নামেও।

শহরের মাছিমদিয়া এলাকায় এস এম সুলতানের বাড়ি থেকে জমিদারবাড়ি যেতে হাতের ডানে এই মাঠ। খেলাধুলা, শহরের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের কেন্দ্র এটি। কিন্তু দখলের কবলে পড়ে দিনে দিনে ছোট হচ্ছে মাঠ। সীমিত হচ্ছে খেলাধুলার সুযোগ, যা দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন অনেকে। যেমন বললেন মাশরাফির বাবা গোলাম মুর্তজা। তিনি বললেন, তিনি এই মাঠে খেলাধুলা করেছেন। মাশরাফিও করেছেন। শুধু খেলাধুলা নয়, স্বাস্থ্যবান্ধব পরিবেশের জন্য মাঠটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু প্রশাসন ও রাজনীতিকদের উদাসীনতার কারণে মাঠটির এই হাল হয়েছে।

মাঠটি ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট বিদ্যালয় ও নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের নামে হলেও তা সবার জন্য উন্মুক্ত। মাঠ দখলও হয়েছে খোলামেলাভাবে।

মাঠে ঢুকতেই চোখে পড়ল মাঝ বরাবর রাস্তা। সাইকেল থেকে শুরু করে ট্রাক—সব ধরনের যানবাহন অবাধে চলছে রাস্তাটি দিয়ে। একটু ভেতরে গিয়ে দেখা গেল অনেক ছোট ছোট ঘর, কোনোটার টিনের চাল, কোনোটার খড়ের ছাউনি। গুনে দেখা গেল, এসব ঘরে ৭৫টি পরিবার বসবাস করছে। তাদের হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল মাঠে বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরছে। তাদের রান্নার জ্বালানি শুকানো হচ্ছে মাঠে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, কাপড়ও শুকানো হচ্ছে। তাদের লাগানো গাছপালার কারণে মাঠ ক্রমে আরও গ্রাস হচ্ছে। চারপাশে ময়লা-আবর্জনা। মাঠের জায়গায় পাঁচটি দোকান তৈরি করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এর একটি ওয়েল্ডিং কারখানা, মাঠের বেশ ভেতরে ঢুকে গেছে। কারখানাটির মালিক আকবর হোসেন বলেন, তিনি কলেজের কাছ থেকে ৫০০ টাকায় ভাড়া নিয়েছেন।

মাঠে ঘরগুলোর মধ্যে ঝুপড়ি মাত্র একটি, পূর্ব-দক্ষিণ কোণে। এর বাসিন্দা বৃদ্ধ আবদুর রাজ্জাক। বললেন, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এখানে পরিবার নিয়ে বাস করছেন। অন্য পরিবারগুলোর মতো ঘর না বানানোর কারণ জানতে চাইলে তিনি কিছু বলতে রাজি হলেন না। তবে অন্য দুটি পরিবারের কয়েকজন নারী সদস্য বললেন, সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের নৈশপ্রহরী কাওসার শেখের বাধার কারণে ঘর বানাতে পারেননি আবদুর রাজ্জাক। কাওসার শেখই এই মাঠের হর্তাকর্তা। ওই কলেজের দপ্তরি লিটু শেখ মাঠে ঘর বানিয়ে ভাড়াও দিয়েছেন।

তবে লিটু বলেন, ‘মাঠে আমার ছোট ভাইয়ের ঘর আছে। আমি ঘর বানাইনি, ভাড়াও দেইনি। কিন্তু নাম হয় আমার।’ আর কাওসার শেখ বলেন, ‘আমি কাউকে ওখানে বসাইনি। ওরা যদি কোনো ঝামেলায় পড়ে, মুরব্বি হিসেবে আমারে ডাকে। কিন্তু সবকিছুতেই শুধু শুধু আমার নাম হয়।’ তিনি দাবি করেন, দখলদারদের উচ্ছেদের জন্য কলেজের পক্ষ থেকে নোটিশ দেওয়া হয়, তা তিনিই দেন।

স্বামী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে মাঠে বাস করেন বর্ণালী মালি। তিনি বলেন, ‘২০-২২ বছর আগে প্রথমে তিনটি পরিবার এই মাঠে বসতি গড়ি। এরপর এখন এত বসতি।’ আরেক বাসিন্দা সমর সরকার বলেন, কলেজ থেকে মাঝে মাঝে নোটিশ দেয়। তারপরও তাঁরা থাকেন।

কলেজ ও বিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ১৮৫৭ সালে রানি ভিক্টোরিয়ার নামে ওই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন নড়াইলের জমিদার রতন রায়। মাঠে পানি নিষ্কাশনের প্রাকৃতিক ব্যবস্থা ছিল। জেলা প্রশাসন ১৯৮৬ সালে আট একরের মাঠটি বিদ্যালয় ও কলেজকে ব্যবহার করতে দেয়। তখন থেকে পশ্চিম অংশ বিদ্যালয় ও পূর্বের অংশ কলেজের আয়ত্তে যায়।

১৯৯৬ সালে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের অংশ থেকে ৬৪ শতাংশ জমি বিক্রি করে দেয় আট ব্যক্তির কাছে। ২০০৫ সালে একই পাশে আরও ৩১ শতাংশ জমি হোমিওপ্যাথিক কলেজকে ছেড়ে দেওয়া হয়। নির্মল ভদ্র নামের এক ব্যক্তি জমিদারদের ওয়ারিশ দাবি করে মামলা করেন। দাবি করা অংশ দখলে রেখে তিনি ঘরবাড়ি করেছেন। ওই মামলার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিমাই চন্দ্র পাল গত শনিবার তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, দখলদারদের উচ্ছেদ করার মতো শক্তি তাঁদের নেই। তাহলে মাথা থাকবে না।

আর বিদ্যালয় পরিচালনা পর্যদের সভাপতি ও নড়াইল পৌরসভার মেয়র জাহাঙ্গীর বিশ্বাস বলেন, জাল দলিল নিয়ে অনেকে মাঠের জমির মালিকানা দাবি করছেন। বিষয়টি আইনগতভাবে মোকাবিলা করা হবে।

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বললেন, বর্তমানে মাঠের আয়তন সাড়ে চার একরও নেই। তবে এসব বিষয়ে কোনো তথ্য নেই বিদ্যালয় ও কলেজের কাছে।

বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের উপ-মহাসচিব, বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ও নড়াইল জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান বলেন, মাঠটি সংরক্ষণের জন্য সেখানে একটি আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় রাজনীতিকদের নানা মতের কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। বিকল্প ব্যবস্থার মাধ্যমে মাঠে বসবাসকারীদের অন্যত্র পুনর্বাসন করে সেখানে উপজেলা স্টেডিয়াম নির্মাণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।

ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ বরুণ কুমার বিশ্বাস বলেন, দুই মাস আগেও দখলদারদের উচ্ছেদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসনকেও অনেকবার জানানো হয়েছে।

জেলা প্রশাসক হেলাল মাহমুদ শরীফ বলেন, শুরুতে স্থাপনা নির্মাণে বাধা দেওয়া উচিত ছিল। এখন আশ্রয়ণ প্রকল্পে সেখানকার বাসিন্দাদের পুনর্বাসন করে একটি ইনডোরসহ দুটি স্টেডিয়াম নির্মাণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।- প্রথম আলো
২৫জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে