সঞ্জয় পার্থ: ২০১১ আইপিএল নিলামে নাম ছিল অস্ট্রেলিয়ান অলরাউন্ডার ড্যানিয়েল ক্রিশ্চিয়ানের। কোন দল তাকে কেনে কিনা তা দেখার জন্য আগ্রহভরেই নিলাম পর্ব দেখতে বসেছিলেন। অবাক চোখে দেখতে লাগলেন, নিলাম শুরু হওয়ার মুহূর্তের মধ্যেই তার দাম উঠে গেল চার লাখ ডলারে! ক্রিশ্চিয়ানের অবাক হওয়ার পালা বাকি ছিল তখনো।
দামটা চার লাখ ডলারেই আটকে থাকল মিনিট খানেকের মত, ক্রিশ্চিয়ান হয়তো ভেবেছিলেন এই দামেই বিক্রি হচ্ছেন তিনি। ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে তরতর করে দাম উঠে গেল আগের দামের ঠিক দ্বিগুণ, ৮ লাখ ডলারে! শেষ পর্যন্ত তিনি বিক্রি হলেন ৯ লাখ ডলারে! এক সাক্ষাৎকারে ক্রিশ্চিয়ান নিজেই পরে জানিয়েছিলেন, এটা লটারি জেতার চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না।
ক্রিকেট প্রশাসকদের জন্য অনুরূপ এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তার ৩ বছর আগে, ২০০৮ সালে। ২০০৮ সালের ২৪ জানুয়ারি, হাস্যোজ্জ্বল ললিত মোদি পরিচয় করিয়ে দিলেন আইপিএলের ৮ ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকপক্ষকে, মালিকানা পাওয়ার জন্য যাদের প্রত্যেককেই মোটা অঙ্কের অর্থ দিতে হয়েছে বিসিসিআইকে।
মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের জন্য পরিশোধ করল ১১১.৯ মিলিয়ন ডলার। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর জন্য ইউনাইটেড ব্রেভারিজ ও বিজয় মালিয়া খরচ করল ১১১.৬ মিলিয়ন ডলার। কলকাতা নাইট রাইডার্সের মালিকানা পাওয়ার জন্য শাহরুখ খান ও রেড চিলিস এন্টারটেইনমেন্টের পকেট থেকে খসল ৭৫ মিলিয়ন ডলার।
রাজস্থান রয়ালসের জন্যেও ধনাঢ্য এক গোষ্ঠীর খরচ হল ৬৭ মিলিয়ন ডলার। ইন্ডিয়া সিমেন্টস, যার ম্যানেজিং ডিরেক্টর আবার ছিল তখনকার বিসিসিআই সেক্রেটারি এন. শ্রীনিবাসন, চেন্নাই সুপার কিংসের জন্য খরচ করল ৯১ মিলিয়ন ডলার।
বোর্ডের কর্মকর্তা যখন কোন ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকপক্ষের অংশ হন, স্বার্থের সংঘাতের একটা অবকাশ তো থেকেই যায়। ললিত মোদি অবশ্য এ ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিতেই নারাজ ছিলেন। বলেছিলেন, শ্রীনিবাসন মালিক নন, কেবল একজন অংশীদার। এখানে তাই স্বার্থের সংঘাতের কোন সুযোগ নেই।
সব মিলিয়ে ৮ ফ্র্যাঞ্চাইজি দিয়ে বিসিসিআইয়ের মোট আয় হল ৭২৩.৫৯ মিলিয়ন ডলার। টিভি স্বত্ব যোগ করলে যেটা দাঁড়ায় ১ বিলিয়নেরও উপরে।
অস্ট্রেলিয়ার রাজ্যদলগুলো মূলত ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার লভ্যাংশের উপর ভিত্তি করেই টিকে থাকে। আইপিএলের এমন রমরমা বাণিজ্য দেখে তাই তাদের মাথাতেও ভর করল ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের ভূত। ওয়াকার চেয়ারম্যান ডেভিড উইলিয়ামস, নিউ সাউথ ওয়েলসের চেয়ারম্যান হ্যারি হরিনাথও ভিক্টোরিয়ার চেয়ারম্যান জিওফ ট্যাম্বলিন তাই ব্যক্তিগত বিনিয়োগের এই মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না।
এমনিতে অস্ট্রেলিয়ার ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে ব্যক্তিগত বিনিয়োগের ইতিহাস খুব একটা সমৃদ্ধ নয়। ২০০০ সালের দিকে একবার রাগবি, ফুটবল ও বাস্কেটবল ক্লাবগুলোতে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ ঘটানোর ছোট একটা পরীক্ষা করা হয়েছিল, কিন্তু সেটি মুখ থুবড়ে পরে।
তারপরেও অস্ট্রেলিয়ায় ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক টুর্নামেন্ট ও তাতে ব্যক্তিগত বিনিয়োগের ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে উঠেন সাবেক নিউ সাউথ ওয়েলস পেসার, ম্যানেজার ও আইপিএলের দল কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের প্রথম চিফ এক্সিকিউটিভ নিল ম্যাক্সওয়েল।
ডেইলি টেলিগ্রাফ তাঁকে পরোক্ষভাবে উদ্ধৃত করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে ম্যাক্সওয়েল বলেন, আমরা কিভাবে এই টাকার অঙ্ককে অবহেলা করতে পারি? এমন না যে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া কোন তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হয়েছে। তাদের আর্থিক অবস্থা সবসময়ই বেশ স্বচ্ছল। তারপরেও অন্য খেলার সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে রাজ্য ক্রিকেটে আমাদের এমন কিছু ভাবতেই হবে।
ওয়াকার বাণিজ্যিক আইনজীবী ডেভিড উইলিয়ামসও সুর মিলিয়েছেন একই তালে। ২০০৯-১০ এর বার্ষিক প্রতিবেদনে তিনি লেখেন, ‘খেলাটির উন্নয়নের সাথে তাল মেলানোর জন্য আমাদের পর্যাপ্ত ফান্ডের ব্যবস্থা করতে হবে। সদস্যদের জন্য নতুন ও উন্নত সুবিধার ব্যবস্থাও করতে হবে আমাদের’।
কিন্তু ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার এতে শুরু থেকেই সায় ছিল না। সিএ’র তখনকার বাণিজ্য বিভাগের প্রধান মাইক ম্যাককেনি ও জানিয়েছেন সেটাই, যেই অঙ্কের প্রস্তাব আসছিল আমাদের কাছে তা সত্যিই ঈর্ষণীয়। কিন্তু আমরা ব্যাপারটা সম্পর্কে ঠিক নিশ্চিত ছিলাম না। আমাদের কাছে এটি সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি।
এই বিষয়ে যখন একের পর এক বিতর্ক তৈরি হচ্ছিল, তখন ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া নতুন একটি পরিকল্পনা তৈরি করল। আট দল নিয়ে একটি শহর ভিত্তিক টুর্নামেন্ট বিগ ব্যাশ লিগ (বিবিএল) শুরু করার প্ল্যান বানায় তারা, আর এর মূল উদ্দেশ্য ছিল নারী ও শিশুদের ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহী করে তোলা।
ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধিরূপে ওয়ালিদ এলি জানান, ‘সব সংস্কৃতি ও পটভূমির মানুষ যেন এই খেলায় নিজেদের অস্ট্রেলিয়ান সত্ত্বার প্রতিফলন দেখতে পায় সেটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। যদি আমাদের জনগণ সেই প্রতিফলন নাই দেখতে পায়, তাহলে ক্রিকেটকে আমরা সব অস্ট্রেলিয়ানের খেলা বলতে পারি না। আর যদি আমরা সেটাতে ব্যর্থ হই, তাহলে জাতীয় পর্যায়ে ক্রিকেট তার অবস্থান হারিয়ে ফেলবে, এবং অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের এই দুর্দান্ত ইতিহাস ও সংস্কৃতি আমাদের নাতিনাতনিদের কাছে কোন অর্থই বহন করবে না।’ এক কথায় তিনি বুঝিয়েছেন, অস্ট্রেলিয়ার জাতিগত বৈচিত্র্য ফুটিয়ে তোলার জন্য নতুন একটি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের প্রয়োজন।
সিএ প্রধান জেমস সাদারল্যান্ডও বলেছিলেন, খেলায় নতুন দর্শক আনাই আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল, এবং এখনো সেটাই আছে। তবে ২০১০ এর দিকে ক্রিকেটে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ নিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডে বেশ ভালো রকমের একটা দ্বিমত দেখা দেয়।
সাদারল্যান্ডের ভাষ্যমতে, ‘ওই সময়টা বেশ হতাশাজনক ছিল। আমরা বুঝতে পারছিলাম বোর্ডরুমে একটা স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে। বোর্ডরুমে এমন কয়েকজন ছিল যাদের দায়িত্ব ছিল সিএ’র হয়ে ভোট দেয়া, কিন্তু কিন্তু তারা একইসাথে নিজ নিজ রাজ্য বোর্ডের প্রধানও ছিলেন। তাই রাজ্যের স্বার্থ দেখাটাও তাদের পক্ষে অসম্ভব কিছু ছিল না।’
যে আইপিএলের আদলে রাজ্য ক্রিকেট বোর্ডগুলো ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক টুর্নামেন্ট করতে চাচ্ছিল, সেই আইপিএল এর মডেলটাই পছন্দ হয়নি সিএ’র। তাদের মতে, আইপিএলের নিলামে যে দুই বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি মূল্যের ব্যবসা হয়েছে, তার অনেকটাই ধোঁয়াশায় ঢাকা। যতটা অর্থ আয় হবে বলে বিসিসিআই দেখিয়েছে, বাস্তবে তার পুরোটা তারা আয় করতে পারেনি বলেই তাদের ধারণা।
সিএ তাই তাদের পরিকল্পনাতেই অটল থাকে। অনেকেই তখন সন্দেহ প্রকাশ করেছিল যে তাদের এই প্ল্যান আদৌ সফলতার মুখ দেখবে কিনা। কিন্তু পর্যাপ্ত গবেষণার পর সিএ নিশ্চিত হয়, পরিকল্পনা কাজে দেবে।
শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনা কিন্তু কাজে দিয়েছে। আইপিএলে এরই মধ্যে বিভিন্ন ধরণের দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে। দুর্নীতির দায়ে দল নিষিদ্ধ হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু বিগ ব্যাশের গায়ে এখনো পর্যন্ত তেমন কলঙ্ক লাগেনি। বরং এই বিগ ব্যাশের মধ্য দিয়েই উঠে এসেছে অ্যাডাম জাম্পা, পিটার হ্যান্ডসকম্ব, নিক ম্যাডিনসন, অ্যান্ড্রু টাইয়ের মত প্রতিভাবান খেলোয়াড়েরা। বিগ ব্যাশের কার্যকারিতা নিয়ে নিশ্চয়ই আর কারোর মনে সংশয় থাকার কথা না!- দ্য ক্রিকেট মান্থলি অবলম্বনে। খেলাধুলা
২২ ফেব্রুয়ারী ২০১৭/এমটি নিউজ২৪ ডটকম/আ শি/এএস