বৃহস্পতিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৭, ০৭:৩৫:২৫

মুস্তাফিজের প্রতি বিশ্বাস রাখুন, পস্তাবেন না

মুস্তাফিজের প্রতি বিশ্বাস রাখুন, পস্তাবেন না

সালমান সানজিদ: সময়টা ২০০৬ সাল। সেসময় বাংলাদেশ ক্রিকেটে অন্যতম বড় নক্ষত্রের নাম ছিল শাহরিয়ার নাফিস। বলা চলে, সেই বছর তিনিই ছিলেন দলের সবচেয়ে বড় তারকা। কেননা মাত্র আগের বছরই অভিষেক হওয়া এই ওপেনার ২০০৬ সালে পেয়ে যান তিন তিনটা ওয়ানডে সেঞ্চুরি (যখন কিনা ওয়ানডে সেঞ্চুরি ছিল বাংলাদেশের জন্য সোনার হরিণ)।

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই ঐতিহাসিক টেস্ট সেঞ্চুরি, প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে এক পঞ্জিকা ১০০০+ রানও করেন। এছাড়া দেশের বর্ষসেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন। পেয়ে যান দলের সহ-অধিনায়কত্ব। বাংলাদেশের প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচের অধিনায়ক তিনিই ছিলেন। তখন সর্বত্র উচ্চারিত হত শাহরিয়ার নাফিসের নাম। স্বপ্নের মতই শুরু হয়েছিল।

কিন্তু সেই ‘স্বপ্নের শুরু’টাই পরে তার দুঃস্বপ্নের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটা তিনি নিজেও কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন। শুরুতেই অভাবনীয় সাফল্য পেয়ে যাওয়ায় তার কাছে সবার প্রত্যাশার পারদটাও বেড়ে যায়। পরে সে অনুযায়ী পারফর্ম করতে না পারায় ‘গেল গেল’ রব উঠে। দর্শক ও টিম ম্যানেজমেন্ট - সবার তার প্রতি যে পরিমাণ প্রত্যাশা ছিল তা কিছুদিন মেটাতে না পারায় একসময় তিনি দল থেকে বাদ পড়েন।

এরপর তিনি এসেছেন, গিয়েছেন, অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটেছে, আবার ফিরেছেন, আবার বাদ পড়েছেন। কিন্তু থিতু হতে পারেননি। কারণ তিনি আর সেই 'শুরুর শাহরিয়ার নাফিস' হতে পারেননি।

আজকের দৃশ্যপটের মূল চরিত্র শাহরিয়ার নাফিস নন, মুস্তাফিজুর রহমান। ইনিও শুরুতেই সবাইকে চমকে দিয়েছেন। নাফিসের মতই শুরুতেই অভাবনীয় সাফল্য চুম্বন করেছেন।নাফিসের মত বললে ভুল হবে। তার চেয়েও ঢের বেশি। পুরো বিশ্ব কাঁপিয়েছেন।কিভাবে কাঁপিয়েছেন সে ঘটনা সবারই জানা।

আরেকটা বিষয়ও সবারই জানা। সেটা হল -সবারই খারাপ সময় আসে।সেটা মুস্তাফিজের বেলায়ও আসে,স্টার্কের বেলায়ও আসে। কিন্তু এ বিষয়টা জানার পরও সবাই কেন জানি মুস্তাফিজের খারাপ ফর্মটা মানতে চাননা। জানেন অথচ মানেন না।আমরা সবাই ভাবি, মুস্তাফিজ মানেই কাটার, মুস্তাফিজ মানেই স্লোয়ারে বিভ্রান্ত হয়ে মিড অফে ক্যাচ তুলে দেওয়া, মুস্তাফিজ মানেই পাঁচ উইকেট।

‘আচ্ছা যান, পাঁচ উইকেটের কেসটা বাদ দিলাম। কিন্তু ওর কাটার ক্যান হবে না ভাই?ওর কাটারে ক্যামনে ৬ মারে? ও ৬ এর উপরে রান দেয় ক্যামনে? মুস্তাফিজের ধার আর নাই।কাটার-ফাটার সব গ্যাছে!’

এই হল মুস্তাফিজের অফ ফর্ম নিয়ে সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীদের সারকথা। অনেকটা শাহরিয়ার নাফিসের মতনই। তাঁর বেলায়ও সাধারণ মানুষের কথাগুলো অনেকটা এরকমই ছিল।দারুণ শুরুর পর হঠাৎ ছন্দপতনেই মুগ্ধতাপতন!

ইনজুরি থেকে ফেরার পর যেকোন বোলারেরই পুরনো ছন্দ ফিরে পেতে সময় লাগে। তা মুস্তাফিজের বেলায়ও সত্যি। তার উপর প্রযুক্তির সাহায্যে তার বোলিং নিয়ে মারাত্মক কাঁটাছেড়া হয়। এতে তাঁর বোলিংয়ের দুর্বলতা, শক্তিমত্তা, তাঁকে খেলার কৌশল বের করা তেমন কঠিন কাজ নয়।

অজন্তা মেন্ডিসও একসময় বিশাল ধাঁধা নিয়ে ক্রিকেটে হাজির হয়েছিলেন।পুরো বিশ্বকে নাচিয়েছিলেন। তাঁর সেই ধাঁধার সমাধানও আবিষ্কৃত হয়েছে। তাঁর বেলায়ও ‘মুগ্ধতাপতন’ ঘটেছে। এখন তিনি কোন দৃশ্যপটেই নেই।

মুস্তাফিজের ‘কাটার রহস্য’ যে একসময় আবিষ্কার হবে এবং তাকে খেলার কৌশলও যে সবাই বের করবে তা জানাই ছিল। তা হচ্ছেও। তাঁকে আরো কৌশলী হতে হবে। শুধু কাটারে ভরসা না করে তাকে তার শক্তির জায়গা আরো বাড়াতে হবে। ইনসুইং, আউটসুইং রপ্ত করা তার জন্য জরুরী।

ইয়র্কার তিনি ভালই দেন। কিন্তু সেটার আরো কার্যকরী ব্যবহার শিখতে হবে। আশা করি তিনি পারবেন। তাকে সময় দিন। কিন্তু প্লিজ ‘গেল গেল’ রব তুলে তাকে হারিয়ে যেতে দেবেন না। বিশ্বাস হারাবেন না, বিশ্বাস রাখুন।

মুস্তাফিজকে নিয়ে সর্বমহলে আরো কিছু কথা হয়। যেমন: ‘মুস্তাফিজকে টেস্ট না খেলানোই ভাল। আবার ইনজুরিতে পড়বে’, ‘তাকে ওয়ানডের জন্য ফিট রাখা জরুরী। টেস্ট থেকে বিশ্রাম দেয়া উচিত’, ‘ওর বয়স কম। ওকে ছোট ফরম্যাটে খেলাও’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব কথার বিপরীতে কিছু কথা বলতে হয়। যেমন - আমরাই বলি মুস্তাফিজের আগের ধার আর নেই। কাটারে হচ্ছে না। ভ্যারিয়েশন দরকার। নতুন কিছু দরকার। কিন্তু সেই ‘নতুন কিছু’ ওয়ানডেতে ৬০ বলের মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাটা ঝুঁকিপূর্ণ না?

আর টি- টোয়েন্টিতে ২৪ বলের কোটায় কোন কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগই নেই। তো? টেস্ট ছাড়া নতুন নতুন ভ্যারিয়েশন পরীক্ষা করার উপায় কী? টেস্টেই অনেক কিছু নিয়ে কাজ করা যাবে। টেস্ট খেলে সে আরো অনেক কিছু শিখতে পারবে। সেগুলো শর্টার ফরম্যাটে কাজে লাগাতে পারবে ও।

তাছাড়া টেস্টে আমাদের ২০ উইকেট নেওয়ার মত বোলিং ইউনিট গড়তে হলে মুস্তাফিজের বিকল্প নেই। আর, সে যদি এই বয়সে টেস্ট না খেলে তো কোন বয়সে খেলবে? বাংলাদেশ এক বছরে এমনিতেই খুব বেশি টেস্ট খেলার সুযোগ পায় না।

তো সেই অল্প কয়টা টেস্টেও যদি তাকে বিশ্রাম দেওয়া হয় তাহলে কিভাবে হবে? বরং আমরা ওয়ানডে খেলি বেশি। সেখানে ধকল বেশি। বিশ্রাম দিতে চাইলে কয়েকটা ওয়ানডে অথবা টি টুয়েন্টিতে দেওয়া যায়। যাতে ও ভালভাবে টেস্ট সিরিজ খেলতে পারে।

সবকিছুই হবে, যদি তার উপর বিশ্বাসটা ঠিকঠাক থাকে। এখনই সবকিছুর ‘শেষ’ দেখে নিবেন না। একদম শেষ অবধি দেখুন। তাকে ‘নতুন ওয়াসিম আকরাম’ বলাটা যেমন ‘তাড়াতাড়ি বাড়াবাড়ি’ হয়ে গিয়েছিল,তেমনি এখনই তার শেষ দেখে ফেলাও ‘তাড়াতাড়ি বাড়াবাড়ি’ হয়ে যাচ্ছে। জাস্ট গিভ হিম টাইম। আবারও শুধু একটা কথাই বলতে চাই, বিশ্বাস রাখুন।-খেলাধুলা
২৭ এপ্রিল ২০১৭/এমটিনিউজ২৪ডটকম/এপি/ডিসি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে