বাংলাদেশের ফুটবল অঙ্গনে বিদেশি খেলোয়াড়দের আগমনের ইতিহাস
স্পোর্টস ডেস্ক: বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে ইদানীং ফুটবলারদের ‘হাট’ই বসে। আফ্রিকার নাইজেরিয়া, ঘানা, সেনেগাল, ক্যামেরুন, লাইবেরিয়া, গিনি প্রভৃতি দেশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ফুটবলার নিজেদের উদ্যোগেই ঢাকায় এসে ওঠেন বিভিন্ন হোটেলে। এরপর বুট-মোজা-জার্সি সঙ্গে নিয়ে সোজা চলে যান ক্লাবগুলোর ট্রায়ালে। ক্লাব কর্তাদের পছন্দ হয়ে গেলেই আয়-রোজগারের সংস্থান হয়ে যায়। মাসে গড়ে হাজার দেড়-দুই হাজার ডলার হাতে এলে মন্দ কি! কিন্তু ‘হাটে’ বিক্রি হওয়া এসব আফ্রিকানদের মান কতটা ভালো তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে এটাও সত্য, অসংখ্য গড়পড়তা মানের আফ্রিকানের মধ্যে দুই-একজন নজর কাড়েন নিজেদের প্রতিভা দিয়েই।
সাবেক তারকা ফুটবলার ও কোচ গোলাম সারোয়ার টিপুই দিলেন তথ্যটা। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশের ফুটবলে প্রথমবারের মতো আফ্রিকান খেলোয়াড় নিয়ে আসে মোহামেডান। ইব্রাহিম সেংগর নামের সেই খেলোয়াড়টি তাঁর ‘পাওয়ার ফুটবল’ দিয়েই দৃষ্টি কেড়েছিলেন সবার। ওই মৌসুমে মোহামেডানের লিগ শিরোপা জয়ে তাঁর ভূমিকাও একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো ছিল না।
ইব্রাহিম মাত্র একটি মৌসুমই খেলেছিলেন ঢাকায়। পুরোপুরি পেশাদার ছিলেন না। পাকিস্তানের করাচিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য এসে সেখানকার ঘরোয়া ফুটবলে খেলতেন। ছিয়াশি সালের দিকে পাকিস্তানে একটি টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে মোহামেডানের সেই সময়কার কোচ মোহাম্মদ কায়কোবাদের চোখে পড়ে যান ইব্রাহিম। একটি মৌসুম খেলেই পড়াশোনা শেষ করার জন্য ফিরে যেতে হয় তাঁকে পাকিস্তানে।
ঢাকার ক্লাবগুলো আফ্রিকান ফুটবলারে মজে যায় ইব্রাহিমের মাধ্যমেই। ওই ছিয়াশিতেই মোহামেডানের বিপক্ষে ম্যাচে আবাহনী নিয়ে আসে কলকাতা ফুটবলের নাইজেরিয়ান ‘সেনসেশন’ চিমা ওকোরিকে। ইব্রাহিমের জবাব হিসেবেই হয়তো চিমাকে এনে মোহামেডানকে ভড়কে দিতে চেয়েছিল আবাহনী। ওই সময় পর্যন্ত চিমাই ছিলেন দেশের ফুটবলে খেলে যাওয়া সবচেয়ে উঁচুমানের বিদেশি খেলোয়াড়।
চিমার স্মৃতিটা আজও টাটকা গোলাম সারোয়ার টিপুর। বললে, ওর ফিনিশিং ছিল দেখার মতো। দুই পায়েই প্রচণ্ড শট নিতে পারত সে। পেনিট্রেশন ছিল ভয়ংকর। ডি বক্সের মধ্যে যেকোনো জায়গা থেকেই গোল করতে পারত।’
চিমাকে নিয়ে একটি ঘটনায় বাংলাদেশের ফুটবলে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য করেছিল ফিফাকেও। ১৯৮৮-৮৯ মৌসুমে চিমাকে নিয়ে আবাহনী-মোহামেডানের দড়ি টানাটানির ইতিহাস বাংলাদেশের ফুটবলেই এক কালো অধ্যায় হয়ে আছে। সেবার আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচের জন্য চিমাকে দলে নিতে চেয়েছিল দুই প্রধানই। চিমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি আবাহনীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে মোহামেডানে নাম লিখিয়েছিলেন। আবাহনীর চরম আপত্তির পরেও চিমা আবাহনীর বিপক্ষে মোহামেডানের জার্সি পরেই মাঠে নেমেছিলেন। ব্যাপারটি ফিফাকে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ করেছিল। বাংলাদেশ ছিল নিষিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকির মধ্যেও।
এ দেশের মাটিতে খেলে যাওয়া সবচেয়ে বড় আফ্রিকান তারকা ছিলেন এমেকা ইউজিগোই। নাইজেরিয়ান এই ফুটবলারও কলকাতা থেকে এসে ১৯৮৭ সালে নাম লিখিয়েছিলেন মোহামেডানে। পরপর দুটি মৌসুম মোহামেডানে খেলে যাওয়া এমেকা আজও মোহামেডান সমর্থকদের হৃদয়ে আলাদা স্থান করেই আছেন। এই তো ২০১১-১২ মৌসুমে মোহামেডানের কোচও হয়েছিলেন। এমেকা কোন মানের ফুটবলার ছিলেন, তা বোঝাতে একটি উদাহরণই যথেষ্ট। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে এই এমেকাই নাইজেরিয়ার জার্সি গায়ে মাঠে নেমেছিলেন।
এমেকার পক্ষে-বিপক্ষে দুই জায়গাতেই খেলার অভিজ্ঞতা ইমতিয়াজ সুলতান জনির। তাঁর মতে, ‘এমেকা স্কিলের সঙ্গে তাঁর শারীরিক শক্তির মিশেল ঘটিয়েছিলেন দারুণভাবে। একটু রাফ খেলোয়াড় হলেও সে ছিল দুর্দান্ত এক টিমম্যান। সাতাশিতে আবাহনীর রক্ষণভাগে ছিলাম ইউসুফ, আমি, পাকির আলী আর মোনেম মুন্না। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম শক্তি দিয়ে ওর সঙ্গে পেরে ওঠা যাবে না। এমেকার পায়ে বল এলেই আমরা কয়েকজন মিলে ওকে ঘিরে ধরতাম। এর পরেও সে প্রতিরোধ ভেঙে চলে যেত অবলীলায়। মোহামেডানে এসে এমেকাকে সতীর্থ হিসেবে পাই ১৯৮৮ সালে। খুব ভালো সময় কেটেছিল ওর সঙ্গে। এমেকা থাকাকালীন মোহামেডান পরিণত হয়েছিল রীতিমতো অজেয় এক দলে।’
ঢাকার ফুটবল লিগে দারুণ এক ঘটনার মালিক এমেকা। ১৯৮৮ সালের লিগের একটি ম্যাচে অধুনালুপ্ত আদমজী ক্লাবের বিপক্ষে খেলা শুরু হওয়ার প্রথম সেকেন্ডেই গোল করেছিলেন তিনি। সেই রেকর্ড খুব সম্ভবত এখনো ভাঙতে পারেনি কেউই।
১৯৮৮-৮৯ মৌসুমের পর বিদেশি খেলোয়াড় নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল ঢাকার ফুটবলে। ১৯৯২ সালে আবারও বিদেশি খেলার অনুমতি দেওয়া হয়। ততদিনে এমেকাদের মতো খেলোয়াড়েরা নিজেদের নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। চুরানব্বইয়ের বিশ্বকাপে মাঠে নামার আগেই ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে নিয়মিত খেলেছেন তিনি। সমর্থকদের দাবি সত্ত্বেও এমেকাকে আবারও নিয়ে আসার সামর্থ্য হয়তো হারিয়ে ফেলেছিল সাদা-কালো শিবির।
এমেকা-চিমাদের পর বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতোই আফ্রিকান ফুটবলাররা আসা শুরু করে ঢাকার ফুটবলে। ১৯৮৮-৮৯ মৌসুমে ব্রাদার্সে খেলেন তিন নাইজেরিয়ান—সানডে, লাভডে ও বেনসেলাস। এমেকা-চিমাদের দেখে অভ্যস্ত ঢাকার দর্শকদের মন জয় করার মতো কিছুই করতে পারেননি তারা। ১৯৯৫ সালে মোহামেডান এনেছিল দুই নাইজেরিয়ান ফুটবলার—লাডি বাবালোলা ও বোডে বাবালোলাকে। নামের সাদৃশ্যের কারণে এরা দুজন বেশ আলোচিত ছিলেন। পঁচানব্বইয়ের মৌসুমে মোহামেডান দলে এদের ছিল গুরুত্বপূর্ণ অবদান। কিন্তু মানের দিকে এমেকাদের কাছে-ধারেও ছিলেন না তাঁরা। সেই মৌসুমেই ব্রাদার্স এনেছিল চিবুজার, ক্রিস্টোফার ও বার্নার্ড নামের তিন খেলোয়াড়কে। চিবুজার বেশ দক্ষ ছিলেন। ব্রাদার্সকে ভালোই সেবা দিয়েছিলেন তিনি।
কোলি বার্নসকেও কিছুটা মনে রাখবে ঢাকার দর্শকেরা। ২০০১ সালে আবাহনীর লিগ শিরোপা জয়ে তাঁর অবদান দারুণ। সেবার মোহামেডানের বিপক্ষে কোলি বার্নস তীব্র গতিতে মোহামেডানের ডিফেন্ডারদের পেছনে ফেলে করেছিলেন অসাধারণ এক গোল। ১৯৯৮-২০০২ সালের দিকে আবাহনী ও মুক্তিযোদ্ধায় খেলে যাওয়া ঘানার দুই ফুটবলার ওপুজু আর ঘানশা ছিলেন পরিশ্রমী। কিন্তু মানের দিক দিয়ে খুব আহামরি ছিলেন না। মাঝখানে আবাহনীর ঘরের ছেলে হয়ে যাওয়া ঘানার আউডু ইব্রাহিম কিন্তু যথেষ্ট মানসম্মত ফুটবলারই।
সনি নর্দের নাম তো না নিলেই নয়। তিনি আফ্রিকান না হলেও গত তিন মৌসুম তিনি প্রথমে শেখ রাসেল, পরে শেখ জামালের হয়ে মাঠ মাতিয়েছেন। । হাইতিয়ান এই ফুটবলারের মান দেখে অনেকেই হারিয়ে গিয়েছিলেন সেই এমেকা-চিমাদের সময়ে। কেউ কেউ তো তাঁকে এদেশের মাটিতে খেলে যাওয়া অন্যতম সেরা বিদেশি ফুটবলারেরই মর্যাদা দিয়ে দেন। ২০১৪ সালে শেখ জামাল কলকাতায় আইএফএ শিল্ড খেলতে গেলে তিনি প্রায় একক নৈপুণ্যেই দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন শিরোপার হাত ছোঁয়া দূরত্বে। তাঁকে অনেক দিনই মনে রাখবে বাংলাদেশের ফুটবল।
হঠাৎ করেই এক ‘কালো মানিকে’ উচ্ছ্বসিত এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ফুটবল। এলিটা কিংসলে নামের নাইজেরিয়ান এই স্ট্রাইকার চট্টগ্রাম আবাহনীর হয়ে শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ফুটবলে খেললেন মনে দাগ কাটার মতো ফুটবলই। নিম্নমানের আফ্রিকান ফুটবলারদের ভিড়ে কিংসলেকে এক আশ্চর্য ব্যতিক্রমই মনে হচ্ছে আপাতত। কিংসলে স্মৃতিকাতর করে দিয়েছেন সবাইকে। নতুন করেই মনে করিয়ে দিয়েছেন এমেকা-চিমাদের।-প্রথম আলো
৩রা, নভেম্বর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/রাসেল/মাহমুদ