ক্রিকেটকে লজ্জিত করে ভারতের বিরাট জয়
নজরুল ইসলাম, মোহালি (ভারত) থেকে : চা–পানের বিরতির আগেই প্রেস বক্সে সাংবাদিককুলের ল্যাপটপে কপি লেখার চাপ নেই। ম্যাচের দিকেও ততটা আগ্রহ ছিল না, যতটা আগ্রহ ছিল ভারতের চণ্ডীগড় থেকে ফেরার ট্রেন, বাসের সময়সারণী নিয়ে। কেউ খুঁজছেন বিমানের টিকিট, কেউ আবার ট্রেনের। যাদের আবার চণ্ডীগড় থেকে সরাসরি বেঙ্গালুরুতে দ্বিতীয় টেস্ট ‘কভার’ করতে যাওয়ার কথা ছিল, ‘সিডিউল’ বদলের তোড়জোর।
সব কিছুর জন্য দায়ী কি মোহালির বাইশ গজ? না ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা। দলজিতের আঁতুড়ঘরে মাত্র তিনদিনে টেস্ট শেষ! এরপরেও প্রশ্ন উঠবে না? সতীর্থরা জন্মদিনে কোহলিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন টেস্ট জেতার। অশ্বিনদের সঙ্গে অবদান থেকে গেল মোহালির বাইশ গজেরও। পিচ নামক খোঁয়াড়ে খুন হল ক্রিকেট, লজ্জিত হল ক্রিকেট। এটা কখনোই টেস্ট ক্রিকেটের সেরা বিজ্ঞাপন নয়। তবু দেশের মাটিতে অভিষেক টেস্ট জিতে স্মরণীয় হয়ে থাকল কোহলির কাছে।
ভাল স্পিনার হতে পারেন, কিন্তু বিশেষজ্ঞ হতে সময় লাগবে। দ্বিতীয় দিন ম্যাচের শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে এসে রবিচন্দ্রন অশ্বিন এসে বলেছিলেন, ‘বাজে ব্যাটিংয়ের জন্যই উইকেট খারাপ মনে হচ্ছে।’ সুনীল গাভাসকারকে ঠেস দেওয়ার জন্য টিম ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রীর শেখানো বুলি কিনা জানা যায়নি। এত কিছুর পরেও কী সেই বাজে ব্যাটিংয়ের অজুহাত দেবেন অশ্বিন? একটা ইনিংসে না হয় ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা হতে পারে, তাই বলে চার–চারটি ইনিংসে! টেস্টের ৪ ইনিংসে মোট রান ৬৯৪। সব থেকে বড় কথা একদিনে উইকেট পড়ল ১৮টি। দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বিতীয় ইনিংসের পরিধি মাত্র ৪০ ওভার। এরপরেও ব্যাটিং–ব্যর্থতার কথা উঠবে?
‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’। এ কথাটা বোধহয় সবসময় প্রযোজ্য নয়। তৃতীয় দিন মধ্যাহ্নভোজের বিরতির আগে পর্যন্ত পেন্ডুলামের মতো দুলল টেস্ট। কখনও অ্যাডভান্টেজ ভারত, কখনও দক্ষিণ আফ্রিকা। কখনও আবার ‘ডিউস’। ফ্রিডম সিরিজের প্রথম টেস্ট ১০৮ রানে হারলেও চতুর্থ ইনিংস ছাড়া ম্যাচ থেকে কখনও একেবারে ‘বোল্ড আউট’ হয়ে যায়নি দক্ষিণ আফ্রিকা। তৃতীয় দিন সকালে কোহলি–পুজারার ব্যাটিং ভারতকে বড় রানের স্বপ্ন দেখাচ্ছিল। কিন্তু ভ্যান জিল কোহলিকে (২৯) ফেরাতেই ভারতীয় ব্যাটিংয়ের ‘ফ্লাডগেট’ খুলে গেল। ডেল স্টেন তো দ্বিতীয় ইনিংসে বল হাতে নামতেই পারলেন না।
প্রথম ইনিংসে ইমরান তাহিরের আগে ডিন এলগারকে আক্রমণে নিয়ে এসে বাজিমাত করে গিয়েছিলেন হাসিম আমলা। দ্বিতীয় ইনিংসে একই ‘ট্রিটমেন্ট’ অন্য ‘মেডিসিন’–এ। এবার ভ্যান জিল। ইমরান তাহির এসে নিজের প্রথম ওভারে পুজারাকে তুলে নিতেই ভারতীয় ব্যাটিংয়ের দুর্দশা আরও একবার প্রকট হয়ে দেখা দিল। ঋদ্ধিমানের (২০) লড়াই ভারতকে ২০০ রানে পৌঁছে দিলেও প্রথম সেশনের দ্বিতীয় ঘণ্টায় ২৪ রানে ৬ উইকেট অনেক কিছুরই ইঙ্গিত দিয়ে গেল। দক্ষিণ আফ্রিকা তো দ্বিতীয় ইনিংসে ২ ঘণ্টা ৩৯ মিনিটের বেশি দাঁড়াতেই পারল না। এরপরও মোহালির বাইশ গজ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না?
২১৮ রানের লক্ষ্যটা আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও বাস্তবটা অন্য। অন্তত মোহালির এই উইকেটে ৫০০ রান তাড়া করার সামিল। রবিচন্দ্রন অশ্বিনের সামনে দুই বাঁ–হাতিকে ঠেলে দিতে চায়নি বলেই এলগারের সঙ্গে ফিলান্ডারকে ওপেনিংয়ে পাঠিয়ে ফাটকা খেলতে চেয়েছিল প্রোটিয়া শিবির। খুব বেশি রানের লক্ষ্য নয়। টেলএন্ডারের কাছ থেকে যদি শুরুতে কিছু রান পাওয়া যায়, সেটাও বোনাস। মিডল অর্ডারকে আড়াল করার বিষয়টাও ছিল। টিম ম্যানেজমেন্টের স্ট্র্যাটেজি কাজে লাগানোর মতো দক্ষতা মোহালির এই বাইশ গজে অন্তত ছিল না ফিলান্ডারের। ফিলান্ডার দ্বিতীয় ওভারেই জাদেজার বলে ফিরে যাওয়ায় চেতেশ্বর পুজারাকে ভারতীয় দলে যে ভূমিকা পালন করতে হয়েছে, ফাফ ডু’প্লেসিসকেও একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হল। দু’জনের মধ্যে পার্থক্য একটা জায়গাতে, পুজারা ত্রাতা হয়ে দাঁড়ালেও পারলেন না ডু’প্লেসিস।
স্পিন খেলার দক্ষতার ঘাটতি যে থেকেই গেছে। রবিচন্দ্রন অশ্বিনের স্পিন নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না, রবীন্দ্র জাদেজার মতো মাঝারি মানের স্পিনারও দাপট দেখিয়ে গেলেন। ২১ রানে ৫ উইকেট নিয়ে প্রোটিয়াদের ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ড ভেঙে দিলেন। হাসিম আমলার উইকেটটা শুধু উপহার৷ বাকিরা স্পিনের জালে বন্দী৷ এইরকম ‘খাটাল’ উইকেটে কী করে বল ছাড়ার দুঃসাহস দেখালেন দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক! ১ মিলিমিটার না ঘুরিয়েও আমলাকে তুলে নিয়ে গেলেন টিম ইন্ডিয়ার ‘স্যর জাদেজা’।
দক্ষিণ আফ্রিকা ইনিংসে দ্বিতীয় ওভার থেকেই মিছিল শুরু হয়েছিল, মাঝে ডিন এলগার ও ভ্যান জিল ‘ব্যারিকেড’ তুলে দঁাড়িয়েছিলেন। যখনও বোলিং পরিবর্তন করেছেন কোহলি, সাফল্য পেয়েছেন। বরুণ অ্যারনকে নিয়ে এসেও ধাকবাহিকতা বজায় রাখলেন। উইকেটে ক্রমশ ‘সিমেন্ট’ হয়ে বসা এলগারকে (১৩) না ফেরালে ভারতের জয়টা আরও সময়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়াত।
সবেমাত্র আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদার্পণ ঘটেছে, উপমহাদেশের উইকেটে খেলার অভিজ্ঞতা না থাকার মাশুল দিতে হল ভিলাস, ভ্যান জিলদের। তবে ১০৯ রানে ইনিংস শেষ হয়ে যাওয়াটা একটু বেশিই বাড়াবাড়ি। অন্তত এই দক্ষিণ আফ্রিকা দলের কাছে মানানসই নয়। পরের টেস্টে ডুমিনি হয়ত সুস্থ হয়ে মাঠে ফিরবেন, তবু দক্ষিণ আফ্রিকার সিরিজে ফেরা খুবই কঠিন। মোহালির বাইশ গজের যদি এই অবস্থা হয়, বাকি ভেনুগুলোতে কী হবে?
৮ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি